ইমামদের বৃত্তি: আগুন নিয়ে খেলা

শুধু ইসলামের উপাসকদের প্রতি রাজ্য সরকারের এহেন কৃপা কেন? আরও যে ধর্মগুলি রয়েছে তাঁদের যাজকরা কী দোষ করলেন? খ্রিশ্চান পাদ্রীরা, শিখ গ্রন্থীরা, হিন্দু পুরোহিতরা, বৌদ্ধ ভিক্ষুরা কোন অপরাধে বঞ্চিত হবেন? সরকারি অনুগ্রহ পাওয়ার জন্য কি ধর্ম ও রাজনীতিকে যুক্ত করতে হবে? ধর্মীয় সমাবেশ থেকে রাজনীতির কথা বললে কি সরকারের হাত মুচড়ে টাকা আদায় করা যাবে? কী ভয়ঙ্কর সম্ভাবনার দরজা খুলে দেওয়া হল তা কি আদৌ বোঝার ক্ষমতা আছে ইমামদের সরকারি বৃত্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত যাঁরা নিলেন তাঁদের? নাকি জেনে বুঝেই আগুন নিয়ে খেলছেন তাঁরা? ধর্মকে রাজনীতির মাথায় চড়তে দেওয়ার প্রলয়ঙ্কর ফলাফল মাত্র দু দশক আগেই আমরা দেখেছি। অযোধ্যা কাণ্ড, বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং তার পরবর্তী ঘটনা তো আজকের রাজনীতিকদের ভুলে যাওয়ার কথা নয়। তার থেকেও যদি কেউ শিক্ষা না নেন তবে কোনও কিছু থেকেই তিনি আর শিক্ষা নেবেন বলে আশা করা বোধ হয় ঠিক হবে না।

Updated By: Apr 6, 2012, 07:25 PM IST

পশ্চিমবঙ্গ সরকার ঠিক করেছে সারা রাজ্যে ৩০ হাজার ইমামকে প্রতি মাসে আড়াই হাজার টাকা করে বৃত্তি দেবে। তার মানে মাসে সাড়ে সাত কোটি টাকা। বছরে ৯০ কোটি টাকা।

সরকারের টাকা আপনার আমার মতো সাধারণ মানুষেরই করের টাকা। আমাদের টাকা নিয়ে সরকার হঠাত্ করে বিশেষ একটি ধর্মের যাজকদের কেন পৃষ্ঠপোষকতা করছে? কারণটা সবাই জানেন, বোঝেন। কিন্তু মুখ ফুটে চট করে কেউ বলেন না। আমরা এখানে বলছি। মনে করা হয় যে মুসলিম ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষ আর্থিকভাবে এবং চিন্তা ভাবনায় সমাজের বৃহত্তর অংশের থেকে পিছিয়ে পড়া। মসজিদের ইমাম, মৌলবীদের কথায় সাধারণ মুসলিমরা প্রভাবিত হন, সম্ভবত সেই মতো ভোটও দেন। ইমামরা হাতে থাকলে মুসলিম ভোটও নিশ্চিন্তে পকেটে থাকে। অতএব দাও ইমামদের ঢালাও বৃত্তি।

কাজটা অনৈতিক। কাজটা বেআইনি। কাজটা দেশের সংবিধান বিরোধী। অতীতে দেখা গিয়েছে এই ধরনের কাজের জন্য দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার, আমাদের বহুত্ববাদী সমাজব্যবস্থার ভয়ঙ্কর ক্ষতি হয়েছে। রাষ্ট্রব্যবস্থার (polity) স্থায়ী কলঙ্কের দাগ রয়ে গিয়েছে। তাতে অবশ্য তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্বের কিছু যায় আসে না। ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান - কোনও কিছু থেকেই এঁরা কিছু শিক্ষা নেন এমন অপবাদ এঁদের কেউ কখনও দিতে পারবে না।

ভারতের সংবিধানে ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকদের মধ্যে ভেদাভেদ করা নিষিদ্ধ। রাজ্য সরকার আত্মঘাতী মূর্খামি করতেই পারে। রাজনীতির স্বার্থে তাঁদের বোধবুদ্ধি লোপ পেতে পারে। কিন্তু আশার কথা, দেশের সব প্রতিষ্ঠানই এখনও সেই রকম হয়ে যায়নি। হাইকোর্ট একাধিক ঘটনায় সম্প্রতিকালে বারবার সরকারের নাকে ঝামা ঘষেছে। সুস্থ বুদ্ধিসম্পন্ন ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ নিশ্চয় আশা করবেন যে অচিরেই ইমামদের সরকারি বৃত্তি দেওয়ার সিদ্ধান্তকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করা হবে। তবে রাজনৈতিক দল এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে মুখ খুলবে এমন সম্ভাবনা কম। ইমামদের স্বার্থ এবং সাধারণ মুসলিমদের স্বার্থ যে এক নয়, সে কথাটা জোর গলায় বলার মতো অকপটতা এবং সত্ সাহস আমাদের দেশে বিরল।

শুধু ইসলামের উপাসকদের প্রতি রাজ্য সরকারের এহেন কৃপা কেন? আরও যে ধর্মগুলি রয়েছে তাঁদের যাজকরা কী দোষ করলেন? খ্রিশ্চান পাদ্রীরা, শিখ গ্রন্থীরা, হিন্দু পুরোহিতরা, বৌদ্ধ ভিক্ষুরা কোন অপরাধে বঞ্চিত হবেন? সরকারি অনুগ্রহ পাওয়ার জন্য কি ধর্ম ও রাজনীতিকে যুক্ত করতে হবে? ধর্মীয় সমাবেশ থেকে রাজনীতির কথা বললে কি সরকারের হাত মুচড়ে টাকা আদায় করা যাবে? কী ভয়ঙ্কর সম্ভাবনার দরজা খুলে দেওয়া হল তা কি আদৌ বোঝার ক্ষমতা আছে ইমামদের সরকারি বৃত্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত যাঁরা নিলেন তাঁদের? নাকি জেনে বুঝেই আগুন নিয়ে খেলছেন তাঁরা? ধর্মকে রাজনীতির মাথায় চড়তে দেওয়ার প্রলয়ঙ্কর ফলাফল মাত্র দু দশক আগেই আমরা দেখেছি। অযোধ্যা কাণ্ড, বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং তার পরবর্তী ঘটনা তো আজকের রাজনীতিকদের ভুলে যাওয়ার কথা নয়। তার থেকেও যদি কেউ শিক্ষা না নেন তবে কোনও কিছু থেকেই তিনি আর শিক্ষা নেবেন বলে আশা করা বোধ হয় ঠিক হবে না।

সুদীপ্ত সেনগুপ্ত

Tags:
.