রাজা-উজির গেল তল, হেরেও জিতলেন অমিতাভ
শর্মিলা মাইতি
ছবির নাম: ওয়াজির
রেটিং: ***1/2
শতরঞ্জ, মানে দাবাখেলা কত সর্বনাশা জীবনফাঁদ তৈরি করে, তার নমুনা বিশ্বের বিভিন্ন ছবিতেই মিলেছে। যেসবের তালিকায় বাঙালির একান্ত আপনার শতরঞ্জ কি খিলাড়িও আছে। বিজয় নাম্বিয়ার পরিচালক হিসেবে বরাবরই দাবার চাল বুঝেশুনে চালেন। ওয়াজির-এ যেন রাজা উজির সিপাই সবার ভাগ্যই নির্ধারিত ছিল। এ খেলায় যে হারে, সে-ই জেতে।
সত্তরোর্ধ অমিতাভের কাছ থেকে আপনাদের কী এক্সপেক্টেশন ছিল? যে মানুষটা বরাবরই নিজের দিগন্তটা আরও একটু বিস্তৃত করে দেন। আরও একটু প্রসারিত করে নিজের ভিতরের অন্য আমিটাকে বার বার টেনে বার করেন। ওয়াজির-এর ট্রেলার ইতিমধ্যে যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা মনে মনে যে-ছবিটা এঁকেছেন তার ব্যতিক্রমী কোনও অমিতাভকে এখানে পাবেন না। দীপক সাওন্তের মেক-আক ও হেয়ারস্টাইল অমিতাভের চোখের দৃষ্টিতে এমন এক হেঁয়ালি, এমন এক গভীর অজানা রহস্যের আবেদন এঁকে দিয়েছে যে কিছুটা বোনাস পয়েন্ট তাঁকে দেওয়াই যায়। পক্ককেশ, বলিরেখাময় পঙ্গু অমিতাভ ও তাঁর বর্ণময় হাসি। দেখে রোমাঞ্চ হবেই হবে। এলোমেলো চুলোর ফাঁকে তীক্ষ্ণ দুটো চোখ আর আলোর গতিতে ছুটতে থাকা মস্তিষ্ক। হুইলচেয়ারে বসে থেকেও যিনি প্রচন্ড গতিমান। আপন মেয়ের হত্যাকারীকে খুন করার জন্যেই দাবার বোর্ড সাজানো, বন্ধুত্ব, বিশ্বাস, আত্মনিবেদন, সবই যেন সাদাকালো খোপের ভুবনে আটকে আছে। প্রতি পদে মৃত্যু অগ্রাহ্য করে এগিয়ে যাওয়া সত্যের দিকে। একটু একটু করে দুষ্টের নিধনের দিকে। এ খেলা মৃত্যুলীলার। ধ্বংসের পর ধ্বংস দিয়েই সত্যে পৌঁছনোর।
আসা যাক অমিতাভ-ফারহান কেমিস্ট্রিতে। ব্যাপারটা যেন জ্যামিতিক নিয়মে এগিয়েছে। দর্শক বার বার ভুলভুলাইয়ায় ঘুরছেন, অথচ টেরই পাচ্ছেন না। ইন্টারভ্যালের আগে যখন গাড়িশুদ্ধ পঙ্গু অমিতাভ উড়ে-পুড়ে যাচ্ছেন। তাঁকে আটকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছেন ফারহান। জীবন শতরঞ্জে যাঁর ভূমিকা এক সেনাপতির। তা-ও আবার আবিষ্কৃত হচ্ছে সব শেষে। টানটান রুদ্ধশ্বাসে।
তবুও। এত কী হবে সিধে? বলিউড তথা বিশ্বের মোস্ট ডিজায়ারেবল পার্সোনালিটিকে এভাবে হেলায় হারাবেন কোন পরিচালক। যাঁকে নিযে ছবির প্রতিটি ফ্রেম ভাবেন আর বালকি, সুজিত সরকার, সুজয় ঘোষেরা!! বিজয় নাম্বিয়ারও সেই ভুলটি করলেন না। হাফটাইমে বিছোনো জাল দ্বিতীয়ার্ধে গুটিয়ে আনলেন ধীরে ধীরে। যে দুজনের কথা না বললে নয়, জন এব্রাহম ও নীল নীতিন মুকেশ। একরকম পিলে চমকানো রোল করেছেন নীল। যে-চরিত্র না থাকলে কিডনিটাই থাকে না! আর জন? ফিনিশিং টাচ মাস্টারস্ট্রোক। কাউন্টডাউন করে ছবিটা শেষ করে এনেছেন। যার কথা বলার কোনও প্রয়োজন নেই, তিনি অদিতি রাও হায়দারি। পুতুল হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।
দাবায় যাঁরা সিদ্ধহস্ত, তাঁরা জানেন। উজির-নিধন তবেই বাদশাকে চেকমেট দেওয়া যায়। তার পর তো সম্মুখসমরে শুধুই সময়জ্ঞান আর বুদ্ধিমত্তা। কাজেই অমিতাভ-রূপী উজির নিজের শরীর দিলেন। পাপিষ্ঠ মরল। হল সত্য উদ্ঘাটন। এর বেশি বলা যাবে না। ছবিটা আপনাদের হলে গিয়েই দেখতে হবে।