যুগের হাওয়ায় মন্দির কমিটিতে 'ধর্মনিরপেক্ষ ভক্ত'-এর সওয়াল সিপিএমের
২০১৩ দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদকে সরিয়ে সামাজিক রীতিনীতি পালনের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন গৌতম দেব।
নিজস্ব প্রতিবেদন: রাজ্যে সঙ্ঘ, বিজেপির মেরুকরণ রুখতে হবে। আর সে কারণে মন্দিরের দ্বারস্থ হতে চলেছে সিপিএম। ধর্মের ছুত্মার্গ সরিয়ে রেখে মন্দির পরিচালন কমিটিতে হস্তক্ষেপের ভাবনা আলিমুদ্দিনের।
কার্ল মার্ক্সের 'ধর্ম আফিম' বুলিই রাজ্যে শোনাতেন সিপিএম নেতানেত্রীরা। সেই 'ধর্মাভিমানে' আঘাতে হেনেছিলেন প্রয়াত সুভাষ চক্রবর্তী। তারাপীঠে গিয়ে পুজো দিয়েছিলেন। দলের অন্দরে পড়ে গিয়েছিল হইচই। তখন জ্যোতি বসু পর্যন্ত বলেছিলেন,''ওর মাথায় খারাপ হয়েছে। ওকে মৃত্যুভয় ধরেছে।'' বিনয় চৌধুরী তিরুপতি মন্দিরে ঢোকেননি। বাইরেই দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু কারণ দর্শাতে বলেছিল সিপিএম। সে এক যুগ ছিল! এখন তো কে বড় শিবভক্ত আর কে বড় হনুমানভক্ত? তার লড়াই চলছে। এ বলে আমি, ও বলে আমায় দেখ। আইআইটি পাশ মুখ্যমন্ত্রীর মুখেও তাই 'জয় হনুমান'। যুগের হওয়া বুঝে ধর্মে মতি ফিরছে সিপিএমের?
ধর্ম বা ধর্মীয় উপাচার থেকে দূরত্বই রাখে বামপন্থী দলগুলি। তবে ২০১৩ দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদকে সরিয়ে সামাজিক রীতিনীতি পালনের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন গৌতম দেব। তিনি বলেছিলেন,''কেরলের কমরেডরা তো গির্জায় যান। এরাজ্যেও চাইলে পুজো-অর্চনা করতে পারেন সিপিএমের সদস্যরা।'' তারপর ধীরে ধীরে আলগা হয়েছে বাঁধন। এখন সিপিএম নেতাদের দুর্গাপুজোর উদ্বোধনেও দেখা যায়। কিন্তু আরএসএস-বিজেপির মেরুকরণের রাজনীতি রুখতে এবার কি মন্দিরের ভিতর মাথা গলাতে চায় ভারতের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি? দলীয় কর্মীদের দেওয়া গোপন চিঠিতে এই প্রশ্ন জোরালো হয়েছে। লেখা হয়েছে- ধার্মিকতার ব্যাপক বৃদ্ধি ঘটেছে, যে ক্ষেত্রে আরএসএস এবং হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলি মদত জুগিয়েছে। এটা আবার আরএসএস-বিজেপি'কে সাম্প্রদায়িক চেতনা এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদী মানসিকতা গড়ে তুলতে উর্বর জমি সরবরাহ করেছে। আরএসএস তাদের মতাদর্শগত ও হিন্দুত্ববাদী প্রচার পরিচালনার জন্য মন্দির ও অন্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলিকে ব্যবহার করে। স্থানীয় দেবতা ও মন্দিরকে কেন্দ্র করে উত্সবগুলিকে আত্মসাত্ করা হয়েছে এবং নির্দিষ্ট রং দেওয়া হয়েছে।
এর মোকাবিলা করতে গিয়ে ধর্ম এবং ধর্মস্থানকে আর অচ্ছুত রাখতে চায় না সিপিএম। পার্টি কর্মীদের দেওয়া গোপন চিঠিতে লেখা হয়েছে- মন্দির এবং অন্যান্য ধর্মীয় স্থানগুলিকে আরএসএস এবং তার বিভিন্ন সংগঠনগুলির দয়ার ওপর ছেড়ে দেওয়া যায় না। এর জন্য পদক্ষেপ করতে হবে। যেখানে তাঁরা হস্তক্ষেপ করতে সমর্থ সেখানে মন্দির পরিচালনায় ধর্মনিরপেক্ষ মানসিকতা সম্পন্ন বিশ্বাসী অথবা ভক্তরা যাতে থাকতে পারে তা দেখতে হবে। কেরলে এই ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এবং তা কার্যকর হয়েছে। সঙ্ঘ-বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতি রুখতে তাহলে কি মন্দির পরিচালন কমিটিতে হস্তক্ষেপ করবে সিপিএম? গোপন চিঠির বয়ান থেকে এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।
ধর্মীয় উত্সব সামাজিকতার নিরিখে জনসংযোগের বড় মঞ্চ। গোপন চিঠিতে সেকথা উল্লেখ করে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। লেখা হয়েছে, অনেকগুলি উত্সব যেগুলি দেবতা এবং মন্দিরের সাথে যুক্ত সেগুলির সামাজিক চরিত্রও রয়েছে। দল ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ না করে প্রাথমিক শুশ্রুষা, বইয়ের স্টল, পানীয় জল ও অন্যান্য সুবিধার ব্যবস্থা করতে পারে।
তবে ধর্ম নিয়ে রাজনীতিতে আপাতত কয়েক যোজন এগিয়ে ভারতীয় জনতা পার্টি। তারা জন্মলগ্নে বাজপেয়ীর ঠেলায় 'সেকুলার' পথ ধরেছিল। কিন্তু প্রথম লড়াইয়ে লোকসভায় ২টি আসনপ্রাপ্তির পর আডবাণীর হিন্দুত্বের লাইনে পাকাপাকিভাবে চলে যায় বিজেপি। রাম মন্দির আন্দোলনকে ঘিরে তাদের উত্থান। সেদিনের ২ সাংসদের দল আজ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দিল্লির তখতে। ফলে বিজেপির লুকোছাপার ব্যাপার নেই। আর নিন্দুকরা তো বলেই থাকে, হিন্দুত্বের কপিরাইট রয়েছে এখন বিজেপির হাতে। তারাই ঠিক করে দেয়, কে 'সহি হিন্দু'? ফলে প্রশ্ন ওঠাটা স্বাভাবিক, বিজেপির মাঠে নেমে কি আদৌ সাফল্য আসবে সিপিএমের? শেষপর্যন্ত না শ্যাম ও কূল দুই-ই যায়। যেমনটা এক 'শিবভক্ত'-এর সঙ্গে হয়েছে।
আরও পড়ুন- গোলি মারো, ভারত-পাকিস্তান বলা উচিত হয়নি, দিল্লিতে গোহারা হয়ে বোধোদয় অমিতের