আমাদের ক্রীড়াদেবতা কে?

Updated By: Feb 18, 2016, 04:53 PM IST
আমাদের ক্রীড়াদেবতা কে?

স্বরূপ দত্ত

সদ্য সরস্বতী পুজো চলে গেল। ঠাকুরটা রাখা হল বইয়ের আর কম্পিউটার টেবলটার এক পাশে। গত দুদিন বাড়ি ফিরে টেবলের উপর ঠাকুরটার দিকে তাকালে মনটা বেশ ভালো হয়ে যাচ্ছে। মা সরস্বতীর সঙ্গে যে সেই ছেলেবেলার সম্পর্ক। কুল পাকার থেকেও আমার প্রথম 'পেকে' যাওয়া তো ওই সরস্বতী পুজোর আগে রাতেই। সেই প্রথম বাড়ির বাইরে রাত জাগা। প্রথম সিগারেট, প্রথম অনেক কিছুই শুরু হয়েছিল মা সরস্বতীর আশীর্বাদ নিয়েই। ঠাকুরটা তাই রোজ রাতে গিয়ে দেখাটাও অভ্যেস হয়ে গিয়েছে গত কয়েকটা দিন।

কিন্তু সরস্বতী ঠাকুরকে পড়ার টেবলে থাকতে দেখে একটা জিনিস গত তিন-চার দিন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। তা হলো, মানুষ হিসেবে সেই ছেলেবেলা থেকেই বড় খেলাধুলো পাগল। জ্ঞান যবে থেকে হয়েছে, তারপর থেকে জীবনের অনেক কিছুই এসেছে, চলে গিয়েছে। কিন্তু খেলার সঙ্গে নাড়ীর টান বড়। সেই নাড়ী কাটার কোনও ডাক্তার অন্তত আমার জীবনে আসেনি। তা সেদিন সরস্বতী ঠাকুর দেখতে দেখতেই বাড়ির টিভিতে খেলা দেখতে দেখতে মাথায় এলো কথাটা। তা হলো, এই যে এত দেব-দেবী রয়েছেন আমাদের ধর্মে, তাতে খেলাধুলোর ঠাকুর কে?

না, অনেক ভেবেও নিজে এর উত্তর পেলাম না। এরপর একটু বেশি বয়সের লোকেদের জিজ্ঞেস করা শুরু করলাম, আচ্ছা আমাদের 'ক্রীড়াদেবতা' কে বলতে পারেন? ব্যাপারটা দাঁড়ালো, সেই অবাক জলপানের মতোই। অবাক হয়ে, অবাক করা সব কথা শুনে ফেললাম বড়দের থেকে। কিন্তু কেউই পথ দেখাতে পারলেন না! জানতে পারলাম না, কে আমাদের ক্রীড়াদেবতা! বিদ্যার দেবী সরস্বতী ঠাকুর। জলের দেবতা বরুণদেবতা। লক্ষ্মী ঠাকুর অর্থের। গনেশ ঠাকুর ব্যবসার। কুবের ধনের ঠাকুর, এরকমই ৩৩ কোটি দেবতা রয়েছে হিন্দু ধর্মে। কিন্তু একজনও ক্রীড়াদেবতা নেই!

ইন্টারেনেটে সার্চ করা শুরু করলাম। অন্যান্য ধর্মেও খোঁজ করে দেখলাম। কিন্তু পেলাম না, এমন কোনও ঠাকুরকে, যাঁকে প্রণাম করে খেলতে নামবেন কোনও ক্রীড়াবিদ! আশ্চর্য লাগলো এটা ভেবেই যে, রাজ্যে, দেশে, সব জায়গাতেই রয়েছে ক্রীড়ামন্ত্রী। অথচ, নেই ক্রীড়াদেবতা! ঠিক কতটা অবহেলিত 'স্পোর্টস'? যে, সেটা সামলানোর জন্য কোনও দেবতার প্রয়োজন নেই? আর মন্ত্রীত্ব? সেটা অবশ্য আছে। কিন্তু কেন আছে, কী জন্য আছে, থেকে কী ঘণ্টা কাজে লাগছে, কেউ জানে না। দেশের খেলাধুলোর ইতিহাসে অসম কতটা কুলীন, আমার অন্তত জানা নেই। অথচ, সেই রাজ্যের মানুষ দেশের ক্রীড়ামন্ত্রীর গদি পর্যন্ত দিব্যি পৌঁছে গেলেন! অসমকেই যেখানে ক্রীড়াক্ষেত্রে হাত ধরে টেনে তোলার কথা। সেখানে অসমেরই মানুষ সর্বানন্দ সোনোয়াল নাকি, গোটা দেশের ক্রীড়ায় উন্নতি করবেন! বলিহারি বিজ্ঞান রয়েছে এই যুক্তির পিছনে?

