নির্মল পাত্র: সিঙ্গুরে ‘খাসেরচক - চকগোবিন্দ সমবায় কৃষি উন্নয়ন সমিতি লিমিটেড’ এর বিরুদ্ধে আর্থিক তছরূপের অভিযোগ উঠল। অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরে সমবায় ব্যাংকে গিয়েও মিলছে না গ্রাহকদের জমানো টাকা। শুক্রবারও একাধিক গ্রাহক ব্যাংকে গিয়ে তাদের গচ্ছিত অর্থ ফেরত না পেয়ে ক্ষোভ উগরে দেন ব্যাংকের ম্যানেজার ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে। আর্থিক তছরূপের কথা স্বীকার করে সমবায় পরিচালন সমিতির সম্পাদকের দাবি তছরূপের সঙ্গে যুক্ত আছে ব্যাংকের ম্যানেজার ও ক্যাশিয়ার। তছরূপের কথা স্বীকার করে সমবায়ের ম্যানেজারের দাবি, ‘আমি যুক্ত নই, যা কিছু করার ক্যাশিয়ার করেছে’। ‘লেনদেন সংক্রান্ত বিষয়ে দু’একটা ভুল হতে পারে, কিন্তু সব দায় আমার নয়’, জানিয়েছেন সমবায়ের ক্যাশিয়ার। আর সমবায়ের এই কেলেঙ্কারি নিয়ে তৃনমুল পরিচালিত পরিচালন সমিতিকে কটাক্ষ করেছে বামপন্থি কৃষক সংগঠনের সদস্যরা।


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

সিঙ্গুরের গোপালনগর গ্ৰাম পঞ্চায়েতের চকগোবিন্দ এলাকায় রয়েছে ‘খাসেরচক - চকগোবিন্দ সমবায় কৃষি উন্নয়ন সমিতি লিমিটেড’ এর প্রধান কার্যালয়। তার একটি শাখা রয়েছে সিঙ্গুরের খাসেরচক এলাকায়। এলাকার হাজার হাজার মানুষ সমবায়ের প্রতি আস্থা রেখে তাদের কষ্টার্জিত অর্থ জমা রেখেছেন। কিন্তু বিগত বেশ কিছুদিন ধরে সমবায় ব্যাংকটি গ্ৰাহকদের জমানো অর্থ ফেরত দিতে পারছে না বলে অভিযোগ। গ্ৰাহকরা ব্যাংকে এসে ফিরে যাচ্ছেন রোজ।


আরও পড়ুন: ডাইন অপবাদে মারধর, ঘরছাড়া অসহায় বৃদ্ধ দম্পতি!


বুধবার সারাদিন সমবায়ের প্রধান কার্যালয় ও শাখা কার্যালয়ে একাধিক মানুষ গিয়ে হয়রানির শিকার হন। সমবায় বন্ধ থাকায় ফিরে যেতে বাধ্য হন অনেক গ্ৰাহক। বৃহস্পতিবার প্রধান কার্যালয় সকালে খুলতেই কিছু গ্ৰাহক তাদের টাকা ফেরতের দাবিতে ভিড় জমান। কিন্তু জমানো টাকা না পেয়ে ক্ষোভ উগরে দেন গ্ৰাহকেরা। দীর্ঘদিন ধরে একের পর এক তারিখ সমবায় কর্তৃপক্ষ দিলেও সেই তারিখে কোনও টাকাই দিতে পারছে না সমবায় ব্যাংকটি। ফলে চরম সমস্যায়  পড়েছেন বহু গ্ৰাহক। তাদের জমানো টাকা কোথায় গেল তার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তারা।


সমবায় ব্যাংকের এক গ্রাহক মিঠু মালিক পরিচারিকার কাজ করে প্রায় ৩৪ হাজার টাকা জমিয়েছেন সমবায় ব্যাংকে। কিন্তু প্রায় দুমাস ধরে তিনি ব্যাংকে ঘুরছেন কোনও টাকা পাননি। তিনি জানান, ‘জিজ্ঞাসা করলেই খালি বলছে টাকা জোগাড় হচ্ছে না, বিভিন্ন জনকে টাকা দেওয়া হয়েছে তারা টাকা দিচ্ছে না। খালি বলছে বোর্ড জানে। নিজেরাই একে অপরকে দোষারোপ করছে টাকা নিয়েছে বলে’।


সমবায়ের গ্ৰাহক কৃষ্ণা দাস টাকা তুলতে এসে টাকা না পেয়ে ক্ষোভ উগরে দেন। তিনি বলেন, ‘গ্ৰামের মধ্যে সমবায় কাছে। ব্যাংক অনেক দূরে । প্রয়োজনে তাড়াতাড়ি পাবো বলে এখানে লক্ষাধিক টাকা রেখেছি। কিন্তু টাকা তুলতে  এসে দীর্ঘদিন ধরে ফিরে যাচ্ছি। কোনও টাকা দিচ্ছে না। বলছে টাকা নেই’।


স্থানীয় মা সারদা স্বর্নিভর গোষ্ঠীর সদস্য সীমা ভান্ডারীর দাবি, ‘আমাদের গোষ্ঠীর প্রায় ৮০ হাজার টাকা জমা আছে। কিন্তু সেই টাকা প্রয়োজনে পাচ্ছি না। তাই গোষ্ঠী বন্ধ করে টাকা তুলে নিতে চাই। কারন আমাদের কষ্টের টাকা যদি প্রয়োজনে না পাই তাহলে রেখে লাভ কি?’


