Buddhadeb Bhattacharya Death: তাঁর স্বর্গে কি মহাবিশৃঙ্খলাই বিরাজ করে গেল? লালের দীপ্তি নয়, যেন সাদারই ট্র্যাজেডি...
Buddhadeb Bhattacharya Death: তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের সালতামামির মধ্যে তো সব কিছু ধরা পড়ে না। সেই হিসেবনিকেশে আসল মানুষটার রং-চেহারা-মনের তেমন কোনও হদিসই মেলে না। কেননা বুদ্ধদেব তো শুধু রাজনীতিবিদ নন। তিনি সংস্কৃতিমনস্ক, তিনি কবি, তিনি নাট্যকার। বরাবর তাঁর একটা অন্যরকম মনোভাবনা পাশাপাশি বয়ে চলেছিল। রাজনীতিচর্চার পাশাপাশি সাহিত্য় ও মননের নিবিড় চর্চাও করে গিয়েছেন।
সৌমিত্র সেন: লাল হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ঘটনাচক্রে বিষয়টি সাদা।
হ্যাঁ, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রসঙ্গ উঠলেই ঝট করে যেন 'সাদা' শব্দটিই মনে আসে। সাদা ধুতি, সাদা পাঞ্জাবি, সাদা চুল। এবং ভাবমূর্তিও আপাদমস্তক সাদা। সত্যি বলতে কি, এক সুভদ্র সুন্দর অকলঙ্ক শিক্ষিত রুচিশীল নিপাট বাঙালি রাজনীতিবিদের যেন শেষ প্রতিভূ ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। প্রয়াত হলেন আশি বছর বয়সে। চলে গেলেন ৮ অগস্ট, রবীন্দ্রপ্রয়াণদিনের ঠিক পরের দিন-- ২৩ শ্রাবণে। তাঁর মৃত্যুতে পশ্চিমবাংলার সংসদীয় রাজনৈতিক ইতিহাসের নিরুচ্চার একটি অধ্যায় নীরবেই শেষ হয়ে গেল।
১৯৪৪ সালের ১ মার্চ উত্তর কলকাতায় জন্ম বুদ্ধদেবের। ঠাকুরদাদা ছিলেন এক মহাপণ্ডিত মানুষ সংস্কৃতজ্ঞ কৃষ্ণচন্দ্র স্মৃতিতীর্থ-- যাঁর 'পুরোহিত দর্পণ' বইটি পৌরহিত্যকর্মের প্রায় বাইবেল হিসেবে স্বীকৃত। আর এ তো সর্বজনবিদিত যে, কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য বুদ্ধদেবের কাকা। সুকান্ত ছিলেন বুদ্ধদেবের বাবা নেপালচন্দ্রের খুড়তুতো ভাই। শ্যামপুকুরের শৈলেন্দ্র সরকার স্কুলেই পড়াশোনা বুদ্ধদেবের। পরের পড়াশোনা প্রেসিডেন্সি (তৎকালীন) কলেজে। তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় 'দম দম আদর্শ বিদ্যামন্দিরে' শিক্ষকতা দিয়ে।
তবে পারিবারিক সূত্রেই বামপন্থার দিকে ঝুঁকে থাকাটা ছিল। তাই কলেজজীবনেই বামপন্থী রাজনীতিতে যোগদান। দলেও। ক্রমে দলের যুবশাখার সম্পাদক। আরও পরে খাদ্য আন্দোলন ও ভিয়েতনাম-পর্বে তাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকার কথা স্বীকৃত। ১৯৭৭ সালে জ্যোতি বসুর মন্ত্রিসভায় তথ্য ও জনসংযোগ বিভাগের দায়িত্ব। পরে দীর্ঘদিন তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের দায়িত্বে। ১৯৯১ সালে মন্ত্রিসভা ত্যাগ-- 'চোরেদের মন্ত্রিসভায় থাকব না' বলে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। তবে পরিস্থিতির বদল ঘটে। ১৯৯৬ সালের পরের দিকে দলের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি। এবং আবার নতুন উদ্যমে সরকারে অংশগ্রহণ। ২০০০ সালে মুখ্যমন্ত্রিত্বলাভ। তবে ২০১১ সালে সিপিএম ভোটে হারলে রাজ্য়পাট শেষ হয় তাঁর। তারপর থেকেই তিনি ধীরে ধীরে যেন শুধু বঙ্গ-রাজনীতি নয়, জনমন থেকেও হারিয়ে যেতে থাকলেন।
