বেআইনি ভাবে রান্নার গ্যাস ব্যবহার করে চলছে অটো-EXCLUSIVE
বেআইনি ভাবে রান্নার গ্যাস ব্যবহার করে চলছে অটো। কলকাতা এবং সংলগ্ন এলাকার অটোর সিংগভাগই চলছে কাটা-গ্যাস ব্যবহার করে। বিভিন্ন এলাকায় ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে রান্নার গ্যাস অটোয় ভরার ফিলিং স্টেশন। চক্রে সামিল এলপিজি ডিলারদের একটা বড় অংশ। কীভাবে পুলিসের নাকের ডগায় চলছে বেআইনি কারবার?
এলপিজি-র কালোবাজারি রুখতে চালু হয়েছে মোবাইল ফোনে গ্যাস বুকিং। উপভোক্তারা ফোন করে কনজিউমার নম্বর জানালেই স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় বুকিং হয়ে যাচ্ছে। কবে তিনি সিলিন্ডার পাবেন, তাও এসএমএসে আগাম জানতে পারছেন উপভোক্তারা। অর্থাত সাদা চোখে দেখলে, রান্নার গ্যাস নিয়ে কালোবাজারির সুযোগ নেই। কিন্তু এই ব্যবস্থার ফাঁক গলেই কলকাতা জুড়ে ব্যাপক ভাবে চলছে রান্নার গ্যাস অটোয় ভরার বেআইনি কারবার।
বেআইনি কারবারের ডেরা চিনতে অসুবিধা হয়না। বাসন্তি হাইওয়ের জলপথ মোড় থেকে বিভিন্ন রুটের শয়ে শয়ে অটো বেঁকে যাচ্ছে ডানদিকে। খেয়াদহের দিকে। ডেরার খবর আগে থেকেই ছিল আমাদের কাছে। গ্যাস ভরাতে যাওয়া এরকমই একটি অটো-র পিছু নিয়ে আমরা পৌছে যাই মূল ডেরায়। বেড়া দিয়ে ঘেরা টালির চালের ছোট্ট ঘর। সামনে বিভিন্ন রুটের অটোর লম্বা লাইন। ঘরের মধ্যে থেকে বাইরে বেরিয়ে রয়েছে সরু একটি নল।
একের পর এক অটোয় ভরা হচ্ছে গ্যাস। ঘরের সামনে মোটর-ভ্যান, মিনিডোরে বোঝাই হিন্দুস্থান পেট্রোলিয়ামের রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডার। দোকান ঘিরে দশ-পনেরো জন যুবকের সতর্ক নজরদারি। নজরদারি চালছে দোকানের কয়েকশো মিটার দূর থেকেও। বাইকে বসে নজরদারি চালাচ্ছে জনা পাঁচেক যুবক। সন্দেহজনক কিছু দেখলেই খবর চলে যায় মূল ডেরায়। ঝাঁপ পড়ে যায় দোকানের।
বেআইনি কারবারিদের নজরদারি টপকে, বিস্তর জবাবদিহি করে অবশেষে পৌছনো গেল মূল ডেরায়। অটো মালিক পরিচয় দিয়ে কথা বলার সুযোগ মিলল বেআইনি গ্যাসের কারবারির সঙ্গে।
এক কেজি রান্নার গ্যাসের দাম ৬০ টাকা। আটোর সংখ্যা এক হোক বা একশো। এখান থেকে আটোয় গ্যাস ভরাতে হলে দামে কোনও ছাড় মিলবে না। রেট ফিক্সড । নিজেকে মালিক বলে পরিচয় দিয়ে জানালেন রাহুল নামের এক যুবক।
সিলিন্ডার থেকে বের করে, বৈদ্যুতিন ওজন যন্ত্রে মেপে তবেই গ্যাস ভরা হয় অটোয়। ওজনে কোনও কারচুপি করা হয় না। আশ্বস্ত করলেন দোকান মালিক।
শাঁসালো খদ্দের মিলেছে, এই ভেবে এরপর নিজেই নিয়ে গেলেন রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডার থেকে কীভাবে অটোয় গ্যাস ভরা হচ্ছে তা ঘুরে দেখাতে।