কিন্তু কেন গ্ৰাহকেরা তাদের গচ্ছিত টাকা ফেরত পাচ্ছে না? কোথায় গেল মানুষের গচ্ছিত অর্থ ?


সমবায়ের পরিচালন সমিতির সম্পাদক অশোক ঘোষ গ্ৰাহক হয়রানীর কথা স্বীকার করে নিয়ে জানান, ‘এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর জানা গেল সমবায়ের হিসাব রক্ষক কৌশিক অধিকারী লক্ষ লক্ষ টাকা সংগ্ৰহ করে ব্যাংকে জমা দেয়নি। আর ম্যানেজার এই বোর্ডকে না জানিয়ে ১২ লক্ষ টাকা লোন নিয়েছে, এবং কৌশিক অধিকারী ১৯ লক্ষ টাকা লোন নিয়েছে। দুজনেই সিকিউরিটি অর্থ জমা রাখেনি। এটা জানার পরেই আমরা তাদের টাকা জমা দিতে বলেছি কিন্তু তারা কোনও টাকা জমা দেয় নি। এই তছরূপে আপাতত ৬৮লক্ষ ৮৯হাজার টাকার গরমিল পাওয়া গেছে। এবং এটা আরও বাড়তে পারে’।


ব্যাংকের ম্যানেজার সুখেন্দু দাস সমবায়ের টাকা তছরূপের ঘটনা স্বীকার করে নিয়েছেন। তার দাবি, ‘সমবায়ে তছরূপ হয়েছে। এবং অনেক লোন ওভারডিউ আছে। এখানকার ক্যাশিয়ার কৌশিক অধিকারী গ্ৰাহকদের থেকে টাকা নিয়ে গ্ৰাহকের খাতায় তুলেছে কিন্তু সেটা ক্যাশ কাউন্টারে জমা পড়েনি। অনেকেই ম্যানেজারকে দায়ী করছে কিন্তু সিস্টেমটা ম্যানুয়াল তাই আমার পক্ষে সব দেখা অসুবিধা হয়ে যায়’।


আরও পড়ুন: দেশের সেরা ধূপগুড়ি, সর্বোচ্চ ফ্লোরেন্স নাইটেঙ্গল পুরস্কার পাচ্ছে ঘরের মেয়ে!


তিনি আরও বলেন, ‘এখন পর্যন্ত হিসাবে আনুমানিক ১ কোটি টাকার গরমিল ধরা পড়েছে। বোর্ডের একটা নিজস্ব স্বনির্ভর গোষ্ঠী আছে। তারাও দীর্ঘদিন বুঝতে পারেনি যে তাদের টাকা জমা পড়েনি। কৌশিক অধিকারীকে সবাই বিশ্বাস করত, তিনি এইসব করেছেন। এবং তিনি একাধিক ব্যক্তির নামে লোন বার করেও টাকা আত্মসাৎ করেছেন। নিয়ম অনুযায়ী সবাই দায়ী। আমি ও দায়ী কারন আমি বিষয়টা ধরতে পারিনি তাই আমি দায়ী। তবে, ঘটনাটি ইতিমধ্যেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়েছি’।


অন্যদিকে, সমবায়ের ক্যাশিয়ার কৌশিক অধিকারী বলেন, ‘এই অভিযোগ নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। ওনারা বলছেন আমি এসব করেছি। কিন্তু এটা তদন্ত সাপেক্ষ। টাকা কোথায় গেল সেটা আমি বলতে পারব না। তবে দু’একটা লেনদেনে আমার ভুল হয়েছে কিন্তু সবটা আমি করিনি। আমি যদি সব করি তাহলে এতদিন ম্যানেজার, ডাইরেক্টর তারা কি করছিল? লোক টাকা পাচ্ছে না এটা ঠিক, কিন্তু তছরূপ হয়েছে কি না আমি বলতে পারবো না?’


সারা ভারত কৃষক সভার সিঙ্গুর থানা কমিটির সভাপতি সুকুমার সামন্ত অবশ্য ঘটনা নিয়ে তৃণমুল পরিচালিত পরিচালন সমিতির দিকে অভিযোগ করেছেন। তার বক্ত্যব, ‘এলাকার প্রচুর মানুষ কেন টাকা ফেরত পাচ্ছে না সেই নিয়ে সমবায়ের পরিচালন সমিতি কোনও সদুত্তর দিতে পারছে না। পরিস্থিতি যেখানে গিয়েছে তাতে দূর্নীতি আছে বলেই মনে হয়। না হলে আর এই ঘটনা ঘটবে কেন। এর জন্য দায়ী হচ্ছে পরিচালন সমিতি এবং তার সঙ্গে সমবায়ের কর্মচারীর একটা অংশ। অবিলম্বে সমস্ত গ্ৰাহকের টাকা ফেরাতে সদর্থক ব্যবস্থা গ্ৰহন করা উচিত’।


সিঙ্গুরের খাসেরচক - চকগোবিন্দ সমবায় কৃষি উন্নয়ন সমিতি লিমিটেডের তৃণমুল পরিচালিত পরিচালন সমিতির সম্পাদক অশোক ঘোষ পাল্টা জানিয়েছেন, ‘সমবায়ের কর্মচারীরা যদি দূর্নীতি করে থাকে তাহলে দূর্নীতি হয়েছে। কিন্তু এই ঘটনার সঙ্গে বোর্ডের কেউ যুক্ত নয়। আমরা বিষয়টা জানার পরেই বার বার ম্যানেজারের থেকে কৈফিয়ত তলব করেছি’।


(Zee 24 Ghanta App দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)