খালাসিতলায় জন্ম অবনী-নীরার, সুজেটের গর্ভ পার্কস্ট্রিট

Updated By: Dec 11, 2015, 03:35 PM IST
খালাসিতলায় জন্ম অবনী-নীরার, সুজেটের গর্ভ পার্কস্ট্রিট
ছবি: সৌরভ

সৌরভ পাল

গমগম করা কলকাতাকে এতটা ঠাণ্ডা এর আগে কখনও মনে হয়নি। আজ যতটা মনে হল। কবরে বিচার পেয়েছে কলকাতা, কারণ মৃত মানুষের বিচার হয় না। বিচার কেবল সমাজের লড়াইটা সুজেটের। একটা কলকাতা। হাজারো মোড়। নিজের মুখে খাবার জোগাতে অন্যের মুখের 'খাবার' হয়েছেন যারা, তাঁরা কলকাতার ঐ নিয়ন আলোর তলাটায় দাঁড়ান। পাঁচশো, হাজারও ঘণ্টা কাটে ওদের। ওরা আজ দাঁড়িয়ে নেই। ভয়। সুজেট হয়ে যাবো না তো? ১১ ডিগ্রী ঠান্ডায়ও ওদের এমন ভাবে দাঁড়াতে হয় যেন মরুভূমিতে মরিচিকা। জলের পিপাসায় পথিক আসবে আর ওদের নিয়ে যাবে, মিটবে পিপাসা আর ওরা আবার রাস্তায়। উত্তর থেকে দক্ষিণ এমন কোনও জায়গা আছে নাকি কলকাতায় যেখানে ওরা নিরাপদ? একটার পর একটা 'সাজানো ঘটনা' ঘটেছে, বদলায়নি আমার শহরটা। সাদা উর্দিটার কলারটা একটু হলদেটে হয়েছে ঠিকই কিন্তু সেটার কোনও বিবর্তন নেই। সুজেট নেই, পার্কস্ট্রিট আছে পার্কষ্ট্রীটেই।      

বদলায়নি অবিরাম হেঁটে চলাও। কল্লোলিনীর রাস্তা দিয়ে কবিরা হেঁটেছেন কখনও কালো মাথার ভিড়ে আবার কখনও চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকেছেন কেবল 'নীরা' আসবে বলেই। 'অবনী'র বাড়ির জানালা কিংবা দরজার কড়াটা সময় জ্ঞানের তোয়াক্কা না করেই নাড়া পরেছে কেবল মাত্র একবার খালাসিতলাতে যাওয়ার জন্য। নীরা, অবনীদের গর্ভদাতারা কখনও ফিরিয়ে দেননি প্রস্তাব। প্রেম বা লড়াই, যখন যেটা হয়েছে মানবিক ভাবেই হয়েছে। যে লেখিয়ে সকালে মাছের বাজারটা করতে পারতেন না কেবল হিসেব নিকেশের ঝঞ্ঝাট পোহাবেন না বলে, তিনিই খালাসিতলার ভিড়ে অঙ্ক কষেছেন জীবনের। মূল্যবোধ, প্রেম, বিরহ, যৌনতা-এক চুমুক, দুই চুমুক, এক গ্লাস, দুই গ্লাস, একটা বোতল, দুটো বোতল যত গভীরতা পেয়েছে ঠিক ততোধিক রোমাঞ্চ পেয়েছে জীবনের সমুদ্র মন্থন। কখনও গাড়ল কখনও শক্তি আবার কখনও নীললোহিতে হারিয়ে যাওয়া। এই তো হল খালাসিতলা। জীবনের সমস্ত রক্ত ঘামের প্রতিদিনের দীনলিপি-না জানি কত সমুদ্রে নৌকা বেয়েছে ধীর গতিতে, না জানি কত সাদা পাতায় আঁচড় পড়েছে লক্ষ কোটি শব্দের। শিল্প আর কেবলই শিল্প।

