আলোর মধ্যে অন্য আলো
পার্থ প্রতিম চন্দ্র
স্থান-রিও ডি জেনিরো থেকে কিছুটা দূরের একটা জায়গা
তারিখ-৫ অগাস্ট। অলিম্পিকের উদ্বোধনের দিন
একেবারে শিকারী বিড়ালের মত অপেক্ষা। মারাকানা স্টেডিয়াম থেকে বেশ খানিকটা দূরে ও ওঁত পেতে আছে। কখন একটা কিছু এসে পড়বে, আর ও খপ করে ধরে ফেলবে। ও জানে মন থেকে কিছু চাইলে ঠিক পাওয়া যায়। ওদের ফাবালায় (আমরা যাকে বলি বস্তি) ইলেকট্রিক ঢোকেনি, বলে টিভিতে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দেখার উপায় নেই। তাই বোঝা যাচ্ছে না আরও কতক্ষণ ওকে এভাবে থাকতে হবে।
বাবা কিছুক্ষণ আগে নেশা করে মাকে খুব মেরেছে, বোনকে আছড়ে ফেলে দিয়েছে। ছুট্টে পালিয়ে আসার আগে ও দেখেছে ঘরে রক্তে ভেসে যাচ্ছে।
ও বসে আছে একটা ঘুটঘুটে অন্ধকার টিলার ওপর। এখান থেকে রিও শহরের অনেকটা দেখা যাচ্ছে। মাঝেমাঝেই দূর থেকে আলো এসে ওর মুখে এসে পড়ছে। এত আলো এ দুনিয়ায় থাকতে পারে তার কোনও আন্দাজেই ছিল না গ্যাব্রিয়েলের। ও তো জানে দুনিয়াটা আসলে অন্ধকারই, শুধু সূর্য আছে বলেই যা আলো আসে। কিন্তু এটা হচ্ছে কী! আচ্ছা শহরের ওদিকটা আসলে পৃথিবীতেই আছে তো নাকি? আলোগুলো মাঝে মাঝে ঠিকরে উঠছে বলেই বোঝা যাচ্ছে ও লুকিয়ে আছে। দূরে ওই পাথরের ওপরে ওদের ফাবালার ছেলেগুলো ড্রাগস নিচ্ছে। আচ্ছা ওরা কী আলোগুলো দেখতে পাচ্ছে না?
অলিম্পিক মানে কী সেটা ওরা কেউ জানে না। গ্যাব্রিয়েল বয়স বারো হবে। অলিম্পিক মানেটা যে কী সেটা ও অতটা ভাল না বুঝলেও এটা জানে এখানেই দুনিয়ার সব সেরা খেলোয়াড়রা এখানে খেলে। অলিম্পিক হল দুনিয়ার সবচেয়ে বড় মেলা। আর এবার সেটা প্রথমবার হচ্ছে তাদের দেশে। ক মাস আগে কিছু লোক এসে বলে গেছে অলিম্পিকের জন্যই নাকি ওদের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছে। অলিম্পিকের জন্য কোটি কোটি ডলার দেশের সরকার খরচ করছে, অথচ ওদের একটা ডলার কামাতেই কত কষ্ট। এ জন্য ওদের ফাবালার ছেলের গিয়ে মিটিং মিছিল করছে। এটায় ওর সমর্থন ছিল। আপত্তিটা তখন হল, যখন ওরা স্লোগান তুলল রিওতে অলিম্পিক হতে দেবো না। ওরা বলে কী! শহরে এত বড় একটা ঘটনা ঘটবে। বোল্ট, ফেল্পস, নেইমাররা খেলবে। আর ওরা খেলতে দেবে না! এরপর থেকে গ্যাব্রিয়েল ওদের দেখলেই ছুট্টে পালায়।
