সৌমিত্র সেন


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

কালো রাত পোহানোর পরের প্রহরে/ শিউলি শৈশবে/ 'পাখী সব করে রব' ব'লে মদনমোহন
তর্কালঙ্কার কী ধীরোদাত্ত স্বরে প্রত্যহ দিতেন ডাক।/ তুমি আর আমি, অবিচ্ছিন্ন, পরস্পর মমতায় লীন,
ঘুরেছি কাননে তাঁর নেচে নেচে,/ যেখানে কুসুমকলি সবই ফোটে, /জোটে অলি ঋতুর সঙ্কেতে।'


কবির চেতনায় ধরা দেয় সেই হাহাকার বারবার। ভাষা নিয়ে কবির মনেই তো সব চেয়ে বেশি সংবেদন। সৃষ্টিশীল মানুষ, চিন্তাশীল মানুষ, দার্শনিক মানুষ নিজের ভাষা-সংস্কৃতি নিয়ে বেশি জাগ্রত থাকেন, এটা স্বাভাবিক। তাঁদের স্বপ্নে-কল্পনায়-বোধে ফিরে ফিরে ধরা দেয় শিউলিশৈশব, পাখি-সব-করে-রব, কাননের কুসুমকলি, ঋতুসঙ্কেত।


কিন্তু আশ্চর্যের হল, বাংলা ভাষা আন্দোলন জেগে উঠল একেবারে সাধারণ মানুষের অতি সাধারণ আলো-ছায়া-রোদের দৈনন্দিন থেকে। সেই আন্দোলনে পুলিসের গুলিতে নিহত হলেন রফিক, সালাম, বরকত, আব্দুল জব্বার-- এই চার তরুণ। ভাষার জন্য বিরল অ-ভূতপূর্ব সেই আত্মবলিদানকে স্মরণ করেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের শুরু তারও অনেক বছর পরে।


আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস (International Mother Language Day)এখন পালিত হয় সারা পৃথিবী জুড়ে। ১৯৯৯ সালের নভেম্বরে ইউনেস্কো (unesco) এই '২১ ফেব্রুয়ারি' দিনটিকে স্বীকৃতি দেওয়ার, শ্রদ্ধা জানানোর সিদ্ধান্ত নেয়। তার পর থেকে প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি দুনিয়া জুড়ে পালিত হয়ে আসছে। 


আরও পড়ুন: এই প্রথম মানুষের শরীরে হানা দিল Bird Flu ভাইরাস, সাতজন আইসোলেশনে


কিন্তু কেন ২১ ফেব্রুয়ারি?


১৯৫২ সালে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক ছিলেন বাঙালি। সেখানকার মোট নাগরিকের প্রায় ৫৪ শতাংশ। শুধুমাত্র উর্দুকেই জাতীয় ভাষা হিসেবে ঘোষণার প্রতিবাদে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮) বাঙালি ছাত্রেরা সেখানে সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। সকাল ন'টায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জড়ো হতে শুরু করেন তাঁরা। সশস্ত্র পুলিস বেষ্টিত ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। একটু বেলা গড়ালে ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ দেখান। উপাচার্য ছাত্রদের এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বলেন। সেই সময়ে ১৪৪ ধারা লঙ্ঘনের জন্য পুলিস কয়েকজন ছাত্রকে গ্রেফতার করে। এই খবর পেয়ে আর এক দল বিক্ষুব্ধ ছাত্র পূর্ববাংলা গণপরিষদ অবরোধ করে। কিছু ছাত্র বিল্ডিংয়ের মধ্যে ঢোকার চেষ্টা করলে পুলিস গুলি চালায়। আর তাতেই নিহত হন সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার।


এই গ্রহে ভাষাগত অধিকারের জন্য রক্ত ঝরল। এই গ্রহে ভাষার জন্য প্রাণ দিল ক'টি তাজা প্রাণ। এই প্রথম ভাষার বেদিতে এত তাপ, এত আগুন এত দীপ্তি এত সংকল্প ফুটে উঠল।


সেই রক্তঝরা ভাষা-দিনই এর পর থেকে প্রতিদিন বাংলা ভাষা-সমাজ-সংস্কৃতির নিকোনো উঠানে রোদ হয়ে ঝরে পড়েছে। সেই আবেগ ও ক্রোধ তার পর থেকেই 'নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জ্বলজ্বলে পতাকা উড়িয়ে' নিয়ত জেগে থেকেছে আমাদের সত্তায়। সেই ত্যাগ ও সাহসই ক্রমে বয়েসী বটের  ঝিলিমিলি পাতার ছায়া বিছিয়ে দিয়েছে আমাদের ভাষার গায়ে। তার পর থেকে এই দিনটি আমাদের অলঙ্কার, আমাদের অহঙ্কার, আমাদের গৌরব, আমাদের সৌরভ।


আরও পড়ুন: জলবায়ু নিয়ে কথা বলতে হবে আগে ভাবিনি, বিল গেটস