কৌতুকে, কান্নায়, তির্যকতায় অমর এই মানুষটি বৃষ্টিতে হাঁটতে ভালোবাসতেন!
তাঁর এই চির-উপস্থিতিই কৌতুকশিল্পকে যুগে যুগে বাঁচিয়ে রেখেছে।
সৌমিত্র সেন
কথা নেই। থাকবে কী ভাবে? নির্বাক চলচ্চিত্র তো! কিন্তু কথা থাকা না-থাকায় কিছু যায় আসে না। কেননা, যা বলবার, তা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঞ্চালনে, ফেসিয়্যাল এক্সপ্রেশনেই সম্পূর্ণ প্রকাশিত হয়ে পড়ছে। দর্শক হেসে লুটিয়ে পড়ছে। অথবা হাসির মোড়কেই তার বুকে জাগছে মোচড়। হাসি-হাসি আবার হাসি-কান্না।
হাসিতে কান্না?
নয়তো কী? না হলে স্বয়ং ওই শিল্পের স্রষ্টা কেন বলবেন-- 'আমি বৃষ্টিতে হাঁটতে ভালোবাসি, কারণ তখন কেউ আমার কান্না দেখতে পায় না।' এই উক্তিটি তাঁর, যিনি নিজের চোখের জল আড়াল করে শুধু মূকাভিনয়ের মাধ্যমে অগণিত মানুষের মুখে হাসি জুগিয়েছেন। তিনি চার্লি চ্যাপলিন।
বিশ্ব ফিল্ম সংস্কৃতির এক মরমি ঐতিহ্যের ধারক বাহক চার্লি। বিশ্ব চলচ্চিত্রে তাঁর বিপুল অবদান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লাইব্রেরি অব কংগ্রেস চার্লি চ্যাপলিনের ছ'টি ছবিকে জাতীয় চলচ্চিত্র রেজিস্ট্রিতে সংরক্ষণ করেছে। এগুলি হল-- 'দ্য ইমিগ্র্যান্ট', 'দ্য কিড', 'দ্য গোল্ড রাশ', 'সিটি লাইটস', 'মডার্ন টাইমস' ও 'দ্য গ্রেট ডিরেক্টর'। এ ছাড়াও চ্যাপলিনের উল্লেখযোগ্য ছবিগুলির মধ্যে রয়েছে-- মেকিং অব লিভিং (১৯১৪), দ্য ট্রাম্প (১৯১৪), কিড অটো রেসেস অ্যাট ভেনিস (১৯১৫), এ ডগস লাইফ (১৯১৭), শোল্ডার আর্মস (১৯১৮), দ্য সার্কাস (১৯২৬), লাইম লাইট (১৯৫২), এ কিং অব নিউইয়র্ক (১৯৫৭) প্রভৃতি।
তথ্য দিয়ে চার্লিকে ধরা যায় না। তিনি একমুঠো হাসি অথবা অগাধ কান্না। চার্লি সবার আগে একজন সার্থক অভিনেতা। তবে তারও আগে তাঁকে দাগানো হয় 'কমেডিয়ান' তকমায়। কমেডি সাধারণত দু'ধরনের। 'স্ট্যান্ড-আপ কমেডি' এবং 'স্ল্যাপস্টিক্স কমেডি'।
স্ট্যান্ড-আপ কমেডিতে কোনও অনুষ্ঠানে কৌতুক অভিনেতা দর্শকদের হাসান। স্ট্যান্ড আপ কমেডি প্রকৃতিগত ভাবে এক ধরনের প্রহসন। এক্ষেত্রে কমেডিয়ান উপস্থিত জনতার সামনে কোনও বিষয়কে হাস্যরসাত্মক ভঙ্গিমায় উপস্থাপন করেন। উন্মুক্ত মঞ্চে, থিয়েটারে, কোনও খোলা জায়গায় বা সমবেত জনতার সামনে প্রদর্শিত হতে পারে স্ট্যান্ড-আপ কমেডি। এ-জাতীয় কমেডিতে কমেডিয়ান আদ্যন্ত দর্শকদের মনোরঞ্জনের চেষ্টা করেন। সেখানে থাকে তাঁর নিজস্ব বাচনভঙ্গি, অঙ্গভঙ্গি, স্বরের ওঠা-নামা। পারফরম্যান্সে বৈচিত্র্য আনার জন্য কেউ কেউ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রও ব্যবহার করেন।
স্ল্যাপ্সটিকস কমেডি এর চেয়ে ভিন্ন। এটা অনেক ক্ষেত্রেই ফিজিক্যাল কমেডির পর্যায়ে পড়ে। মানে, স্ল্যাপস্টিক্স কমেডিতে কথার চেয়ে অ্যাকশন-ই বেশি। এই ধরনের কৌতুকে অনেক সময় কথা আদপেই থাকে না। অ্যাকশনটাই এ ধরনের কমেডির এক ও একমাত্র মাধ্যম। এই কমেডি যিনি করেন তাঁর তুরুপের তাস দারুণ টাইমিং-জ্ঞান এবং নির্ভুল ফেসিয়্যাল এক্সপ্রেশন।
প্রকৃতিগত ভাবে চার্লি অবশ্যই 'স্ল্যাপ্সটিকস কমেডিয়ান'। কিন্তু তাঁর শিল্পসৃষ্টি দেখতে দেখতে কোথাও গিয়ে যেন মনে হয় 'স্ট্যান্ড-আপ কমেডি' ও 'স্ল্যাপ্সটিকস কমেডি'র এই তাত্ত্বিক বিভাজনটাকে আর খুব বড় করে দেখার বোধ হয় দরকার নেই। এখানে পারফরম্যান্সটাই আসল কথা। সেখানে চার্লি চ্যাপলিন আজও এক ও অদ্বিতীয়। বিশ্বের এমন খুব কম চলচ্চিত্র পরিচালক বা অভিনেতাকেই পাওয়া যাবে যিনি বা যাঁরা কখনও চার্লির কাজের দ্বারা অনুপ্রাণিত হননি।
আজ, ২৫ ডিসেম্বর যিশুর জন্মদিন, আর চার্লির মৃত্যুদিন। যিশু মানবত্রাতা। আর চার্লি? চার্লিও তো ঘুরপথে মানবত্রাতাই। নিপীড়িত দুঃখিত যন্ত্রণাকাতর মূক মানুষগুলির মুখে ভাষা জুগিয়েছেন তিনি। তাঁদের কষ্টটার একটি 'সেফটি ভালভ' যেন তিনি। কিংবা বলা যায়, সেই দুঃসহ রাগ ও কষ্টটাকে তিনি নিজের কাজের মধ্যে দিয়েই যেন 'ভেন্টিলেট' করেছেন। আর তাঁর এই চির-উপস্থিতিই কৌতুকশিল্পকে যুগে যুগে বাঁচিয়ে রেখেছে।
(Zee 24 Ghanta App : দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)
আরও পড়ুন: Christmas 2021: বড়দিনের উৎসব, শীতের গোয়ায় উষ্ণতা ছড়ালেন বাঙালি নায়িকা তুহিনা