রূপের আগুন বয়সকেও হার মানাতে পারে, প্রায়ই বলতেন মিস শেফালি
দিদির অতিপ্রিয় ছাত্রী কঙ্কনাই পৌছে দিয়েছিল প্রথম বাঙালি ক্যাবারে ডান্সারের ফেলা আসা অতীত ও চরম বর্তমানের সন্ধিক্ষণে
দিব্যেন্দু ঘোষ: রূপ-সূর্য তখন অস্তমিত। বয়সের চোরাবালিতে ডুব দিয়েছে আস্ত শরীরটা। বলিরেখা ঢাকার আপ্রাণ চেষ্টা তখনও। বয়স ষাট পেরিয়েছে কবে। মনটা অবশ্য তখনও সত্তর-আশির দশকে পাক খায়। সেই লাস্য, সেই বিভঙ্গ, সেই ক্ষীণ কটির সুতীব্র ঝাঁকুনি, লক্ষ যুবকের হৃদয়ে ঝড় তোলা প্রায় নিরাবরণ শরীরের আগুন যেন সেই সময়েও তিলোত্তমার নিশিনিলয়ে মন-মদিরার অনুষ্ঠান তৈরি করত। চড়া মেকআপ, নিজেকে আপাদমস্তক গুছিয়ে রাখা, সাজিয়ে রাখা আরতি দাসের সঙ্গে যখন পরিচয়, তখন তাঁকে প্রায় ভুলতে বসেছে আমবাঙালি। তবে মিস শেফালিকে ভোলা যায় না। ভোলা সম্ভব নয়। মধ্যবিত্ত পরিবারের অতি-ছাপোষা মেয়েটা কখন আরতি থেকে মিস শেফালি হয়ে উঠেছেন, তা মনে করেছিলেন আলাপের প্রথম দিনেই।
নাগেরবাজারের ছোট্ট একচিলতে বসতি বড় অবিন্যস্ত। সময় চড়া দাগ কেটে গেছে। প্রথম সিঁড়িতে পা দিয়েই কানে বেজে উঠেছিল নূপুরের সুললিত ঝঙ্কার। দিদির অতিপ্রিয় ছাত্রী কঙ্কনাই পৌছে দিয়েছিল প্রথম বাঙালি ক্যাবারে ডান্সারের ফেলা আসা অতীত ও চরম বর্তমানের সন্ধিক্ষণে। ছোট্ট নাচের স্কুলটাই তখন প্রাণ। অসুখের বেদনায় শরীর প্রায় অকেজো। তবুও মুখের হাসিটা অমলিন। কখনও সে হাসিতে ধুলো জমতে দেখিনি। আমার মতো তরুণ অচেনা সাংবাদিককে প্রথম পরিচয়েই বড় আপন করে নিয়েছিলেন। একটা কি দুটো ইন্টারভিউ বড় কথা নয়। বড় কথা আত্মীয়তা। মাঝে মাঝে আমার ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠত আরতিদি লেখাটা। কখনও প্রয়োজনে, কখনও স্রেফ খোঁজ নিতেই ফোন করেছেন।
আরও পড়ুন-১৪ ফেব্রুয়ারিই বিয়ে নেহা-আদিত্যর, ঘোষণা টনি কক্করের
মানুষের সঙ্গে মিশতে ভালবাসতেন। গল্প করতে ভালবাসতেন। বাড়িতে গেলেই পুরনো দিনের গল্প, আড্ডা জমত। আমার সঙ্গে বয়সের এত ফারাক, বুঝতে দেননি। দিদির মতোই আন্তরিকতা প্রতিটি কথায়। আধুনিকতার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেন। বুঝতাম। যদিও পিছন দিকে তাকালে চোখের সামনে ভেসে ওঠে, খ্যাতির মধ্যগগনেও তিনি তো অতি-আধুনিকাই ছিলেন। বয়স যত তরতর করে সিঁড়ি বেয়েছে, ততই খেদ জন্ম নিয়েছে। এ প্রজন্মের কোনও বাঙালি মেয়ে সেভাবে ক্যাবারে ফর্মটা ধরে রাখার চেষ্টাই করল না। জীবন সংগ্রাম যেভাবে অসহায়তার চাদর বিছিয়েছে আরতিদির শরীরে, মনে পড়ত। না চাইলেও। নিজের অজান্তেই কতবার যে স্মৃতির অতলান্ত পেরিয়ে ফিরেছেন চৌরঙ্গীর ফারপো হোটেলে, তার ইয়ত্তা নেই। ইতিহাস কাঁদাত। কথা বলতে বলতেই শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতেন। কিন্তু চোখে আগুন জ্বলত।
আরও পড়ুন-মিস শেফালি বলতেন আমার বায়োপিকে তোকেই মানাবে: ঋতুপর্ণা
এই সেদিন ফোনে বলছিলেন, দিব্যেন্দু ভাই, বাবার বকুনির ভয়ে মায়ের সঙ্গে লুকিয়ে দেখা করতাম। কিন্তু সেই মাকেও সুখ, সমৃদ্ধি দিতে পারলাম কই। সমাজ কেন যে ব্রাত্য করে রাখল! ক্যাবারে বলে কি সেটা শিল্প নয়? বার বার প্রশ্ন করতেন। উত্তর দিলেও সে উত্তর পছন্দ হত না আরতিদির। মনের কোণে লুকিয়ে রাখা মান-অভিমান-লজ্জা-লাঞ্ছনা-ভাল লাগা ঝরে পড়ত। যখনই কথা হয়েছে। সে নাগেরবাজারের বাড়ি হোক কিংবা মুঠোফোনের অপর প্রান্ত।
বহুবার জানতে চেয়েছি, সত্যজিত্ রায়, উত্তমকুমার, তরুণকুমার, সুচিত্রা সেন কিংবা সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে সম্পর্কের কথা। কারও সম্পর্কে কোনও বিতর্কিত কথা শুনিনি কোনওদিন। বিতর্ক অবশ্য পিছু ছাড়তে পারে না। নাম যদি তাঁর মিস শেফালি হয়। তাঁর স্মৃতির আসনে একদম ওপরের দিকে ছিল সত্যজিত্ রায়, উত্তমকুমার নাম দুটো।
একটা সময় নরম শরীরে যৌবনের আগুন যেমন দপদপ করে জ্বলত, সেই আগুন শেষদিন পর্যন্ত দেখেছি দুই চোখে। শুধু চোখের কোলের চামড়া কুঁচকেছিল। কিন্তু আগুন নেভেনি। সংখ্যাহীন আঘাত ও অপমানের বিষবায়ু শ্বাসে, অ-শ্বাসে তাঁকে কুরে কুরে খেয়েছে। তবুও বিশ শতকের ক্যাবারে-রানির এক অপার জগতের পরিচয় পেয়েছিলাম। বিশ্বরূপা, সারকারিনায় তাঁকে একঝলক দেখার জন্য তুমুল উত্তেজনা চলকে উঠত আমআদমির অন্তরে। সে কথা বলতে বলতে চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠত। বুঝতাম, তিনি টাইম মেশিনে চড়ে ফিরতে চান। তাঁর নীলচে পৃথিবীতে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি নৃত্যলোকে বিলীন হয়ে যাবেন, ভাবিনি। খবরটা শোনার পর ভুল করে ডায়াল করে ফেলেছিলাম, ৯৮৩০৪****৮.......
কল্পনায় ভাসছিল যৌবন উপচানো ডিজাইনার বিকিনি পরে ঘুরে ঘুরে নাচছেন আরতি দাস, ওরফে মিস শেফালি।