চলবে লোভের সংস্কৃতি, মাথা নোওয়াল কাঙাল-বিপ্লব

ছবির নাম: কাঙাল মালসাট রেটিং: **1/2

Updated By: Aug 7, 2013, 08:36 PM IST

শর্মিলা মাইতি
ছবির নাম: কাঙাল মালসাট
রেটিং: ***
সেন্সর, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ আর বিতর্ক- ত্রিশূলের আঘাতে প্রায় কণ্ঠরোধ হতে বসেছিল সুমন মুখোপাধ্যায়ের ছবি। প্রচুর আলোচনা-টক শো-লেখালিখির পর অবশেষে সেন্সরের কাছে মাথা নুইয়েই মুক্তি পেল শহরের বিভিন্ন হলে। ছবি দেখে প্রথমেই যে দীর্ঘশ্বাসটা পড়ে সেটা এই নির্মম কাঁচির জন্যেই। ছবির পরিসরে বেশ কটি জায়গায় বড় নিঃস্ব, বড় কাঙাল করে দিল কাঙাল মালসাট-কে। পরিচালক যারপরনাই বিরক্ত ও বিষণ্ণ। সঠিক জানা নেই শেষ অবধি সত্যিই কাঁচির দোষ, নাকি কিছুটা পরিচালকের চিন্তাভাবনার খামতিই কাঙাল মালসাট-এর ওপর ন্যায়বিচার করতে পারল না? ব্যক্তিবিশেষের অভিনয়ের ওপরে ভর করে দাঁড়িয়ে থাকল কাঙাল মালসাট। বিপ্লব যে-কোনও মুহূর্তে ঘটতে পারে। সমাজ যতই পরিবর্তন হোক না কেন, নিম্নবর্গের মানুষেরা চিরকাল নিচের স্তরেই থেকে যান হয়ত, তবু বিপ্লবের বারুদ জমতে থাকে পাহাড়প্রমাণ হয়ে। শুধু একটু আগুনের অপেক্ষায় থাকে। নবারুণ ভট্টাচার্যের উপন্যাস "হার্বার্ট`` শেষ হয়েছিল এই আশ্বাস দিয়ে। যে-সময়ে এই উপন্যাস লেখা হয়, সে বড় সুখের সময় নয়। নকশাল আন্দোলন দিকদিশা হারাচ্ছে। পথভ্রষ্ট হচ্ছে যুবসমাজ, শাসক-নিরসনের নামে চলছে নির্বিচার হত্যালীলা। এই আশ্বাসই জাগরুক ছিল কাঙাল মালসাট-এও।
কাঙাল মালসাট প্রকাশিত হয় ২০০৩ সালে। শুরুতে মিখাইল বুলগাকভের উক্তি- পান্ডুলিপিরা পুড়ে যায় না। প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে লেখা ছিল-চলবে। শেষ অধ্যায়ে লেখা ছিল একটি ছোট্ট অথচ জাজ্জ্বল্যমান শব্দবন্ধ- চলবে না। ২০০৫ এ এর নাট্য-উপস্থাপনা। তৃতীয় সূত্র ও চেতনা নাট্যগোষ্ঠির যৌথ উপস্থাপনা। পরিচালক সুমন সেই গল্পটাই বললেন অন্য আর্থসামাজিক কাঠামোয়। রূপকার্থে, এই ছবি পশ্চিমবঙ্গের টালমাটাল রাজনৈতিক পরিস্থিতির (যতই পরিচালক বলুন এ ছবি অ্যান্টি-তৃণমূল বা অ্যান্টি- সিপিএম নয়) ফ্রেম। পরিবর্তনের পরের ছবি। কলকাতা লন্ডন হবে। দার্জিলিং হবে সুইজারল্যান্ড। ঝিনচ্যাক ছাড়া কিছু থাকবে না! বস্তি উচ্ছেদ হয়ে আকাশ চুম্বন করবে শপিং মল। গরিবরা পিছোতে পিছোতে পাতালপ্রবেশ করছে। কোনও পরিবর্তনেই তাদের কথা ভাবা হচ্ছে না। ভোটব্যাঙ্ক ছাড়া তাদের কোনও অস্তিত্বস্বীকার করা হয় না রাজনীতিতে। যে-কটি কথা বললাম, সেগুলো এই কাঙাল-দের ছবি আঁকার জন্য। সুমন মুখোপাধ্যায়ের ছবিতে পুরন্দর, ডি এস, চোক্তার ভদি, বেচামণি, বেগম জনসন, গুপ্তচর গোলাপ এরাই। প্রান্তিক মানুষ।