যাই হোক, এবার টেনশন হচ্ছে। এখনও তো কোনও কিছু ওর কাছে কোনও কিছু এল না! আসবে তো? আচ্ছা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে হয়টা কী! ওদের ফাবালার উল্টোদিকে যে বড় বাড়িটা আছে, সেই বাড়ির একটা ছেলে ওই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নাচতে গেছে। ওরা খুব বড়লোক। সে তো হবেই বড়লোকের ছেলেরা ছাড়া ওত পেল্লাই জায়গায় কেউ যেতে পারে নাকি। ওই ছেলেটাই ওকে বলেছে, ওখানে সবাই আসবে। ওর সবাইতে কাজ নেই। ওর দরকার শুধু ডেভিড রুসিদাকে। কেনিয়ার রুসিদার দৌড় ও প্রথম দেখেছিল টিভিতে। টিভির দোকানের সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ও টানা ৮০০মিটার দৌড় দেখেছিল। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা লোক বলেছিল, যে জিতল তার নাম রুসিদা, বাড়ি কেনিয়ায়। সেদিনে রুসিদার দৌড়টা কেমন যেন এলোমেলো করে দিয়েছিল গ্যাব্রিয়েলকে। পরে গ্যাব্রিয়েল রুসিদাকে নিয়ে জাবতে শুধু পেপার পড়ত। একটা পেপারে পরেছিল রুসিদার কথা। ওর জীবনের সঙ্গে অনেক মিল রুসিদার। রুসিদার মতই গ্যাব্রিয়েলকে দৌড়তে হয় বাঁচতে। আসলে ওর জীবনটাই এমন।
বাবা রাতে ফিরলে ছুটতে হয়। দিনে সাইরানে বাজলেই কাজে ছুটতে হয়। দুপুরে খাবার অল্প সময় পেলেই খিদেতে ছুটতে হয়। সন্ধ্যায় নেশা করার কথা শুনলেই ছুটে ছুটতে হয়। শুধু ছুটতেই জানে ও। নিয়ম করে রোজ ভোরে ওঠে ও দৌড় প্র্যাকটিশ করে। যখন খুব হাঁফিয়ে যায় রুসিদার কথা ভাবে। রুসিদা কখনও হাঁফায় না। ও বিশ্রাম নেবে না। ওর লক্ষ্য একটাই একদিন ও রুসিদার মত অলিম্পিকে দৌড়বে। সোনার মেডেল জিতবে। মেডেলটা রাখবে ওর বালিশের তলায়। আচ্ছা, রুসিদা এখন কী স্টেডিয়ামের মধ্যে কী করছে? নিশ্চই ওই আলোগুলোর দিকে তাকিয়ে। কী মিল দুজনের। রুসিদাও আলো দেখছে, সেও আলো দেখছে।
আরে হঠাত্ অন্ধকার হয়ে গেল কেন? গ্যাব্রিয়েল বুঝতে পারল ওই বদমাশ ছেলেগুলো এসেছে। আরে হ্যাঁ, ওই তো মারিওরাই। গ্যাব্রিয়েল বলল, কী হল তোমরা আবার এখানে কী করছো। ছেলেগুলোর মধ্যে থেকে সবচেয়ে লম্বা জন বলল, এটা তো আমরা তোকে জিজ্ঞাসা করছি। এত রাতে এখানে তোর কী কাজ! ব্যাটা সেদিন বললাম মিটিংয়ে আয়। তুই পালালি কেন! আমাদের সেদিন পুলিস খুব পেঁদিয়েছে। আর তুই ব্যাট!!! আজ সব শোধ নেবো। গ্যাব্রিয়েল বলল, সেটা পরে নিয়ো এখন আমি অলিম্পিকের আলো দেখছি। পাশের ছেলেটা বল, উউউউ অলিম্পিক মারানো হচ্ছে। ব্যাটা এদিকে আমরা খেতে পাই না। আর উনি অলিম্পিক। লজ্জা লাগে না! জানিস না, আমরা অলিম্পিক বয়কট করেছি! গ্যাব্রিয়েল বলল, বয়কট তোমরা করেছো আমি নই। এরপর আর কোনও কথা হল না। বছর ২৫ এর ছেলেগুলোর গ্যাং ছোট্ট গ্যাব্রিয়েলের ওর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারপর লাথি, ঘুসি, গাট্টা। তারপর লোহার রড দিয়ে পেটানো।
