ভারতবর্ষ নিয়ে কোনওদিনও লিখব না: জেফরি আর্চার

হাউস অফ লর্ডস থেকে বেলমার্শ জেল। জন মেজর প্রদত্ত আজীবন পিয়েরেজ থেকে বিপজ্জনক আসামী FF 8282 হয়ে তিন তিনটে বছর। সম্ভ্রান্ত সাউথ কেন্সিংটনের পাঁচ কামরার বাংলো থেকে কপর্দক শূন্য হয়ে মধ্যবিত্ত জীবন। দেউলিয়া হতে হতেও কেন অ্যান্ড এবেল-এর হাত ধরে হঠাৎ সাফল্যে। এক কথায় বর্ণময়তার এপিটোম লর্ড জেফরি হওয়ার্ড আর্চার। তবে লেখক নয়, নিজেকে কথক হিসেবে পরিচয় দিতেই তিনি বেশি স্বচ্ছন্দ। আর পাঁচজন `অ্যাংলো-স্যাক্সন` কেতাদুরস্ত সেলিব্রিটি থেকে একটু আলাদা। জীবনের ছন্দপতন নিয়ে কোনও দ্বিচারিতা নেই। অকপটে লিখে গিয়েছেন কারাবাসের অভিজ্ঞতা। তিন ভল্যুম `প্রিজন ডায়রি`র পাশাপাশি `ক্যাট-ও-নাইন-টেল-এ` উঠে এসেছে সহ বন্দি ছিঁচকে চোর, গাঁজাখোর, ভাড়াটে-খুনি থেকে হতদরিদ্র, অসহায়, গৃহহীনদের জীবন-চরিত। পাঠককূলের রসনা তৃপ্ত করেছেন আমি-ওদের-চেয়ে-ভাল-বন্দির ভণিতা না করেই। `কেন অ্যান্ড এবেল`এর যুগ পেরিয়ে এখন জেফরির কলমে সাম্রাজ্য বিস্তার করছে `ক্লিফটন ক্রনিক্‌ল`। তার মাঝখানে কলকাতায় কয়েকদিন। ক্যালকাটা স্যুইমিং ক্লাবে সন্ধেয় টক-শো-এর আগে শময়িতা চক্রবর্তী ও শর্মিলা মাইতির মুখোমুখি জেফরি আর্চার।

Updated By: Dec 18, 2012, 04:14 PM IST

হাউস অফ লর্ডস থেকে বেলমার্শ জেল। জন মেজর প্রদত্ত আজীবন পিয়েরেজ থেকে বিপজ্জনক আসামী FF 8282 হয়ে তিন তিনটে বছর। সম্ভ্রান্ত সাউথ কেন্সিংটনের পাঁচ কামরার বাংলো থেকে কপর্দক শূন্য হয়ে মধ্যবিত্ত জীবন। দেউলিয়া হতে হতেও কেন অ্যান্ড এবেল-এর হাত ধরে হঠাৎ সাফল্যে। এক কথায় বর্ণময়তার এপিটোম লর্ড জেফরি হওয়ার্ড আর্চার। তবে লেখক নয়, নিজেকে কথক হিসেবে পরিচয় দিতেই তিনি বেশি স্বচ্ছন্দ। আর পাঁচজন 'অ্যাংলো-স্যাক্সন' কেতাদুরস্ত সেলিব্রিটি থেকে একটু আলাদা। জীবনের ছন্দপতন নিয়ে কোনও দ্বিচারিতা নেই। অকপটে লিখে গিয়েছেন কারাবাসের অভিজ্ঞতা। তিন ভল্যুম 'প্রিজন ডায়রি'র পাশাপাশি 'ক্যাট-ও-নাইন-টেল-এ' উঠে এসেছে সহ বন্দি ছিঁচকে চোর, গাঁজাখোর, ভাড়াটে-খুনি থেকে হতদরিদ্র, অসহায়, গৃহহীনদের জীবন-চরিত। পাঠককূলের রসনা তৃপ্ত করেছেন আমি-ওদের-চেয়ে-ভাল-বন্দির ভণিতা না করেই। 'কেন অ্যান্ড এবেল'এর যুগ পেরিয়ে এখন জেফরির কলমে সাম্রাজ্য বিস্তার করছে 'ক্লিফটন ক্রনিক্‌ল'। তার মাঝখানে কলকাতায় কয়েকদিন। ক্যালকাটা স্যুইমিং ক্লাবে সন্ধেয় টক-শো-এর আগে শময়িতা চক্রবর্তী ও শর্মিলা মাইতির মুখোমুখি জেফরি আর্চার।
লেখক হিসেবে আপনাকে তো ঠিক ব্রিটিশ ঘরানার ঘেরাটোপে বাঁধা যাবে না। আন্তর্জাতিকতাই কি ভারতবর্ষে আপনার জনপ্রিয়তার চাবিকাঠি?
আমি লেখক নই। আমি গল্প বলি। লেখকরা অনেক পড়াশোনা করেন। আমি শুধুই গল্প বানাই। দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়িয়ে আমি লিখি। ভারতে আমার পাঠককুল প্রায় সোনার খনির মতো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থেকেও বেশি সংখ্যক পাঠক ভারতে।
এ শহরে আপনার ফ্যান তো আপনার নিজের শহরের থেকেও বেশি...
ভারতবর্ষের সব থেকে মজা কি জানেন তো? প্রায় ২৫০ মিলিয়ন লোক ইংরেজি ভাষার বই পড়েন। সবাই যে আসল বইটাই কেনেন তা নয়। এ দেশে নকল বইয়ের বাজারও খুব বড়। তাও এ দেশে বইয়ের বাজার বিরাট। আরেকটা মজা হল, অঙ্কের হিসেবে ইংল্যান্ডে ২.৩ জন একটি বই পড়েন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটা বই কিনে ২.৪ জন পড়েন। ভারতে আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব সবাই একটা বই কিনে শেয়ার করে পড়েন। ফলে বই প্রতি পাঠকের সংখ্যাটা ১০ থেকে ১২ জনে গিয়ে দাঁড়ায়। যে কোনও লেখক এটাই চান, যেন তাঁর বই পড়া হয়।
আপনি কি জানেন বলিউডের অনেক সিনেমাই জেফরি আর্চারের গল্প অবলম্বনে। বলা যায়, থ্রিলার মানেই একটা আনরিটন ট্রিবিউট টু জেফরি আর্চার। আপনার গল্প অবলম্বনে সিনেমা হয়েছে?
(উত্তেজিত) হ্যাঁ আমি জানি বলিউড চুরি করেছে। আমি জানি ওরা 'নট আ পেনি মোর নট আ পেনি লেস' চুরি করেছে। আমি জানি ওরা 'কেন অ্যান্ড এবেল' চুরি করেছে। আমি জানি ওরা আমার সব গল্প পড়ে। থ্রিলার বানানোর আগে লুকিয়ে আমার উপন্যাস পড়ে। চুরিও করে। উইকেড বলিউড! উইকেড! উইকেড! (ভুরু কুঁচকে বলেই হাসি ফিরিয়ে আনেন ঠোঁটে) দুষ্টু বলিউড!

