সৌমিত্র সেন


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

তিনি অবতারপত্নী, স্বয়ং জগজ্জননী। কিন্তু এই মা রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের জন্মলগ্ন থেকেই অন্তরালবর্তিনী। তাঁকে কেউ দেখতে পান না। দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্তজনসঙ্গে সেই উথালপাথাল মাতোয়ারা দিনগুলিতেও তিনি ছিলেন কয়েকহাত দূরে, অথচ কী গভীর অন্তরালে এবং একইসঙ্গে কী নিবিড় নিকটে।


নরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ ভক্তেরা যখন এক-এক সময়ে শ্রীরামকৃষ্ণের আত্যন্তিক আগ্রহে রাতেও থেকে যেতেন দক্ষিণেশ্বেরে, তখন নহবত থেকে তৈরি হয়ে আসত মোটা মোটা রুটি ও ছোলার ডালের নৈশভোজ। নহবতের ওই খুপরি ঘর, যেখানে উঠে দাঁড়ালে ঘরের ছাদ থেকে ঝুলতে থাকা শিকেয় ঠক করে মাথা ঠুকে যেত; সেই ঘরে সারাদিন মা স্বেচ্ছাবন্দি; দালানের সামনে ঝোলে মোটা চিকের আড়াল। কখনও-সখনও সেখানে এসে দাঁড়ান তিনি। ভক্তসঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণের উদ্বেলিত লীলাবিলাস দেখেন। ওইটুকুই তাঁর অর্জন। বাকি সময়টুকু কী ভাবে যে ওই ঘরে তিনি থাকতেন, কে জানে!


অথচ, এই তাঁর অন্তরালবর্তী রূপ পরবর্তী সময়ে ক্রমশ প্রকাশ্য হয় সম্পূ্র্ণ অন্যভাবে। তখনও তিনি কাগজে-কলমে আড়ালেই, পর্দানশিন; হিন্দু ব্রাহ্মণের বিধবাপত্নীর সমস্ত আচার-বিচার মেনে চলা আবহমান এক ভারতীয় নারীর সাক্ষাৎ প্রতিমূর্তি। কিন্তু তখন আর নিছক সেইটুকুতেই আবদ্ধ নন তিনি। তখনও-পর্যন্ত ভবিষ্যতের গর্ভেই জারিত-ভাবিত সঙ্ঘের তিনি তখন ক্রমশ এক নিয়ন্তা হয়ে উঠছেন। বহির্বিশ্বে তাঁকে কেউ চেনে না, জানে না। বিবেকানন্দ এবং তাঁর গুরুভাইদল এই গুরুভার বহন করে চলেছিলেন। কিন্তু ঝড়ের আড়াল থেকে প্রদীপ বাঁচিয়ে রাখার কঠিনতম কাজটি মা-ও করে চলেছিলেন বড় নীরবে, নিভৃতে, নিজের মতো করে।


কী ভাবে? তার অসংখ্য উদাহরণ। আপাতত, মাত্র দু'টি ঘটনায় বুঝে নেওয়া যাক, শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্যদল ও মঠের উপর কী অমোঘ নিয়ন্ত্রণই-না ছিল মা সারদা হাতে। 


কলকাতায় যখন প্লেগ হল, মানুষের সেবাকার্যের প্রয়োজনে সদ্য-প্রতিষ্ঠিত মঠ, মানে, মঠের জমি-বাড়ি-সম্পত্তি সব নির্দ্বিধায় বিক্রি করে ফেলার কথা ঘোষণা করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ! বহুদিনের শ্রমে-সাধনায়-আত্মত্যাগে প্রায় বুকের রক্ত দিয়ে যে-মঠ সবে জন্ম নিল, প্রতিষ্ঠা-আবহেই তার বিসর্জন? স্বামীজির গুরুভাই এবং অন্যান্য ভক্তদের মন বেদনায় ভারাক্রান্ত। তাঁরা স্বামীজির উপর কোনও কথাও বলতে পারেন না। কিন্তু ঘটনাটা কানে যাওয়া মাত্র এক কথায় ব্যাপারটা রুখে দিলেন মা। দ্বিরুক্তি মাত্র না করে অনুগত সন্তানের মতোই স্বামীজি মেনেও নিলেন মায়ের সেই সিদ্ধান্ত। সেবাকাজে অবশ্য ব্যাঘাত ঘটল না।


আর একবার। মঠে প্রথম দুর্গাপুজো হবে। আশ্রমিক তথা ভক্তদল সকলের মনেই আনন্দের স্রোত। স্বামীজি একেবারে শাস্ত্রমতে পুজো করতে গিয়ে নবমীতে বলিদানের পরিকল্পনাও করে ফেললেন। অনেকেরই একটু কিন্তু-কিন্তু লাগছিল, তবে স্বামীজির মুখের উপর কথা বলার সাহস দেখালেন না কেউ। সেবারও মায়ের কানে এ কথা যেতে তিনি এককথায় মঠের দুর্গাপুজোয় বলির সিদ্ধান্ত নাকচ করে দিলেন। আর সেবারও স্বামীজি নীরবেই মেনে নিলেন।


এহেন মা রামকৃষ্ণসঙ্ঘের সর্বময়ী নিয়ন্তা; অথচ, এক চির-নিভৃতির কুয়াশায় আবৃত মাতৃমূর্তি, যিনি অপরিসীম কষ্ট ও যন্ত্রণার মধ্যে নিজের এবং তাঁর পার্ষদবর্গের জীবনকে চালিত করে নিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর ক্রমবর্ধমান ছায়া, যা গভীর আধ্যাত্মিকতায় মথিত, তা এক নির্ভুল দিশারি হয়ে থেকে যায় সঙ্ঘের সামনে, শ্রীরামকৃষ্ণের সাক্ষাৎশিষ্যের সামনে, অনাগত সন্ন্যাসীবর্গের সামনে, অগণিত ভক্তকুলের সামনে। সঙ্ঘজননী মা সারদা যেন এক শাশ্বত নিভৃতির অমর কাব্য। তাঁর যাপন ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার ইতিহাসে এক বিরল পর্ব।       


(Zee 24 Ghanta App : দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)


আরও পড়ুন: কৌতুকে, কান্নায়, তির্যকতায় অমর এই মানুষটি বৃষ্টিতে হাঁটতে ভালোবাসতেন!