ফ্যাতাড়ু-র যে ধারণাটা দিয়েছিলেন নবারুণ ভট্টাচার্য, তাতে ম্যাজিক রিয়্যালিজম-এর মোড়ক ছিল। গুমরে ওঠা বিপ্লব হঠাত্ প্রাণ পাওয়া। অন্যরকম বাস্তবে। গ্রাম্য বিশ্বাস, তুকতাক ঝাড়ফুঁকের তুঙ্গ ব্যবহারের নিদর্শনও ছিল। দণ্ডবায়সের চরিত্রটির অবশ্যই একটি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। ইতিহাস ও ভবিষ্যত্ দেখতে পান যিনি। এখানেও তার অন্যথা হয়নি। কবীর সুমনের গম্ভীর কণ্ঠস্বর সত্যিই একটা অন্য আবহ তৈরি করে। কিন্তু কস্টিউম এমন নাটুকে কেন? কেনই বা স্পেশাল এফেক্টস-এর এত দৈন্যদশা? তিনি উধাও হন আর পালক ঝরে পড়ে! বড় রকমের ছন্দোপতন। তা ছাড়াও স্পেশাল এফেক্টস সম্পর্কে আরও যত্নশীল হওয়া উচিত্‍ ছিল উড়ে যাওয়ার দৃশ্যগুলোয়, কিংবা আকাশে ভেসে থাকা ফ্যাতাড়ুদের। সিনেমায় যে ফ্যাতাড়ুরা ফিরে আসে, তাদের ফ্যাত-ফ্যাত-সাঁই-সাঁই অবশ্যই নাটকের উপস্থাপনার থেকে আলাদা হবে, আশা রাখা যায়। উড়ন্ত চাকতিকেও কেমন যেন খেলনা-খেলনাই মনে হয়। Walking tightrope between the reality and unreality" যে ধারণায় নবারুণ ভট্টাচার্য বাস্তবতার ছবি আঁকতেন, সুমনের ছবিতে সেই বাস্তবদৃশ্যগুলো একটু যেন আরোপিত মনে হল। ধাক্কা খেল ম্যাজিক রিয়্যালিজমের যাদুবিন্যাস।
পরিচিত ভাষাবিন্যাসের বাইরের ভাষায় কথা বলে এই চরিত্ররা। অ-সভ্য ভাষা। চোখ কপালে তোলার মতো বিস্ফোরক। এখানে লেখক ও পরিচালক একই রুটে হেঁটেছেন। ছবি যত এগোয়, ততই গা-সওয়া হয়ে যায় এই আন্ডারগ্রাউন্ড ল্যাঙ্গোয়েজ। কেন্দ্রীয় চরিত্র কৌশিক গাঙ্গুলি- চোক্তার ভদি। চরিত্রের রক্তমাংসে ঢুকে গিয়েছেন অনায়াসে। শান্তিলাল, জোজো থেকে বিশ্বজিত্ চক্রবর্তী, বিমল চক্রবর্তী- সব কলাকুশলীরা নাটকের দক্ষ শিল্পী। প্রাণপণ অভিনয় করেছেন। তবু কবি পুরন্দর ভাটকে ধারহীন মনে হল। নাটকে রুদ্রনীল অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন এই চরিত্রে, এখানে তাঁর অনুপস্থিতি বেশ টের পাওয়াও গেল।

অস্ত্র ছাড়াও বিপ্লব হয়। কাঙালদের জোটবদ্ধ প্রচেষ্টা ভিত নড়িয়ে দিল, অন্তত টেররাইজ করল এই সমাজকে। নানা ঘটনার ঘনঘটায় তা বেশ ভালভাবেই বর্ণিত। যাঁরা কাঙাল মালসাট নাটক পড়েননি, কিংবা মঞ্চউপস্থাপনাও দেখেননি, তাঁদের বেশ ভালই লাগবে। কিন্তু শেষে এসে আবার গতি হারাল। প্রায় তুবড়ি যেমন হুহু করে উঠে ছড়িয়ে যায় দিগ্বিদিক তার পর ভুস করে নিভে যায়, তেমনই। প্রত্যেকেই কিছু না কিছু পেয়ে গেল। ধুলোর আস্তর পড়ে গেল বিপ্লবে। কেন? কোনও সঙ্গত কারণ ছিল কি?

উত্তরে মৌনতা। সিনেমা জুড়ে আমরা যাকে সাক্ষী হিসেবে দেখি, যে ঘুলঘুলি দিয়ে দেখে কাঙালের বিশ্বকে। সে-ই বা গেল কোথায়? এই বিপ্লবে তার কি কোনও ভূমিকা ছিল না? যে-মানুষটি প্রথম থেকে শেষ অবধি সুড়ঙ্গ খুঁড়ে চলে তেল পাওয়ার আশায়, সেই নিরন্তর স্বপ্নও কি অবাস্তব বলে স্বীকার করে নেওয়া হল? এমনই প্রচুর প্রশ্ন। আর সেই সঙ্গেই হঠাত্ যবনিকাপতন। কোথাও `চলবে না` শব্দটা শোনা গেল না। মনে হল, "চলছে, চলবে"-ই শুনতে পেলাম। ঝিনচ্যাক ছাড়া কিছু থাকবে না। চলবে লোভের সংস্কৃতি। মাথা নোওয়াবে সব বিপ্লব। নাকে খত দেবে ফ্যাতাড়ুরা।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: আরেকজনের উপস্থিতি অনস্বীকার্য ও বেশ জোরালো। সঞ্চালক মৌপিয়া নন্দী!

.