সেকি? আপনি বলিউডকে উইকেড বললেন? বিটার-সুইট স্টেটমেন্ট বলা চলে কি এটাকে?

না, না। বলিউড খুবই ভাল। পৃথিবীর সব সিনেমাপ্রেমীই এই ইন্ডাস্ট্রিকে চেনে। সবাই জানে বলিউড বিশ্বের বাজারে খুব সফলও। কিন্তু কোনও কোনও নির্দেশক চুরি করেন। অবশ্যই করেন।

কিন্তু এই টেকনোলজিক্যাল অ্যাডভান্সমেন্টের যুগে যখন সারা বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডার সকলের নখের ডগায়। আপনি কীভাবে চুরি আটকাবেন? পাইরেসি আটকানো কী সম্ভব?
(চিন্তান্বিত মুখে) ঠিকই বলেছেন। আটকানো সম্ভব নয়। আই এগ্রি। পাইরেসি নিয়ে কিছু করার নেই। এটা অসম্মানজনক এবং অনৈতিক। তাও ঘটবে। কিছু করার নেই। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারি। গোটা দুনিয়া যেভাবে টেকনোলজিকে আপন করে নিয়েছে, সেভাবে আমিও চেষ্টা করি।
এমনও একদিন আসবে যেদিন লেখকের কলম বলে আর কিছুই থাকবে না। কলম একটা আর্টপিস হবে। শুধু কিবোর্ডে আঙুল ব্যবহার করে সবাই লিখবেন। কাগজ একেবারেই উঠে যাবে। জেফরি আর্চারের পেপারব্যাক বেস্টসেলার হবে না।
হুঁ। সে দিনটা খুব শিগগিরই আসবে জানি। কিন্তু জানেন, বইয়ের ব্যাপারে আমি এখনও নস্ট্যালজিক। পেপারব্যাক-এর গন্ধ নিতে এখনও ভালবাসি আমি।
এই ইলেকট্রনিক বই-এর জগতে পেপারব্যাক এর ভবিষ্যৎ কী?
খুবই খারাপ। কিনড্‌ল তো গোটা ব্রিটেনে আধিপত্য বিস্তার করেছে। আমার শেষ বইটার ২৬ শতাংশ ইলেক্ট্রনিক কপি বিক্রি হয়েছে। প্রকাশকের ধারণা পরের বইয়ের ৫০ শতাংশ বিক্রি হবে ই-বুক আকারে। এটা খুবই দুঃখের। বইয়ের দোকানগুলোর ক্ষতি হবে। সাড়া পৃথিবী জুড়ে বইয়ের দোকান তো বন্ধ হয়ে যাবে। আমি হাতে ধরে বই পড়তে ভালবাসি। তবে বাস্তবকে মেনে নেওয়া ভাল। পরের প্রজন্ম তো কিনড্‌লেই বই পড়বে।
আপনার ব্যক্তিগত পছন্দের তালিকায় কোন জেফরি আর্চার সেরা?
দেখো, প্রথম উপন্যাস বলে 'নট আ পেনি লেস নট আ পেনি মোর' আমার হৃদয়ের খুব কাছের। 'কেন অ্যান্ড এবেল' মনে থাকবে কারণ ওটাই আমাকে প্রথম সাফল্যের স্বাদ চিনিয়েছিল। এর পরেই সব কিছু পাল্টে যায়। তবে এ দু'টো বাদে আমার ব্যক্তিগত সেরা 'পাথস অফ গ্লোরি'।

