নজরদারির 'পার্সেলে' বন্দী ঋতুপর্ণার জীবন
পার্সেল- এক নজরদারির জীবন
পরিচালনা - ইন্দ্রাশিস আচার্য
অভিনয় - ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়, শ্রীলা মজুমদার, অম্বরীশ ভট্টাচার্য, দামিনী বেণী বসু
চিত্রগ্রহণ- শান্তনু দে
সঙ্গীত পরিচালনা - জয় সরকার
শর্মিষ্ঠা গোস্বামী চট্টোপাধ্যায়: এবারের জন্মদিনে হঠাৎই অফিসে একটা ফুলের তোড়া। এমনটা তো হয়নি আগে, ভাবতে ভাবতেই বাড়ি থেকে ফোন, একটা বাক্স ভর্তি প্যানকেক ডেলিভার্ড হয়েছে, প্রেরকের নাম নেই। একটু চিন্তাতেই পড়েছিলাম। তবে সাধারণ বুদ্ধি বলছিল, এমন কেউ বা কারা এর প্রেরক, যাঁরা আমাকে ভাল মত চেনেন। আমি ঠিক কী ফুল ভালবাসি বা কী ডেজার্ট পছন্দ করি, সেটা জেনেই পার্সেল পাঠিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে আরও একটা ভাবনা জন্ম নিল। যদি আমার চেনা কেউই হবেন, তাহলে নাম না জানা পার্সেল কেন! একটা অস্বস্তি দানা বাঁধতে শুরু করেছিল বটে, কিন্তু শুধুমাত্র বুদ্ধি আর পর্যবেক্ষণের জোরে সন্ধ্যার মধ্যেই করা গিয়েছিল রহস্যভেদ। পরিচালক ইন্দ্রাশিস আচার্য প্রায় সেই ঢংয়েই শুরু করেছিলেন তাঁর নতুন ছবি পার্সেলের গল্প। নন্দিনী আর শৌভিকের জীবনের ছন্দে ব্যাঘাত ঘটিয়ে চলে একের পর এক পার্সেলের আগমন। ব্যাপারটা প্রথমে ততটা সিরিয়াসলি না নিলেও নন্দিনী ক্রমশ বুঝতে পারে কেউ তাকে রোজ ফলো করছে। সেই ছবিই বাড়িতে আসছে রোজ। একটা আলতো ভাললাগা ক্রমশ টেনশনে পরিণত হয়। স্বামী -স্ত্রীর সম্পর্কের ফাঁকে খুব সহজেই এসে পড়ে অতীত আর সেই অতীতদের বর্তমানরা। সেই টুকরো টুকরো ঘটনার মধ্যে দিয়েই পরিচালক ইন্দ্রাশিস আমাদের রোজকার জীবনের অনিশ্চয়তা, ভয়, নজরদারি, ক্ষয়ে যেতে বসা মুল্যবোধ, অপরাধমনস্কতা, চালাকি, সহজ সমীকরণ, গভীরতার অভাব এঁকে চলেন। আর তাঁর চিত্রনাট্যকে দর্শকের মনে টেনশন তৈরি করতে সাহায্য করে ছবির আবহসঙ্গীত। সমস্যার গভীরে পৌঁছতে আসে সাবপ্লট। এমন একটা আকস্মিক পার্সেল কীভাবে নন্দিনীর ভিতরের রাগ-উষ্মা-হতাশার দাঁত, নখ বের করে আনে, তা আজকের দিনে আমাদের খুব অচেনা নয়। যে গোপনীয়তার অধিকার নিয়ে আমাদের বেড়ে ওঠা, তাতে ঘা লাগলে হয়ত নন্দিনীর মত রিয়্যাকশন হওয়াই স্বাভাবিক। তাই এক্স-বয়ফ্রেন্ডকে হুমকি, পুরনো বান্ধবীর কাছে রেখে আসা কিছু গোপন তথ্য ফিরে পাওয়ার জন্য এত বছর