কুড়ি ফুট বাই কুড়ি ফুট ঘর। রয়েছে ওজন মাপার তিনটে বৈদ্যুতিনযন্ত্র। কাজ করছেন তিনজন। দোকানের ভেতর থেকে বাইরে বেরিয়ে রয়েছে একটি নল। ওই নল দিয়ে রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডার থেকে গ্যাস চলে যাচ্ছে অটোর
ট্যাঙ্কে।
ফুল প্রুফ সিস্টেম। একটি ওজন মাপার যন্ত্রে উল্টো করে বসানো রান্নার গ্যাসের ভর্তি সিলিন্ডার। এভাবে মাপা হয় সিলিন্ডারের আসল ওজন। এরপর পাম্পারের সাহায্যে গ্যাস বের করে তা পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে পাশের একটি খালি সিলিন্ডারে। ভরা সিলিন্ডার থেকে ক-কেজি গ্যাস খালি সিলিন্ডারে এলো, তা ফুটে উঠছে সিলিন্ডারের নিচে রাখা ওজন মাপার যন্ত্রে। দ্বিতীয় সিলিন্ডারের গ্যাস ফের পাম্প করে পাঠানো হচ্ছে তৃতীয় সিলিন্ডারে। এই সিলিন্ডারটিও রাখা হয়েছে আরেকটি ওজন মাপার যন্ত্রের ওপর। তৃতীয় সিলিন্ডার থেকে পাম্প করে নল দিয়ে রান্নার গ্যাস পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে অটোয়। তৃতীয় যন্ত্রের স্ক্রীনে চোখ রেখে অটো চালক বুঝে নিচ্ছেন, ট্যাঙ্কে কতটা গ্যাস পৌছল। কারবার বেআইনি হলেও, অটো চালকদের প্রতারিত হতে হয় না।
একটি এলপিজি সিলিন্ডার খালি হলে, পাশের স্টোর রুম থেকে চলে আসছে আরেকটি ভর্তি সিলিন্ডার। রমরমা কারবার। নিমেশে খালি হচ্ছে দশ-বারোটি সিলিন্ডার। দোকানে সর্বক্ষণের জন্য হাজির গ্যাস সংস্থার কোনও না কোনও ডেলিভারি ম্যান। খালি সিলিন্ডারগুলি মিনিডোর, মোটর ভ্যানে করে চলে যাচ্ছে গোডাউনে। তার জায়গায় কয়েক মিনিটের মধ্যে দোকানের স্টোর রুমে চলে আসছে নতুন ভর্তি সিলিন্ডার।
বামনঘাটা থেকে এরপর আমরা হাজির হই, নরেন্দ্রপুরের কামালগাজি এলাকায়। কুমড়োখালি, কুসুম্বা, কাদারাট। কোথাও গ্যারাজ, কোথাও লেদ কারখানার আড়ালে চলছে এই বেআইনি ব্যবসা।
যাদবপুর, সন্তোষপুর, গড়িয়া, বাঘাযতীন, সোনারপুর, টালিগঞ্জ রুটের অটো চালকদের ভরসা কুমড়োখালির এই কারখানা। ব্যবসা দেখভাল করেন রাজা নামের এই যুবক। বামনঘাটার তুলনায় এখানে রান্নার গ্যাসের দাম কিছুটা কম। কেজি প্রতি এলপিজি-র দাম পঞ্চান্ন টাকা। ধার-বাকির কারবার নেই। মালিকের যতগুলি অটোই থাকুক, রোজের টাকা রোজ মিটিয়ে দিতে হবে। এটাই শর্ত।
কুমড়োখালি থেকে কিছুটা গেলেই কুসুম্বা। ঘন জনবসতিপূর্ণ এলাকা কুসুম্বার একটি লেদ কারখানায় রমরমিয়ে চলছে রান্নার গ্যাস অটোয় ভরার কারবার। মূল পাণ্ডা রুস্তম। রুস্তমের দেখা না মিললেও, কারখানায় গিয়ে দেখা গেল এলপিজি সিলিন্ডার, ইলেকট্রনিক ওজন যন্ত্র, সিলিন্ডার থেকে গ্যাস বের করার পাম্প, সবই দিব্যি মজুত রয়েছে।