এই হল খুব সংক্ষেপে তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের সালতামামি। কিন্তু সেই হিসেবনিকেশে আসল মানুষটার রং-চেহারা-মনের তেমন কোনও হদিস বোধ হয় মেলে না।
কেননা বুদ্ধদেব তো শুধু রাজনীতিবিদ নন। তিনি সংস্কৃতিমনস্ক, তিনি কবি, তিনি নাট্যকার। বরাবর তাঁর একটা অন্যরকম মনোভাবনা পাশাপাশি বয়ে চলেছিল। রাজনীতিচর্চার পাশাপাশি সাহিত্য় ও মননের নিবিড় চর্চাও করে গিয়েছেন। এর সাম্প্রতিকতম দৃষ্টান্ত সম্ভবত 'স্বর্গের নীচে মহাবিশৃঙ্খলা' বইটি। যথেষ্ট অসুস্থতার মধ্যেই চিন-সম্পর্কিত বইটির কাজ শেষ করেছিলেন তিনি।
তবে, সাম্প্রতিকের তো আদিও থাকে। বুদ্ধবাবুর ক্ষেত্রেও আছে সেই আদি। তিন দশক আগে এই কলকাতা দেখেছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিহীনতার এক তপ্ত উত্তেজিত রক্তাক্ত ছবি। তবে তা শেষপর্যন্ত হাতের বাইরে চলে যায়নি। সেই পরিস্থিতি বুদ্ধবাবুর ব্যক্তিগত রাজনৈতিক জীবনেও ছায়া ফেলেছিল। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সঙ্গে তাঁর তীব্র মতবিরোধ ঘটেছিল। এতটাই যে, মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। আর সেই অশান্ত শহর ও ক্ষুব্ধ ব্যক্তিমনের অবস্থা নিয়ে লিখে ফেলেছিলেন 'দুঃসময়' নামের আস্ত এক নাটক! রাতারাতি সেই নাটক ছাপ ফেলেছিল গণপরিসরে, গণমনেও।
এটা একটা ঐতিহ্য। এটা একটা সংস্কৃতি। গণমুখী জনচর্চিত রাজনৈতিক জীবনের পাশাপাশি লেখার-ভাবার-মতপ্রকাশের জন্য সমান্তরাল একটা 'মন'কে অক্ষুব্ধ ভাবে বাঁচিয়ে রাখার এই দৃষ্টান্ত শেষ কয়েক দশকে বাংলায় খুব বেশি দেখেননি সাধারণ মানুষ। বুদ্ধদেব সেই বিরলের মধ্যে ঢুকে পড়েছেন।
উল্টো দিক থেকে দেখতে গেলে, সমালোচকদের একাংশের মত, বুদ্ধদেবের ওই সাংস্কৃতিক 'মাইন্ডসেট', মননচর্চার ওই 'অ্যাটিটিউড'ই বোধ হয় শেষ পর্যন্ত তাঁকে খুব সফল এবং ছাপ-রেখে-যাওয়া একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠতে দিল না। যদি অ্যাচিভমেন্টের প্রশ্ন ওঠে, তবে বলতেই হয়, রাজ্য-কেন্দ্রিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের পক্ষে যা চূড়ান্ত, সেই মুখ্যমন্ত্রিত্বের পদ তিনি পেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর আগে-পরের দুই 'ইলাসট্রিয়াস' ব্যক্তি, পূর্বসূরী জ্যোতি বসু এবং উত্তরসূরী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তুলনায় তিনি যেন অনেকটাই নিষ্প্রভ, ডি-গ্ল্যামারাইজড, মৃদু, জনবিচ্ছিন্ন। তিনি যেন সকলের কাছে থেকেও দূর রচনা করে রেখেছেন পরিকরদের থেকে। আর সেটাই তাঁকে ক্রমশ রাজনৈতিকতার কেন্দ্র থেকে পরিধির দিকে ঠেলে দিয়েছিল।