পরেও তার ব্ল্যাকমেলের শিকার হওয়া অথবা ডাক্তার নন্দিনীর ভুল চিকিৎসায় এক রোগীর মারা যাওয়া এবং পরিবারটির প্রায় ধ্বংস হতে বসা- এঁদের কাছেই ফিরতে হয় নন্দিনীকে। তার জীবনে আছে আরও এক অসহায়তা। স্বামীর ফোনে ক্রমাগতই আসতে থাকা একটা কল, নারীকণ্ঠ, যা ক্রমশ অধিকার বিস্তার করছে শৌভিকের উপর। অথচ এক উচ্চবিত্ত চিকিৎসকযুগল যা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে পারে না, কীসে যেন একটা আটকায়। এই সূক্ষ্মতা দিয়েই চিত্রনাট্যটি লিখেছেন ইন্দ্রাশিস, তবে সাবপ্লটগুলো আরও একটু স্পষ্ট হতে পারত। আত্মীয়ের বাড়ির সাবপ্লট ছবিতে নতুন কিছু যোগ করেনি, তাই সেটাকে বাড়তি লেগেছে।
আরও পড়ুন-'একাত্তর'এর প্রকৃত সত্য তুলে ধরতেই পাক সাংবাদিক আমি: রাফিয়াত রশিদ মিথিলা
পরিচালক ইন্দ্রাশিস আচার্য তাঁর আগের দুটি ছবিতে নতুন ন্যারেটিভ এনেছিলেন। বিল্লু রাক্ষস ও বিশেষ করে পিউপা দেখে ইন্দ্রাশিস সম্পর্কে দর্শকের একটা আশা তৈরি হয়েছে। পার্সেল ছবিতে সেই আশাভঙ্গ হয়েছে বলব না, কিন্তু চিত্রনাট্যের বুনোটে বেশ কিছু অসংগতি রয়েছে, যাকে বলা যায় লজিকাল রিজনিংয়ের অভাব। অন্যদিকে নজরদারি ও তার দমবন্ধের দিকটি একটা আই-ওপেনার ও বটে।
ছবির বেশিরভাগ অংশই ইন্ডোরে শুটিং। কেবল আত্মীয়ের বাড়ি এবং ছবির শেষে দেশের বাড়ির অংশটুকু ছাড়া। শান্তনু দে সে ছবি ভালই দেখিয়েছেন। ইন্দ্রাশিস বোধকরি নদী ভালবাসেন। তাই নদীর পাড় তাঁর ছবিতে সিগনেচার হয়ে ফেরত আসে।
জয় সরকারের আবহ ছবির অন্যতম জোর। গোটা ছবি জুড়ে মোবাইল ফোনের রিং টোন আর বেহালার সুরের বৈপরীত্য ছবির গতিকে ভাঙে-গড়ে।অভিনয়ে সবথেকে বেশি চোখে পড়েন দামিনী বেণী বসু। তাঁর ও ঋতুপর্ণার হাতাহাতির অভিনয় ছবির অন্যতম হাই-পয়েন্ট। অম্বরীশ ভট্টাচার্য অল্প পরিসরে খুবই জোরালো। অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় যথাযথ। শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় চিত্রনাট্যে যতটা সুযোগ পেয়েছেন, তার সদব্যবহারই করেছেন। কিন্তু আরেকটু বেশি আশা ছিল ঋতুপর্ণার কাছ থেকে। আরেকটু বেশি আশা অবশ্য পরিচালকের কাছেও ছিল। তবে একটা নতুন ন্যারেটিভ নিয়ে পরীক্ষা করলেন, চেনা ছকে সেফ খেলার চেষ্টা করেন নি, এটাই যা আশার কথা।
আরও পড়ুন-সৃজিতের সঙ্গে থাকতে ভারতীয় নাগরিকত্ব নেবেন? মিথিলা বললেন...