গয়নার বাক্স গেল মৌসুমীর সিন্দুকে

এমন পিসিমা যেন নিজের বাড়ি ছাড়া আর সকলের বাড়িতে থাকে, তাহলে পুরুষদের খানিক সুবিধে হয়। এইরকমই একটা রসিকতা করেছিলেন একালের জনপ্রিয়তম অভিনেতা শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, ছবি শেষ হওয়ার পর। সত্যি বলতে কি, গয়নার বাক্সে প্রাপ্তি অনেক কিছুই, কিন্তু সেরা প্রাপ্তি অবশ্যই পিসিমা। যিনি ছায়ার মতো আসেন, ধোঁয়া হয়ে টুপ করে দেহ ধরে নেন, বাড়ির বউকে নিত্যনতুন এমন পরামর্শ দেন যে একালের স্মার্ট দর্শকও জিভ কেটে কানে আঙুল দেবেন!

Updated By: Apr 15, 2013, 05:54 PM IST

শর্মিলা মাইতি
ছবির নাম- গয়নার বাক্স
রেটিং- ****
এমন পিসিমা যেন নিজের বাড়ি ছাড়া আর সকলের বাড়িতে থাকে, তাহলে পুরুষদের খানিক সুবিধে হয়। এইরকমই একটা রসিকতা করেছিলেন একালের জনপ্রিয়তম অভিনেতা শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, ছবি শেষ হওয়ার পর। সত্যি বলতে কি, গয়নার বাক্সে প্রাপ্তি অনেক কিছুই, কিন্তু সেরা প্রাপ্তি অবশ্যই পিসিমা। যিনি ছায়ার মতো আসেন, ধোঁয়া হয়ে টুপ করে দেহ ধরে নেন, বাড়ির বউকে নিত্যনতুন এমন পরামর্শ দেন যে একালের স্মার্ট দর্শকও জিভ কেটে কানে আঙুল দেবেন!

তবু গয়নার বাক্স অপর্ণা সেনের সই-করা ছবি। একান্ত নিজস্ব। ইতি মৃণালিনী, দ্য জাপানিজ ওয়াইফ ছবির শেষে কবিতায় পারাপার যেমন দেখা যায়, এছবিতেও আছে তেমনই। সব কথা বলার শেষে কবিতা-লেখা কাগজের ভেলায় ভাসিয়ে দিলেন দর্শককে। মনে রেখে দিলেন সুখস্মৃতি। ভূত হয়ে থাকা, মজাদার পিসিমা সত্যিই আমাদের মনের ঘরে পার্মানেন্ট জায়গা করে নিলেন।
প্রায় কুড়ি বছর আগে, ১৯৯৩ সালে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গয়নার বাক্স উপন্যাসের স্বত্ত্ব কিনেছিলেন পরিচালক অপর্ণা সেন। কিন্তু সে ছবি এতদিনেও করা হয়ে ওঠেনি। আলমারি-বন্দি হয়ে পড়েছিল এতকাল। যদিও অপর্ণা সেনের মনের সবচেয়ে কাছাকাছি উপন্যাসের একটি, প্রয়োজকদের রাজি করানো যায়নি এমন একটি গল্পে। তাই অপেক্ষা করতে হল, বাংলা ছবির মোড় ঘোরানোর হাল ফেরানোর দিন পর্যন্ত। রিলিজের পরেই বোঝা গেল, নিজের সৃষ্টির বিষয়ে কতখানি যত্নবান তিনি।শীর্ষেন্দুর উপন্যাস গয়নার বাক্স তিন প্রজন্মের নারীর গল্প। গয়নার বাক্স এক যোগসূত্র হিসেবে কাজ করে। এই তিন প্রজন্মের মাধ্যমেই তিনি দেখিয়েছিলেন পরাধীন ও স্বাধীন ভারতের ইতিহাসের ম্যাপ। যে ম্যাপটা নারীর একান্ত ব্যক্তিগত। নারীমনের সমাজবোধ, ভালবাসা আর রঙ্গরসের আখ্যান. বহুচর্চিত এই উপন্যাসের প্রতিটি পাতার নির্যাস নিয়েছেন পরিচালক। তার পর আপন মাধুরী মিশিয়ে লিখেছেন কাহিনি। সিনেমাটিক স্পেস এমন অনায়াসে তৈরি করে নিলেন যে, মূল উপন্যাসকে কোথাও খাটো করল না তাঁর ছবি।

আর মৌসুমী! জীবনের সেরা অভিনয় নিঃসন্দেহে। ওগো বধূ সুন্দরীর সেই উচ্ছল মেয়েটিকে কেউ কেউ চেষ্টা করলেই খুঁজে পেয়ে যাবেন। অনর্গল পূর্ববঙ্গীয় টানে কথা বলার আর্ট এমন রপ্ত করতে আগে কাউকে দেখা যায়নি। বারো বছরে বিধবা হওয়া নারীর অবদমিত কামনা-বাসনার এক হাস্যরসাত্মক প্রতিবিম্ব এই বুড়ি পিসিমা। দর্শক প্রায় সম্মোহিতের মতো তাঁর অঙ্গুলিহেলনে হাসেন-কাঁদেন।
গয়নার বাক্স এক প্রতিকূল সময়ে বিশ্বাস ও ভরসার আকর। নারীর অন্দরমহল। রুপোলি পর্দার সুপারহিট নায়িকা শ্রাবন্তীকে এই প্রথম দেখা গেল অন্য ধারার চরিত্রে। স্বল্প পরিসরে পরিমিত অভিনয়ে বুঝিয়ে দিলেন অনেক পরিচালককেই যে, তিনিও আসছেন! শুধু নাচে-গানে-অভিনয়ে-জমজমাট ছবির গণ্ডিতেই তাঁকে আর আটকানো যাবে না। নো-মেক আপ লুক নয়, একেবারেই নো-মেক আপে দেখতে পাবেন শ্রাবন্তীকে। তবে তাঁর চরিত্র আর একটু বেশি স্ক্রিনটাইম দাবি করে অবশ্যই। অন্যদিকে মায়ের ছবি মানেই কঙ্কণা সেনশর্মার সেরা পারফরম্যান্সের প্রত্যাশা বেড়ে যাওয়া। যৌবন আর বার্ধক্যের পার্থক্যটা নিখুঁতভাবে ধরা পড়ে তাঁর অভিনয়ে। পিসিমার সঙ্গে কথোপকথনের দৃশ্যও অসাধারণ। ড্রামের দুটো ছড়ির মতোই সমানতালে পড়েছে। তাই দর্শকের সিট থেকে হাততালির আওয়াজও এসেছে বারবার। মন ছুঁয়ে যাবে দেবজ্যোতি মিশ্রের সঙ্গীত সংযোজনা। বিশেষ করে কঙ্কণার সঙ্গে কবি কৌশিক সেনের মুখোমুখি হওয়ার দৃশ্যে বেদনাভরা সুরমূর্ছনা বড়ই গভীর। সৌমিকের ক্যামেরার কাজও অসাধারণ। তবে গয়নার বাক্স আর দর্শকের মনের মণিকোঠা, দুটোতেই যিনি জায়গা করে নিলেন তিনি মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়।

.