কলকাতার আছে একটা খালাসিতলা। একটু খোলসা করে বলাই ভাল। সমাজের শ্রমিক শ্রেণিরা এখানে মদ খেতে আসেন। বাংলা মদ। বয়সের কোনও বেড়া নেই। ১৮-এর কচি হাতটা এখানে এসে ভাবে না এক ঢোকে ঠিক কতটা জ্বালা মিটবে। গলাটা দিয়ে যখন আগুন নামে পাশের ৮০ বছরের বন্ধুটা বাড়িয়ে দেয় শীতল স্পর্শ। প্রথমে অনলে জ্বলন তারপর আন্টার্টিকায় নগ্ন মনকে সাঁতারে পাঠানো। বরফে সাঁতার কাঁটার দৃষ্ঠতা একজন শিল্পী ছাড়া আর কার আছে বলুন তো। লেখাতে কত কত যৌনতারা একসঙ্গে ভিড় করছে, মৌচাকে যেমন একটা রাণী মৌমাছির জন্য দাসত্ব নেয় হাজার হাজার শ্রমিক মৌমাছিরা, খালাসিতলার টেবিলে টেবিলে ঠিক তেমন ভাবেই ঘুড়ে বেড়ায় প্রেম ভ্রমরার দল। কেউ কখন শুনেছেন 'খালাসিতলায় ধর্ষণ'?

পার্কস্ট্রীট কাণ্ড। হ্যাঁ সুজেট গণধর্ষিতা। ৩ বছর ১০ মাস আগেও পার্কস্ট্রীট ছিল ওর মায়াবী জগৎ। ঐ খানেই ছিল আনাগোনা। এখন ওর ঘর বদল হয়েছে। ভবানীপুরের সিমেট্রিতে পাকাপাকিভাবে থাকে সুজেট। অন্ধকার, দম আটকানো পরিবেশ, ওর পড়শিদেরও তেমন ভাবে চেনে না ও, সবে তো কতকগুলি দিন কাটিয়েছে মাত্র। তবে ও নিরাপদ। ঠিক ততটাই যতটা মায়ের গর্ভে থাকার সময় ছিল। মাঝে মোমবাতিওয়ালাদের হাতটা ওর কবরের ওপর হাত বুলিয়ে যায়, সুজেট তখনও ঘুমোয়। কাল যখন ঐ কলঙ্কের রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম মনে হচ্ছিল এখানে আরও আরও 'সুজেট' নেই তো? বা সোনিয়া, মোনিয়ারা সুজেট যে মিছিলের নেত্রী সেই মিছিলে সামিল হবে না তো? রাজ্যের তাবড় তাবড় নেতা-মন্ত্রীরা নিজে উপস্থিত না থেকেও ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন ইতিহাসবিদদের মত।ঐ ইতিহাসটার মত, সম্রাট আশোকের জায়গায় বাবর লিখে আসলেও ওটা ইতিহাসই।

খালাসিতলার একটা ইতিহাস ছিল, আছে। আগামী ১০০ বছর পরেও থাকবে। পার্কস্ট্রিট তো এই সেদিনকার। জন্মাবার পরে আতুড় ঘরেই ইতিহাস লিখে ফেলল। ফোয়ারা, আলো, রাত্রি নিবাসের জ্বল জ্বলে ইতিহাস। দিন যায়, দিন বদলায়, ইতিহাস নিজেই ইতিহাস লিখে গেল-খালাসিতলা শিল্প দিল, পার্কস্ট্রিট দিল ধর্ষণ। এরপরও গল্পের ফেরিওয়ালা বলবেন এক যে ছিল খালাসিতলা, কত যে ছিল অবনী, নীরা। উল্টোদিকে 'নিন্দুক'রা বলবেন এক যে ছিল সুজেট, একই যে আছে পার্কস্ট্রিট।

 

.