নির্বাক বরফির কথা শুনতে পেয়ে
ধুর, নায়ক কথাই বলতে পারে না! আইটেম নম্বর নেই। প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার মত সেক্স সাইরেনও এখানে কেমন যেন!
পার্থ প্রতিম চন্দ্র
ধুর, নায়ক কথাই বলতে পারে না! আইটেম নম্বর নেই। প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার মত সেক্স সাইরেনও এখানে কেমন যেন! এমন একটা ছবির জন্য পয়সা দিয়ে টিকিট কাটব? সিনেমা হলে ঢুকতে গিয়ে কতগুলো ছেলের মুখে এমন কথাই শুনলাম। তবে খেয়াল করলাম ওদেরই মধ্যে একজনের উত্সাহে অনেক তর্কের পর ওরা টিকিট কেটে হলে ঢুকল, বরফি দেখতে....
ছবির নাম: বরফি
পরিচালক/লেখক: অনুরাগ বসু
অভিনয়ে: রণবীর কপুর, প্রিয়াঙ্কা চোপড়া, এলিনা ডিক্রুজ, যীশু সেনগুপ্ত, রূপা গাঙ্গুলি, হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়, আশীষ বিদ্যার্থী
সঙ্গীত পরিচালনা: প্রীতম
সিনেম্যাটোগ্রাফার: রবি বর্মণ
রেটিং: ৮.৫/১০
কোনও কোনও সিনেমা থাকে যেটা ঠিক আর পাঁচটা ফিল্ম রিভিউয়ের মত লেখা যায় না। দারুণ গল্প এমন কথাও প্রযোজ্য নয়। নিঁখুত পরিচালনা এমন সার্টিফিকেটও দেওয়া যাবে না। তবু অভিনয় আর আবেগ সর্বস্ব এই সিনেমা দেখে বারবার মনে হবে "আরে এটা তো ঠিক সিনেমা নয়। বরং কোন একটা অতি সাধারণ মানুষের জীবনের কাহিনিকে ক্যানভাসে তুলে ধরা।" যার জীবনটা ঠিক ছবি আঁকার মত নয়। তাকে নিয়ে হাসব না কাঁদব সেটা ঠিক করা যায় না। সিনেমা দেখছি নাকি পদ্যের ছন্দে গা মেলাচ্ছি তাও বোঝা মুশকিল। দার্জিলিংয়ের অতি সাধারণ, অর্থ কষ্টে থাকা, জন্মগত মূক-বধির ছেলের জীবন কাহিনিকে রঙীন করে তোলার চেষ্টাতেই পরিচালক মরিয়া চেষ্টা করে গেছেন।
কাহিনি: কলকাতার এক সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ের দার্জিলিংয়ে ঘুরতে আসা। তারপর ফিল্মি কায়দায় নায়কের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। কিন্তু এ নায়ক বলিউডের বাকি হিরোদের থেকে আলাদা। ছেলেটির জন্মের পরপরই মা মারা যাওয়া আর মূক-বধির হয়ে যাওয়া। দাদী নাম দেয় “মার্ফি"। কিন্তু অনেক কষ্টে নিজের নাম বলতে গিয়ে উচ্চারণের ত্রুটিতে সে বলত বরফি। ছেলেটার স্বভাবটা ঠিক নদীর মত। চঞ্চল কিন্তু পবিত্র। সত্যিকারের বন্ধু যাচাই করতে সে নিজের জীবনকে বাজি রেখে চ্যালেঞ্জ ছোঁড়ে (সেই চ্যালেঞ্জের কায়দাটা ভারী সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন অনুরাগ)। সেই সর্বহারা বরফিই প্রেম নিবেদন করে বসল শ্রুতিকে। কিন্তু এরপরই গল্পের আসলটা শুরু...।
গল্পের বাকিটা না হয় না বলাই থাক, ওটুকুতেও ক্যানভাসের তুলির রঙ দেওয়া আছে।
ভাললাগা: গল্পে বরফি আর ঝিলমিলের প্রেম কাহিনিটা বেশ সুন্দরভাবে লেখা। বরফিকে সৌরভ শুক্লা অভিনীত পুলিসের ধরার দৃশ্যগুলো বেশ মজার। বরফির বয়স্ক অবস্থার গল্প আর ঝিলমিলের সঙ্গে তার দাদুর ভালবাসাটাও অদ্ভুত সুন্দর।