গ্রিকরা তো সবেতেই চিরকাল অনেক এগিয়ে। অন্তত পৌরাণিক পরিবেশে। তাই খোঁজ করা শুরু করলাম গ্রিক পুরাণ নিয়েও। ভাবলাম, অলিম্পিকটাও তো ওদের সৃষ্টি, তাহলে নিশ্চয়ই কোনও একজন দেবতা থাকবে গ্রিকদের, যিনি অন্তত ক্রীড়াদেবতা হিসেবে স্বীকৃত। এবং পেয়ে গেলাম নামও। হার্মেস। তিনিই নাকি গ্রিকদের ক্রীড়াদেবতা। এই হার্মেস ছিলেন দেবতা জিউসের পুত্র। কিন্তু হার্মেসের সম্পর্কে আরও বেশি জানতে গিয়ে দেখলাম, সময় নষ্ট। কারণ, তিনিও আসলে ক্রীড়াদেবতা নন। ওই অনেক সময় ক্রীড়া ও পরিবহন দফতর বা ক্রীড়া ও যুবকল্যান দফতর বলে ভিড়িয়ে দেওয়া হয় না? ঠিক তেমনই হার্মেসেরও হাতে ছিল অনেকগুলো দফতর। তিনি অনেক কিছুর দেবতা হতে পারেন। কিন্তু ক্রীড়াদেবতা এমনটা বলা যাবে না।

অবশেষে এই কারণে, অন্তত একটা যুক্তি মনের মধ্যে পরিষ্কার হল। হিন্দু ধর্মে ৩৩ কোটি দেবতা রয়েছেন। তাঁদের কেউ একা 'স্পোর্টস' সামলান না। তাহলে আর ১২০ কোটির দেশের খেলাধুলো এগোবে কীভাবে!অলিম্পিকে ১০০ বছর পর একটা ব্যক্তিগত সোনা পেয়ে আমরা লাফাবো না তো কে লাফাবে! বাকি অনেক ধর্মতেই তো আবার ঈশ্বর একজন। GOD তো সবকিছুরই। আল্লাও তো সবকিছুর। ঈশ্বরও তো সবকিছুর। আর সবাই তো এক। সব অঙ্ক মানলাম। বুঝলাম। কিন্তু নিজের মনের আক্ষেপটা গেল না। কেন একজন ক্রীড়াদেবতা থাকবেন না! যদি থেকেও থাকেন, তাহলে কেন তাঁর কথা আমাদের কেউ জানাবে না!

যে গান গায়, সে তাঁর গানের ঘরে দিব্যি সরস্বতী ঠাকুর রাখবে। যে নৃত্যে পারদর্শী, সে দিব্যি তাঁর ঘরে নটরাজের মুর্তি রাখতে পারবে। যে ব্যবসা করে, সে দিব্যি তাঁর ঘরে লক্ষ্মী-গনেশ রাখতে পারবে, জঙ্গলের মানুষগুলোও বনদেবীর আরাধনা করতে পারবে। কিন্তু খেলাধুলোর জন্য একজন ঠাকুরও থাকবে না! এত বঞ্চনা খেলাধুলোয় কেন? ক্রীড়া এত বিনোদন, সেই শুরুর দিনগুলো থেকে। কিন্তু সেটার নেই কোনও দেবতা!

যদি থাকতো, তাহলে সচিন সেঞ্চুরির পর হয়তো বাবাকে খোঁজার সঙ্গে সঙ্গে ক্রীড়াদেবতাকেও একবার মাথা উঁচিয়ে দেখে নিতেন। ফুটবলারকে বুকে ক্রস এঁকে অথবা নমস্কার করে মাঠে নামতে হত না। ধরে নিলাম, কুস্তিগির সুশীল কুমার আখড়ায় নামার আগে, পবনপুত্র হনুমানের নাম স্মরণ করেন। কিন্তু বিশ্বনাথন আনন্দ তো আর দাবার বোর্ডে বসার আগে পবনপুত্র হনুমানের নাম নেবেন না। খেলায় যে বুদ্ধি-শক্তি সবেরই দরকার হয়।

সেই ছেলেবেলা থেকে বাবা বলত, যে বিষয়ে যে কাঁচা, সে শুধু সেই বিষয়টা থেকে পালায়। কেউ অঙ্কে দুর্বল হলে, অঙ্কের ধারে কাছে যায় না। কেন ক্রীড়াদেবতা নেই সারা বিশ্বেই, তাঁর উত্তর বোধহয় এটাই। আমাদেরকে অনেক 'বিজ্ঞ'রা বোঝান, খেলা পিছনের সারির। তাই সেটা সংবাদপত্রের শেষ পাতায়। টেলিভিশনের খবরের একেবারে শেষে এক ঝলকে। খেলা মানেই বঞ্চনার প্রতিশব্দ। আরে ধূর। আসল কারণ হল, খেলাটা (যেকোনও) এতটাই কঠিন যে, চিরকাল সবাই এটাকে এড়িয়ে চলেছে। স্বয়ং দেবতারও। প্রথম সারির জিনিসটা পিছনে চলে গিয়েছে নিজের ব্যর্থতায় নয়। চিরকালই অন্যের অপদার্থতায়। একদমই নিজের যুক্তি। কেউ অন্য কিছু ভাবেবন না প্লিজ। বরং, আমায় ক্রীড়াদেবতা সম্পর্কে জানালে, আমার অজ্ঞতা দূর হবে। বরং, এই সুযোগে সবাই জানতে পারবেন, কে আমাদের ক্রীড়াদেবতা। কার নাম করে খেলার মাঠের প্রতিটা খেলায় তাঁর নাম করলে, সেই খেলোয়াড় এক বুক ভরসা পাবেন। আর জয়ের পর বলতে পারবেন, 'অমুক' ক্রীড়াদেবতাকে ধন্যবাদ!

 

.