কেন দিয়েছিল? তার অনেক কারণ। তবে মূল দু'টি কারণ উল্লেখ করা দরকার। বুদ্ধদেবের রাজনৈতিক জীবনে বড় 'সেটব্যাক' সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রাম। সিঙ্গুরে টাটার কারখানার জমি অধিগ্রহণের সময় যখন কৃষিজমি রক্ষার আন্দোলন দানা বাঁধল, তখন থেকেই অতি আক্রমণাত্মক তিনি। সমালোচকদের অভিমত, কার্যত গায়ের জোরে কাজ হাসিল করতে চেয়েছিল বুদ্ধদেব সরকার। তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন অনশনে। অথচ তাঁর সঙ্গে আলোচনায় বসার দূরদর্শিতা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন বুদ্ধদেব। নন্দীগ্রামে কেমিকেল হাব নিয়েও একই ব্যাপার। একদিকে তাঁর পার্টিরই ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে, আরেক দিকে লক্ষ্মণ শেঠ, বিনয় কোঙারের মতো দুর্মুখ নেতারা নানা বাঁকা বিবৃতি দিয়ে পরিস্থিতি জটিল করে তুলছিলেন।
মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এর কোনও প্রতিকার করেননি। অথচ প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে তাঁর উপর প্রভূত দায়িত্ব ছিল, তাঁকে ঘিরে মানুষের প্রত্যাশাও ছিল অনেক। সব আশায় জল ঢেলে তিনি বেসুরো গাইলেন। সিঙ্গুর-প্রশ্নে তৎকালীন বিরোধীদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বুদ্ধবাবু বলে ফেলেছিলেন 'আমরা ২৩৫, ওরা ৩০'! নন্দীগ্রাম-ইস্যুতে পুলিসের গুলিচালানো ও মানুষের মৃত্যুপ্রসঙ্গে অবলীলায় বলে দিয়েছিলেন-- 'দে পেইড ব্যাক ইন দেয়্যার ওন কয়েন'! তাঁর সাংস্কৃতিক মাইন্ডসেট কিন্তু তাঁকে দিয়ে গণরাজনীতির মঞ্চে অন্য উন্নত কিছু করাতে পারল না।
অথচ, করানোর ক্ষেত্র তো প্রস্তুত ছিল। জীবনের প্রথম পর্বেই তিনি অনুবাদ করে ফেলেছিলেন বিদেশি কবিদের রাজনৈতিক ভাবনাময় সব কাব্যকথা। 'চেনা ফুলের গন্ধ' নামের সেই বইয়ে ছিল পাবলো নেরুদা থেকে চে গ্যেভারার রচনা। সেখানে আমরা এমন সব পঙক্তিও তো পেয়েছিলাম-- 'অতৃপ্ত ঢেউয়ের শব্দ/ঠেলে দেয় সত্যের মুখোমুখি আমায়/ ব্যাখ্যার কিছু নেই/ বলারও কিছু নেই, এই সব/ অরণ্যের দরজাগুলি বন্ধ সব/ সূর্য পরিক্রমা করে, জাগাতে গাছের পাতা/ চাঁদ উঠছে সাদা ফলের মতন/ মানুষ নিচু করছে মাথা/ ভবিতব্যের কাছে'! আমরা পেয়ে যাই এমন লাইনও-- 'তুমি বলেছিলে সূর্য উঠবে,/ চলো যাই,/ সেই সব অজানা পথ ধরে/ মুক্ত করতে তোমার প্রিয়/ কুমির-গড়ন সবুজ স্বদেশ' .....চলো যাই/ সব অপমান ছুঁড়ে ফেলে --/ চোখের উপর অন্ধকার বিদ্রোহী তারা/ আমরা জিতব,/ মৃত্যুকে হঠাব বন্দুকের মুখে'!
অথচ তাঁর রাজ্যের কিছু মানুষ যখন মাথা নিচু করল তিনি তাঁদের সেই নিচু-মাথা তুলে ধরার জন্য স্বরচিত 'আমরা-ওরা'ত্ব থেকে বেরিয়ে এসে অনন্য ভূমিকা নিতে ব্যর্থ হলেন, যে ভূমিকা নিয়েই সাধারণত ইতিহাসের পাতায় নিজেদের অমর করে রেখে যান জননেতারা। এ-ও যেন তাঁর রচিত গ্রন্থের শিরোনামের মতোই। স্বর্গের আবহ প্রস্তুত ছিলই; কিন্তু সেখানে বরাবর এক মহাবিশৃঙ্খলাই বিরাজ করে গেল! লালের উদ্দাম দীপ্তি নয়, যেন আদ্যন্ত সাদারই ট্র্যাজেডি!
(দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির টাটকা খবর, আপডেট এবং ভিডিয়ো পেতে ডাউনলোড-লাইক-ফলো-সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের App, Facebook, Whatsapp Channel, X (Twitter), Youtube, Instagram পেজ-চ্যানেল)