রোদ উঠেছে। গ্যাব্রিয়েল চোখ খুলল। ওর গায়ে এখন আর কোনও জোর নেই। পায়ের হাড় ভেঙেছে, মাথাটাও ফেটেছে বলে মনে হচ্ছে। যা, কাল রাতে ও যার অপেক্ষায় বসে ছিল সেটা এল না। ও চেয়েছিল দূর থেকে হাওয়ায় উড়ে এসে ওর কাছে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের কোনও একটা জিনিস এসে পড়ুক। তা সে প্যারাশ্যুট হোক বা যা কিছু। অনেক সময়ই তো এসব অনুষ্ঠানে প্যারাশ্যুট ছাড়ে। প্যারাশ্যুটটা ও বালিশের তলায় রেখে দিত। যেদিন ও অলিম্পিকে খেলতে নামবে সেদিন প্যারাশ্যুট বের করে দেখাবে। ওই প্যারাশ্যুটটা ওটা ওর জেদের প্রতীক। সে সব আর হল না। কোনওরকমে উঠতে গিয়ে আবার পড়ে গেল। এই জায়গাটায় লোক খুব একটা আসে না। মা কাজে বেরিয়ে গেছে। বোনও তাই। বাবা এখনও ঘুম থেকে ওঠেনি। ফাবালার লোকেরাও যে যার কাজে চলে গেছে। ওকে এখন শুয়ে থাকতে হবে যতক্ষণ না না। খুব খিদে পেয়ে গেছে। আবার চোখ বন্ধ করে দিল গ্যাব্রিয়েল।
বাহ...কী ভাল লাগছে। এখন ও দেখতে পাচ্ছে ও দৌড়চ্ছে। একে একে সবাই পিছিয়ে পড়ছে। সবাইকে এগিয়ে চলেছে। পাঁচটা রিং দেখে ও বুঝতে পারছে ও অলিম্পিকে দৌড়চ্ছে। কিন্তু কী খারাপ ভাগ্য! ফিনিসিং লাইনের ঠিক আগে ওকে কে ঠেলে ফেলে দিল।
হঠাত্ রুসিদা চিত্কার করল। গ্যাব্রিয়েল উঠে দাঁড়াও। তুমি খুব বেশি দূরে নেই। গ্যাব্রিয়েল উঠে দাঁড়াল। এই তো আর একটু। ঘুমটা ভেঙে গেল। গ্যাব্রিয়েল বুঝতে পারল সে জোর পেয়েছে। আরে কি জানো একটা জিনিস উড়ছে। কষ্ট হলেও ও উঠে দাঁড়াল। এক পা, দু পা, তিন পা..করে এগোত থাকল জিনিসটা নিতে। কিন্তু হাওয়াটা খুব জোরে দিচ্ছে। ও যত এগোচ্ছে জিনিসটা ততটাই এগিয়ে যাচ্ছে। গ্যাব্রিয়েলের জেদ চেপে গেলো...ঝাঁপিয়ে পড়ে ধরল জিনিসটাকে...
(১৯৯৬ সালে ক্রিকেট বিশ্বকাপের উদ্বোধন হয়েছিল আমাদের শহর ইডেন গার্ডেনে। আমাদের বাড়ি থেকে ইডেনের দূরত্ব ১২ কিমির মত। সেদিন আমিও গ্যাব্রিয়েলের মত আমাদের বাড়ির বসে ছিলাম একটা কিছু পাওয়ার আশায়। বাড়ির ছাদ থেকে পরদিন সকালে একটা প্যারাশ্যুট পেয়েছিলাম। জানি না সেটা ইডেনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেরই ছিল কি না। জানতে চাইও না। মিথ্যাটা নিয়েই বাঁচি না। প্যারাশ্যুট আমার ঘরে এখনও আছে। গ্যাব্রিয়েলকে আমি চিনি না। কিন্তু জানি এটা মিথ্যা নয়। তাই ব্লগটাকে লিখে ফেললাম। শুধু জানি না গ্যাব্রিয়েল শেষে কী জিনিসটা পেলো।)