দুর্বলতা: গল্পে একসঙ্গে অনেক কিছু দেখানোর চেষ্টা হয়েছে। বরফির চরিত্র লেখার সময় চার্লি চ্যাপলিনের কথা খুব মনে পড়েছিল অনুরাগের। ঝিলমিল অপহরণ রহস্যটা যতটা ঘনীভূত করা হয়েছিল, তার সমাধানটা ততটাই সরল হয়েছে। শ্রুতির বরফির প্রতি প্রেমে পড়ে যাওয়াটাও বড় বেশি ফিল্মি কায়দায় হয়েছে। আর সিনেমার সবচেয়ে বড় খুঁত চোখে পড়েছে মেকআপে। ছবির মেকআপে রণবীরের বয়স যতটা বেড়েছে, পুলিস অফিসারের বয়স সে তুলনায় বাড়েনি। সর্বকালীন সেরা ছবির নাম লেখাতে চাওয়া সিনেমার ক্ষেত্রে এই খুঁতগুলো কিন্তু কোথাও একটা বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
অভিনয় : "কেয়া বাত কেয়া বাত"। বরফির চরিত্রে অভিনয় করে রণবীর কপুর অনেক পুরস্কার তো পাচ্ছেনই, সঙ্গে তাঁর ফিল্মি বংশে আরও একটা চিরস্মরণীয় চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পেয়ে গেলেন। রাজ কপুর যদি জোকার সেজে গর্ব করে থাকেন, ঋষি কপুর যদি ববির জন্য আলাদা জায়গা করে থাকেন, তাহলে জুনিয়র কপুর বলতেই পারেন আমার বরফি আছে। আসলে বরফিতে রণবীরের অভিনয় তো অসাধারণ বটেই, তবে তার চেয়েও অসাধারণ তিনি যিনি এই চরিত্রের জন্য রণবীরকে ভেবেছিলেন। সিনেমাতে রণবীর কথা না বলেও অনেক কিছু বলেছেন। এটাই তাঁর অভিনয়ের সবচাইতে বড় দিক। নিজে কথা বলতে অক্ষম। কিন্তু তাঁর মনটা অনেক বড়। শ্রুতিকে এমন কথা বলতে গিয়ে তাঁর অভিনয়টা চমত্কার। পুলিসের তাড়া খেয়ে পালানোর দৃশ্যে অভিনয়েও নিজের একটা স্টাইল রেখেছেন রণবীর। তবে এটাও ঠিক বয়স্ক অবস্থার বরফিকে আরও একটু প্রাণ হয়তো দিতে পারতেন।
প্রিয়ঙ্কা চোপড়া আবার কিছু কিছু দৃশ্যে সবাইকে ছাপিয়ে গেছেন। এই রকম একটা রোলে অভিনয় করার ঝুঁকি নিয়ে প্রিয়াঙ্কা কিন্তু বাকিদের কাছে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন। বেসরকারি ক্ষেত্রে তো বটেই, জাতীয় পুরস্কারও পেতেই পারেন প্রিয়াঙ্কা। ফ্যাশন-এর জন্য জাতীয় পুরস্কার এর আগেও পেয়েছেন। কিন্তু ফ্যাশনে তাঁর অভিনয়কে ওভার অ্যাকটিং বলে কটাক্ষ করা হয়েছিল। সেরকম কথা আর তাঁকে এই রোলের জন্য শুনতে হবে না। ছবিতে তাঁর সেরা দৃশ্য বাসের পিছনে বরফি বলে চিত্কার করে দৌড়নো। আর ছাদের ওপর থেকে বরফি বলে চিত্কার। দক্ষিণের সিনেমার পর বলিউডে পা রাখা এলিনা ডিক্রুজ অসাধারণ। তাঁর মুখে সিনেমার অনেক ঘটনা উঠে এসেছে। অভিনয়ের পাশাপাশি এলিনার গল্প বলার কায়দায়টাও দারুণ হয়েছে। অসাধারণ সুন্দরী না হলেও এমন চরিত্র পেলে এলিনা অনেককে মুশকিলে ফেলে দেবেন। আর হ্যাঁ, বঙ্গ ব্রিগেডের কথা বলতে হচ্ছেই। `পরিনীতা`ই হোক বা `কাহানি`, বলিউডের ছবিতে বাঙালি অভিনেতারা সুযোগ পেলেই জাস্ট ফাটিয়ে দেন। এই ছবিতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। রূপা গঙ্গোপাধ্যায়, হারাধান বন্দ্যোপাধায়রা তো বটেই, যীশু সেনগুপ্তও বেশ ভালই অভিনয় করেছেন। তবে শ্রুতির বর হিসাবে যীশুকে পরিচালক যতটা কঠিন দেখাতে চেয়েছিলেন
