প্রথমবার `শরদিন্দু`র ব্যোমকেশ, পরদা জুড়ে ঋতু-স্মৃতি
ছবির নাম: সত্যান্বেষী রেটিং: ***১/২
শর্মিলা মাইতি
ছবির নাম: সত্যান্বেষী
রেটিং: ***১/২
ব্যোমকেশ শালপ্রাংশু মহাভুজ রথী ছিলেন না। এ ছবি দেখার পর বাঙালি মন-ক্যানভাসে অন্তত একবার, প্রথমবারের জন্য ভেসে উঠুক শরদিন্দুর নিজের লেখা সেই গোয়েন্দা কাহিনিগুলো। টিভি সিরিয়ালের যুগের অনেক আগে, বাঙালির অনুসন্ধিত্সা ও জিঘাংসা পূরণের পূর্ণ দায়িত্ব পালন করত। সেই অতীতে, যখন কথার মাঝখানে মোবাইল বেজে উঠত না। পথের কাঁটা, রক্তমুখী নীলা, সীমন্তহীরা, কি অর্থমনর্থম পড়তে পড়তেই মস্তিষ্কের ডনবৈঠক হয়ে যেত। খাপে খাপে ব্যোমকেশের চেহারা বসিয়ে নিয়ে তার পর চোখ খুলুন। এইবার ঋতুপর্ণ ঘোষের শেষ ছবি সত্যান্বেষী-র সত্য অন্বেষণ করতে অসুবিধে হবে না।
আমাদের চোখের নায়ক, যাঁরা আঁখিপল্লবে লেগে থাকেন ছবি শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও, এ পর্যন্ত ব্যোমকেশ কেও সেইরকমই দেখতে ছিল। হৃষীকেশের রাজিত কপূর থেকে অঞ্জন দত্তের আবির চট্টোপাধ্যায়, সকলেই এই স্কেচেরই এক্সটেনশন। ফেলুদা ও ব্যোমকেশের মস্তিষ্ক আলাদা, রহস্যসন্ধানের টেকনিকও আলাদা, তাহলে তাঁদের চেহারা কল্পনা করতে গেলে এতটাই বেশি দাবি করে বসেন কেন দর্শক? "গায়ের রং ফরসা, বেশ সুশ্রী চেহারা- মুখে চোখে একটা বুদ্ধির ছাপ আছে। কিন্তু বোধহয় সম্প্রতি কোনও কষ্টে পড়িয়াছে; কারণ বেশভূষার কোনও যত্ন নাই, চুলগুলি অবিন্যস্ত..." এমনই একটা চেহারার স্কেচ পাওয়া যায় শরদিন্দুর `সত্যান্বেষী` গল্পে, যেখানে প্রথমবার অজিতের সঙ্গে মোলাকাত হচ্ছে অতুলের ছদ্মবেশধারী ব্যোমকেশের সঙ্গে। ঋতুপর্ণ ঘোষের সত্যান্বেষী কিন্তু শরদিন্দুর চোরাবালি। সাড়ে বত্রিশ গল্পের মধ্যে এই গল্পটাকেই তিনি কেন নির্বাচন করলেন, আবার নামটাও বদলে দিলেন, তারও যে যথোপযুক্ত কারণ ছিল, সেটা ছবিটা সম্পূর্ণ না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। "নায়কোচিত" এই বিশেষণকে প্রথমেই সমূলে উত্পাটন করতেই সুজয় ঘোষের অবতারণা। শীর্ণকায় শরীর, সদা সজাগ মস্তিষ্ক, সাধারণের চেয়েও বড় চোখ। বিলকুল বাঙালির ব্যোমকেশ। যাকে
অযাচিত নায়কত্ব আরোপ করতে হয় না। যে ব্যোমকেশ কেন্দ্রে থাকে না। রহস্যের জালটাকে কেন্দ্রে রাখে। নিজে থাকে গল্পে মিশে, ইন্দ্রিয়কে রাখে জাগ্রত। সাসপেক্টদের অনুসন্ধান করে চোখ-কান-খোলা রেখে। ব্যোমকেশের আদবকায়দা কেমন যেন পার্শ্বচরিত্রোচিত। সাসপেক্টরাই কেন্দ্রে। বেশি পরিস্ফুট, বেশি রঙিন, আর একই কারণে ব্যোমকেশ চলে যান তাঁদেরই পেছনে। অপূর্ব লেগেছে অজিতকেও। এর আগের যে-কোনও অজিতেরই মধ্যে