সৌমিত্র সেন
এরোপ্লেন তাঁকে গরুড়ের কাছে নিয়ে যায়। নিচু দরজা তাঁকে সন্ন্যাস-ভাবনায় দীপিত করে। নির্জন মাঠ তাঁকে আত্মোপলব্ধির গোধূলিতে পৌঁছে দেয়। তিনি 'প্যারাডাইস কাফে'র উত্তাল আড্ডাধারীদের একজন। তিনি বাংলা তথা ভারতীয় ছবির অন্যতম মেসিহা। তিনি বিশ্ব-সিনেমারও অতুল সম্পদ। 'রাতভোর' থেকে 'নীল আকাশের নীচে', 'বাইশে শ্রাবণ', 'ভুবন সোম', কলকাতা-ট্রিলজি হয়ে তিনি 'আমার ভুবন'। তিনি মৃণাল সেন। আজ, ১৪ মে জন্মশতবর্ষদিবস তাঁর। ১৯২৩ সালের এই দিনে বাংলাদেশের ফরিদপুরে জন্ম।
জীবনের প্রথম পর্বের পড়াশোনা জন্মস্থানেই। পরে কলকাতা। স্কটিশ চার্চ কলেজে পদার্থবিদ্যা নিয়ে ভর্তি হন। ছাত্রাবস্থাতেই শহর-কলকাতার রাজনীতি-সংস্কৃতির সঙ্গে আদ্যন্ত জড়িয়ে পড়েন। আকৃষ্ট হন 'ইন্ডিয়ান কমিউনিস্ট পার্টি'র কাজকর্মের প্রতি। ঠিক এই সময়েই তিনি ফিল্মের নন্দনতত্ত্বের প্রতিও আকৃষ্ট হন। এ নিয়ে পড়াশোনা করতেও শুরু করেন। যদিও মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভের কাজ নিয়ে তাঁকে অচিরেই ছাড়তে হয় কলকাতা।
আরও পড়ুন: Remembering Ranajit Guha: তিনি মানুষের মধ্যে ইতিহাস খোঁজেন, ইতিহাসের মধ্যে মানুষ...
কারুবাসনার মৃত্যু কি তবে ওষুধের গভীর স্তূপের ভিতরে? নিশ্চয়ই না। স্বপ্নের বীজ কখনও মরে না। কলকাতা থেকে বহু দূরে, ঝাঁসিতে একদিন একটা সাইকেল ভাড়া করে বেড়াতে-বেড়াতে ওষুধ কোম্পানির কর্মচারী মৃণাল সেন চলে গেলেন শহরের প্রান্তে নির্জন বিশাল এক মাঠে। সেখানেই তাঁর যেন আত্মোপলব্ধি ঘটল। হঠাৎই! সেদিন, তখনই হোটেলে ফিরে, বদ্ধ ঘরে 'মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভে'র জীবনের প্রতি গভীর ধিক্কারে কেঁদে উঠলেন স্বপ্নতাড়িত তরুণ মৃণাল! এমনিতে কান্নায় তাঁর ঘোর অনীহা। জীবনে বোধ হয় সেই একবারই কাঁদলেন। এবং সেই কান্না তাঁকে জীবনের দিশাহারা সমুদ্রে অকূল থেকে কূলে পৌঁছে দিল!
কূল বলতে কলকাতাও। কলকাতায় ফিরলেন মৃণাল। এবং একইসঙ্গে সিনেমায় ফিরলেন। যে-আয়নায় নিজেকে দেখে কান্না আসে না, সেই আয়নায় মুখ দেখতে শুরু করলেন তিনি। কান্না হয়তো আসে না। কিন্তু যন্ত্রণা? সংকট? রাজনৈতিক বঞ্চনার স্বপ্নভঙ্গের আর্তি? সেসব তো আছে!
আরও পড়ুন: Gautama Buddha: অমিতাভ! হিম-নির্ঝরিণীর শীকর-নিষিক্ত মৈত্রেয় আজ কোথায়?
মৃণাল সেনের এক সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন কথাসাহিত্যিক সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। সেখানে সন্দীপনের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে মৃণাল সেন বলেছিলেন, তিনি ফিল্মকে 'লিটেরারি টেকনিক' হিসেবেই উপলব্ধি করেছেন। সাহিত্যেরই একটা অন্য 'ডায়মেনশন' হিসেবেই যেন ছবিকে দেখলেন তিনি। কিন্তু মৃণাল সেন ফিল্মে খুব যত্ন করে ন্যারেটিভকে ভেঙেছেন। যতটা পেরেছেন সাহিত্য-সংগীতের ছত্রছায়া থেকে ছবিকে বার করে আনতে চেষ্টা চেয়েছেন, এনেছেনও। বলতে গেলে সাহিত্যের মৃত্যুতেই যেন মৃণাল-ছবির জন্ম। তা-সত্ত্বেও সেদিন কেন সন্দীপনকে এমন বলেছিলেন মৃণাল? আসলে তাঁর মধ্যে সৃজনধর্মী যে মন ও মননটা ছিল, সেটা বহুলাংশে সাহিত্যরস থেকেই তৈরি-হয়ে-ওঠা। কিন্তু তিনি তো সাহিত্যিক হলেন না! নিজেকে ব্যক্ত করার জন্য তিনি বেছে নিলেন ছবি। কেন ফিল্ম, তার একটা দর্শনও তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন ওই সাক্ষাৎকারেই। বলেছিলেন--তিনি যখন কোনও ছবি করেন, তখন ছবিটির সঙ্গেই তিনি যেন বেড়ে ওঠেন (আই ফিল আই অ্যাম গ্রোয়িং উইথ দ্য ফিল্ম হোয়াইল ডুইং ইট)!