যীশু কিন্তু সে পথে না হেঁটে চরিত্রকে একটু অন্য শেড দিয়েছেন।
পরিচালনা: গল্পে অনেক বেশি সময়ের হেরফের ঘটানো হয়েছে। কখনও তিরিশ বছর পর, কখনও আবার ছয় বছর পর, কখনও বর্তমান। এমন সবভাবে গল্পে বতর্মান, অতীতকে ব্যবহার করায় সিনেমা কিছুটা জটিল হয়েছে। সামান্য মনোযোগ হারালেই সিনেমা থেকে হারিয়ে যাওয়ার ভয় থাকছে। ঝিলমিলকে উদ্ধারের পর রণবীর রাতে যখন গাড়ি নিয়ে জঙ্গলে হাজির হল সেই দৃশ্যটা একটু অন্যরকমভাবে দেখাতেই পারতেন অনুরাগ। সিনেমার বাকি সবটাতেই প্রায় ফুল মার্কস অনুরাগ। টয়ট্রেনের চারপাশ, লাইন, বৃদ্ধ ওক গাছের আড়াল, সাইকেল নিয়ে রণবীরের এমন বেশ কিছু শট নেওয়া হয়েছে যা শিক্ষানবীশ পরিচালকদের নোট করে রাখার মত। সঙ্গে দার্জিলিংকে ঠিক কতটা ভাল চেনেন পরিচালক তারও প্রমাণ রয়েছে প্রতি পদে। তাই বলতেই হচ্ছে ক্যামেরা, আর গল্প নিয়ে ক্যানভাসে যে ছবি আঁকতে চেয়েছেন অনুরাগ তা সফল। গ্যাংস্টার, লাইফ ইন আ মেট্রোর মত সিনেমা অনুরাগকে আকাশের দিকে তাকানোর স্বপ্ন শিখিয়েছিল। `কাইটস` আবার সেই স্বপ্নকে ভোকাট্টা করে দিয়েছিল। বরফি কিন্তু অনুরাগকে সাফল্যের টয়ট্রেনে তুলে দিল। যেখান থেকে সাফল্যের সুন্দর রোদ দেখতে পাবেন এই পরিচালক।
গান : প্রীতমের মিউজিক ছবিকে আলাদা মাত্রা দিয়েছে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক অসাধারণ। টাইটেল ট্র্যাকে বরফির জীবন কাহিনির অনেকটাই উঠে আসায় দর্শকদের প্রধান চরিত্রর সঙ্গে রিলেট করতে অনেক সুবিধা হয়েছে। আশিয়ানা গানটাও মনে রাখার মত। তবে বাকি গানগুলো হলে বসে সুন্দর শোনালেও পরে মনে থাকবে বলে মনে হয় না।
হল থেকে বেরিয়ে আসার সময় সেই ছোকরাদের সঙ্গে দেখা হল। ওদের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বুঝলাম ওদের মনেও সিনেমাটা ছুঁয়ে গেছে। তার চেয়েও অবাক করার কথা, ওদের মধ্যেই যার ইচ্ছায় ওই যুবকের দল সিনেমা হলে ঢুকেছিল সে কথা বলতে বা শুনতে পায় না। তবু এসেছিল ছবিটা অনুভব করতে। ওঁকে জিজ্ঞাসা করলাম কেমন লাগল! ওর ইশারাটা বুঝতে পারলাম না। শুধু চোখের জলটাই নজরে পড়ল। বরফির সার্থকতা বোধহয় বক্স অফিস, অস্কার মনোনয়ন ছাড়িয়ে এইখানেই।
(রিভিউটা এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু হচ্ছে না একটা খবরে। অনুরাগ বসুর এই ছবি টোকার দায়ে ধরা পড়েছে। কিকুজিরো(১৯৯৩), কোরিয়ান ছবি ওয়েসিস (২০০২), চ্যাপলিনের সিটি লাইটস (১৯৩১), মিস্টার বিনের হলিডে, জ্যাকি চানের প্রজেক্ট এ (১৯৮৩), কপ্স (১৯২২), দ্য নোটবুক (২০০৪), মিস্টার নো বডি (২০০৯), আরও গোটা তিনেক হলিউডের সিনেমা থেকে সিন বাই সিন টুকে দেওয়া। আগ্রহ নিয়ে আমি দেখতে শুরু করলাম সেইসব দৃশ্যগুলো। টানা দু`ণ্টা ভিডিও দেখার পর পেনটা হাত থেকে পড়ে গেল। বুঝলাম বলিউড রইল বলিউডেই। যেখানে টোকাটুকিই একটা স্টাইল।)
------- পার্থ প্রতিম চন্দ্র