EXCLUSIVE: ধুলো বেচে রোজগার লাখ টাকা!
সৌরভ পাল
কলকাতা: রবিবারের ভরদুপুর। প্রায় জনশূন্য বালিগঞ্জ-গড়িয়াহাট। রাজলক্ষ্মী জুয়ালার্সের সামনে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ধুলো বার করছেন একজন মধ্য বয়স্ক পুরুষ এবং তাঁর সঙ্গে আরও এক যুবক, বয়স পনেরোর কাছাকাছি। দাদা, একটু কথা বলব। উত্তর এল, 'কী বিষয়ে'? এই যে কাজটা আপনি করছেন, সেই বিষয়েই। তখনও নিজের সাংবাদিক পরিচয় দিইনি। না, বলব না, এই উত্তরই আশা করেছিলাম। কিন্তু ওপরারের মানুষটির অপ্রত্যাশিত সদুত্তরে খানিক অবাকই হয়েছিলাম। তারপর আমাকে আর কিছুই জিজ্ঞেস করতে হল না। নিজেকে খোলা বইয়ের মত আমার সামনে মেলে ধরলেন 'নেওরাওয়ালা' নাসির ভাই।
লরি লরি ধুলো বিক্রি হচ্ছে লাখে লাখে! ঠাকুরমার ঝুলির কোনও গল্প নয়, নয় কোনও সিনেম্যাটিক প্লটও। বরং বলতে হয় 'গল্প হলেও সত্যি'। শহর কলকাতার দীর্ঘ পরিধির আনাচে কানাচে রয়েছে এমন হাজার দুয়েক মানুষের বাস, যাদের রোজগারের একমাত্র পথ ধুলো বিক্রি। শিয়ালদহ, সিঁথির মোড়, বৌবাজার, গড়িয়াহাটের রাস্তা থেকে ধুলো তুলেই চলছে ওদের জীবন। গোটা পরিবার চলছে ধুলো বেচার রোজগারের ওপর। যেদিন ধুলোতে মিলবে সোনা, সেদিন ওদের জীবনে 'সোনায় সোহাগা', আর যেদিন নেই সেদিন ওরা 'অভাগা'। আসলে সোনার খোঁজেই উত্তর থেকে দক্ষিণ, কলকাতার আনাচে কানাচে ঘুরছে ওরা। পেশাগত নাম 'নেওরাওয়ালা'। চলতি ভাষায় 'নিয়ারিয়া'। ইউপির লখনউ, আগ্রার মানুষরা যেমন আছেন তেমন এই পেশায় আছেন মহারাষ্ট্রের মারাঠিরাও, তবে তারা সংখ্যায় খুবই কম। 'গোল্ড ডাস্ট', খোঁজের পেশায় নিজেদেরকে নিযুক্ত করেছেন যারা, তারা বেশিরভাগই মুসলিম ধর্মাবলম্বী এবং এরা সিংহভাগই কর্মসূত্রেই কলকাতায়।
পরনে হাফ প্যান্ট। হাতে দুটো আংটি। পায়ে চামড়ার চটি। স্বাস্থ্য ভালোর দিকেই। মুখে সুপুড়ি চেবাতে চেবাতে গাল টোপলা করেই বলতে শুরু করলেন নাসির ভাই। "আমি কী করি, সেটা পাড়াপড়শির কাছে বলতে পারি না। এখানে নর্দমায় নেমে যাই। ধুলো ঘাঁটি। নিজের পাড়ায় আমি রাজা। দিনে হাজার টাকার রোজগার আমার। মাসে হিসাব করুন। বছরে লাখ টাকার ওপর।" মুখ থেকে পিক ফেলে এবার ফুটপাথেই বসে পড়লেন নাসির ভাই। "ওই যে আমার ছেলে ফারদিন। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়ল। আর পড়ল না। তারপর থেকে আমার সঙ্গেই থাকে, এই কাজ করে। আমার শরীর খারাপ হয়েছিল, একবছর কাজই করতে পারেনি আমি। তখন তো ওই সংসার চালালো"। হঠাৎ আমার দিকে প্রশ্ন, আপনি জেনে কী করবেন? আমি একজন সাংবাদিক। নিজের পেশার পরিচয় দেওয়ার পরই নাসির ভাই খানিক থামলেন। আমার মুখ টুখ দেখাবেন না তো। আমি হেসে বললাম 'না'। প্রশ্ন করলাম, আপনি তো বেআইনি কাজ করছেন না, তাহলে মুখ সামনে আসলে লজ্জা কীসের? উত্তর এল, "বাবু, আমার পরিবার জানে আমি এই কাজ করি। কিন্তু আর কেউ জানলে সমাজ আমাকে মেনে নেবে? আমি তাজ হোটেলে পর্যন্ত গিয়েছি। এই কাজের কথা শুনলে যেতে পারব"?
কীভাবে কাজ চলে? "এই তো, সিঁথির মোড়, গড়িয়াহাট, বৌবাজার থেকে ধুলো নিয়ে হাওড়া ফরসোর রোড ঘাটে গিয়ে ধুয়ে দিই। ওখানেই সোনা গালানো হয়। এই সোনাই টঞ্চ হয়ে যায় (২২ ক্যারেট)। দিনে হাজার টাকার রোজগার। রোজ কাজ না করলেও হেসে খেলে ১০ হাজার টাকা রোজগার হাসতে হাসতে হয়ে যায়", অনর্গল বলছেন নাসির ভাই। এরপর যা বললেন তাতে আমি হতবাক। "ব্যাংকক থেকে লোক এসছিল এই ধুলো কিনতে। লরি লরি সোনা নেবে, লাখ লাখ টাকা দেবে। কসম্যাটিক্সের জন্য ব্যবহার করবে"। সত্যি? হেসে নাসির ভাই বললেন একদিন এসো সব দেখাবো। ঘণ্টা দুয়েকের আড্ডা। মনে মনে ভাবছি একটা এক্সক্লুসিভ পেলাম তবে। কিন্তু মনকে নাড়িয়ে দিল নাসির ভাইয়ের মুখ থেকে আসা শেষ লাইনটা, "আলাদা করে আলস্কায় যেতে হবে না। কলকাতাতেই আছে সোনা। খুঁজলে তো আল্লাহ্ মেলে, আর এতো মাত্র সোনা"।