ওয়াটসনের ছায়া পাওয়া যেত। এই অজিত কিন্তু একান্ত শরদিন্দুরই অজিত। জিজ্ঞাসু, ভ্রমণপিপাসু, সাহিত্যমনস্ক ও স্পষ্টবাদী। সুজয়-অনিন্দ্য এই কম্বিনেশন আবির-শাশ্বত প্যাকেজের মতো চোখের আরাম না দিতে পারে, কিন্তু শরদিন্দুর লেখনীকে যথাযোগ্য সম্মান জানিয়েছে। বরং এ গল্পের কেন্দ্রে রাজা ও রানি। যথাক্রমে ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত ও অর্পিতা পাল। মনে দাগ কাটে অনির্বাণ ঘোষের অভিনয়ও। মন ছোঁয় লীলার ভূমিকায় আনন্দীর অভিনয়ও। কালীগতি শিবাজী প্রথম ছবিতেই যে সাক্ষর রাখলেন তাতে ছাত্রমহলের চেয়ে পরিচালকমহলই বেশি কলিংবেল টিপবে এঁর বাড়িতে।
কী দারুণ অঙ্ক কষলেন পরিচালক! চারিদিকের ঘটনা দিয়ে এমন ফ্রেম করলেন, যেন শরদিন্দুর সময় উঠে এল আমাদের চারিদিকে। ঢুকে গেলাম রাজবাড়ির অন্দরমহলে। রহস্যের গন্ধ যেখানে প্রতি ইঁটে আছে লেখা। এ ছবির ভিতর ও বাইরের গল্প সমান আকর্ষণীয়। শুটিং শেষ করে ঋতুপর্ণ ঘোষের চিরনিদ্রা। সেরে যেতে পারেননি শেষ কাজ। তাঁর শেষ কাজ শেষ করার গুরুদায়িত্ব নিয়েছিলেন তাঁর দীর্ঘসফরের সঙ্গী অভীক মুখোপাধ্যায়, অর্ঘকমল মিত্র, দেবজ্যোতি মিশ্র ও আরও অনেকে। এবার সত্যজিত্ রায়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ঋতুপর্ণর চরিত্রচয়ন। পরিচিত, বহু-পরিচিত অভিনেতা অভিনেত্রী নয়, আশেপাশের নন-অ্যাক্টরদের কাছ থেকে অভিনয় আদায় করে নেওয়া। সুজয় পরিচালক, অনিন্দ্য গায়ক, কালীগতির ভূমিকায় শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় অধ্যাপক। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের "চোরাবালি" পুরোপুরি আত্মস্থ যে করেছিলেন ঋতুপর্ণ, তা এই কাস্টিং-এ স্পষ্ট। চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে সামান্য অদলবদল নির্ভরযোগ্য। অতিরিক্ত ঘটনার ঘনঘটার চাপ নেননি ঋতুপর্ণ। বরং আবহসঙ্গীতের প্রলেপে চোরাবালি-ও সত্যান্বেষী-র এক চরিত্র করে তুলেছেন, যাকে পাওয়া যাচ্ছে ক্লাইম্যাক্সে। অজিতের ছুড়ে দেওয়া সিগারেট টিন যখন বালুকার গ্রাসে চলে যেতে দেখছি। অনতিবিলম্বে দেখাযাচ্ছে ব্যোমকেশ-অজিত লাইব্রেরিতে। আবিষ্কার করছে বালু বন্ধপুর। অপভ্রংশে যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে- বলবন্তপুর। সেখান থেকে চোরাবালি পর্যন্ত উপনীত হওয়ার সময়ে এক অতিরিক্ত রঞ্জিত, অতিনাটকীয় দৃশ্য দেখতে পাই। আদপেই যার কোনও দরকার ছিল না। ভাবতে ইচ্ছে করে না, মৃগয়ার দৃশ্যে অজিত ও ব্যোমকেশের উইগ বদলে যাওয়া। জানা নেই কেনই বা হাতের লেখার বদলে ছাপার অক্ষর ব্যবহার করা হল তাসের ওপর। শজারুর কাঁটা হয়ে চোখে লাগে!