এবং এভাবে যেমন তিনিও বেড়ে উঠতে লাগলেন, তেমনই তাঁর কাজের মধ্যে দিয়ে বেড়ে উঠতে লাগল ভারতীয় ছবিও। ভারতীয় ছবিতে অভিনয়ের নতুন ধারাও তিনি আনলেন। অভিনেতাকে চরিত্রের মধ্যে ঢুকতে দেওয়ার কোনও ইচ্ছেই যেন তাঁর নেই। বরং অভিনেতার উপর অনেক কম নির্ভরশীল হয়েও নিজেকে বিপুল ভাবে ব্যক্ত করার এক আনকোরা পদ্ধতি ব্যবহার করে তিনি পরের পর ছবি করে যেতে লাগলেন। এভাবে চলচ্চিত্রভাষার একরৈখিক ডিসকোর্সের ব্যাকরণ ভাঙলেন। ভাঙলেন ভাবনার ব্যাকরণও। গড়তে-গড়তে ভাঙলেন। ভাঙতে-ভাঙতে গড়লেন। নিজের মতো করে বুঝলেন সমসময়কে, আধুনিকতাকে। হ্যামলেটের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে তিনি গেলেন কুইকজোটিক মেজাজের কাছে। সন্দীপনকেই তিনি জানিয়েছিলেন-- 'কুইকজোটিক মেজাজই আমাকে আধুনিকতা বুঝতে সাহায্য করে। হ্যামলেট নয়, হ্যামলেটের মধ্যে একটা বুর্জোয়া গ্র্যানজার থেকে গেছে।'
তাই মৃণাল মৃণালেরই মতো! ছবি করতে গিয়ে পদে-পদে কথনকে প্রশ্ন করেছেন। তার্কিকতায় বিদ্ধ করেছেন ছবির আত্মাকে। এবং ছবির আত্মায় গুঁজে দিয়েছেন এক আপাত চিন্তা-বিশৃঙ্খলা। তাতে কেউ কেউ বলতে বাধ্য হয়েছেন, মৃণালের কোনও ছবিই সম্পূর্ণ নয়, সবই অর্ধ-নির্মিত!
অর্ধ-নির্মিতই তো! তিনি তো জীবনকে বুঝতে-বুঝতে সিনেমা বানাচ্ছেন। তাঁর জীবন, তাঁর দেখা-বোঝা-জানা কি কখনও সম্পূর্ণতায় পৌঁছে গিয়েছিল যে, তিনি একটা কমপ্লিট ফিল্ম বানিয়ে ফেলবেন? অন্তত তিনি নিজে তো তা মনে করতেন না! তিনি তো সবসমই 'গ্রোয়িং'। যিনি 'অলওয়েজ গ্রোয়িং' তাঁর ছবি তো সেই সময়ের সাপেক্ষে অসম্পূর্ণ হবেই! তাঁর ছবি অর্ধ-নির্মিত হবে না তো কার হবে? তাই তো তাঁর ছবিতে চিৎকার ও নীরবতা, আগুন ও শৈত্য অসম্পূর্ণভাবে পাশাপাশি!
এলিয়ো ভিত্তোরিনির একটি উক্তি মৃণালের অত্যন্ত প্রিয় ছিল-- 'দ্য পয়েন্ট ইজ নট টু পকেট দ্য ট্রুথ, বাট টু চেজ ইট'। মৃণাল তো সত্যকে আত্মস্থ করতে চাননি! সত্যকে তিনি তাড়া করে ফেরেন! তাঁর সেই তাড়া-করা কখনও ফুরোয় না। আর তাই তাঁর ছবির জার্নিও কখনও শেষ হয় না। সে সামনের দিকে ক্রমাগত এগিয়ে যেতে থাকে, এগিয়ে যায়; কখনও সম্পূর্ণতার মোহে দাঁড়িয়ে না-পড়ে সম্পূর্ণতার দিকে ভেসে পড়ে। মৃণালের যাত্রা তাই অর্ধ-নির্মাণের এক খণ্ডহর থেকে পরিপূর্ণতার কোনও এক মহাপৃথিবীতে!
তাই তাঁর ছবির চরিত্রেরা হারিয়ে যান, চলে যান, পরিচালক হয়েও তিনি তাঁদের হদিশ জানেন না। তিনি জানেন না, তাঁর ছবির চরিত্রগুলির পরিণতি কী? জানবেনই-বা কী করে? তিনি তো স্বপ্নপাখির পিঠে বসে ঘুরছেন!
ছেলেবেলায় মৃণাল উজ্জ্বল আকাশে একটি পাখি দেখেছিলেন। পরে তাঁর ঘোর ভাঙে। তিনি জানলেন, সেটি একটি উড়োজাহাজ। দিনে এরোপ্লেন দেখে রাতে মৃণাল একটি স্বপ্নও দেখেছিলেন। গরুড়ের স্বপ্ন। তিনি পরে বলেছেন-- ''আমার বিছানার কাছে এসে আমাকে পিঠে বসিয়ে নিতে চাইছে পাখিটি। আমি স্বপ্নের মধ্যে সেই পাখির পিঠে বসে ঘুরলাম।''
হ্যাঁ, মৃণাল তাঁর অর্ধ-নির্মিত ছবিগুলি নিয়ে ওই পাখির পিঠে বসে সত্যকে অনন্তকাল ধরে তাড়া করে চলেছেন! আজও করছেন কি?
নীল আকাশের নীচে অনন্তকাল ধরে হাঁটছেন এক প্রখর পদাতিক...