আপনি এতদিন ধরে লেখালিখি করছে। আপনার স্বপ্নের প্রজেক্ট কোনটা?
আমি এই মুহূর্তে একটা বিশাল বড় চ্যালেঞ্জ নিয়েছি। পাঁচ-পাঁচটা দীর্ঘ উপন্যাস পর পর লেখার চ্যালেঞ্জ। 'ক্লিফটন ক্রনিক্‌লস'। ১৯২০ থেকে ২০২০। প্রথম দুটো, 'ওনলি টাইম উইল টেল' আর 'দ্য সিনস অফ দ্য ফাদার' প্রকাশিত হয়েছে। আগামী বছর প্রকাশিত হবে 'বেস্ট কেপ্‌ট সিক্রেট'। তবে এটা শেষ করতে এখনও আরও বছর তিনেক লাগবে। আমার এখন ৭২ বছর বয়স, ফলে আমি জীবদ্দশাতেই লিখে যেতে পারব আশা করি (হাসি)। এর পর আরও কিছু ছোট গল্প লেখার প্ল্যান আছে। আর একটা বিশাল বড় উপন্যাস লিখব। তবে সেই ব্যাপারে আমি এখন কিচ্ছু জানাব না।

ঠিক আছে। আপনার বই এখানে রিলিজ করলে আমরা কিনেই পড়ব!

হুঁ। (আবার হাসি)

জেফরি, একটা থ্রিলার উপন্যাস লিখতে চাই। দশটা টিপ্‌স দাও।

(উত্তেজিত ভাবে) কটা? (হেসে) দেখো, সিক্রেটটা মেনে নিতেই হবে। গল্প বলার ক্ষমতা ভগবান প্রদত্ত। তুমি চাইলে লেখক হতে পার। যদি তুমি পর্যাপ্ত পড়াশোনা কর, তুমি লেখক হতে পারবে। কিন্তু গল্প বলার শৈলী ঈশ্বরলব্ধ এবং দুর্লভ। যদি তোমার সেই শৈলী থাকে তবে গুড লাক! আমার টিপ্‌সের প্রয়োজন হবে না। যদি তোমার সেই শৈলী না থাকে, তা হলে নেই। কারোর কিচ্ছু করার নেই। ইফ ইউ হ্যাভ ইট, ইউ হ্যাভ ইট। ইফ ইউ ডু নট হ্যাভ ইট, ইউ ডু নট হ্যাভ ইট।
এতবার ভারতে এলেন... ভারত নিয়ে কিছু লিখবেন না?
কোনও দিনও না। দেখ, এমন কিছু নিয়ে কখনও লেখা উচিত না যে বিষয়ে তুমি কিছু জান না। আমি ভারত সম্পর্কে কিচ্ছু জানি না। আমি এদেশে বেড়াতে আসি। আমার খুব ভাল লাগে। এখানকার মানুষ আমাকে খুব ভালবাসে। কিন্তু ভারতবর্ষ নিয়ে আমি যদি কিছু লিখতে চাই তাহলে দু'মিনিটে তুমি আমার অজ্ঞানতা বুঝে ফেলবে। দিনকয়েক আগে তোমাদের দেশেরই এক নোবেলজয়ী সাহিত্যিকের লেখা পড়ছিলাম। তিনি এদেশটা সম্পর্কে জানেন। এদেশের মানুষদের চেনেন। আমি তাঁদের নিয়েই লিখতে পারি, যাঁদের আমি চিনি, জানি।

আপনার জীবনদর্শন?

আমি সারাজীবন লিখতে চাই। আর আমার লেখা সারাজীবন পড়াতে চাই।
কৃতজ্ঞতা: আশিস দোশি, সভাপতি, ক্যালকাটা সুইমিং ক্লাব

.