গতকাল দীপাবলি ছিল, আজ যেন একসঙ্গে সব আলো নিভে গেল: অপর্ণা সেন
সৌমিত্রের তিন নায়িকা-- সাবিত্রী, শর্মিলা, অপর্ণার স্মৃতিচারণ
সৌমিত্রের প্রথম নায়িকা শর্মিলা ঠাকুর। 'অপুর সংসার' সৌমিত্রের প্রথম ছবি। সেই ছবিতে অপুরূপী সৌমিত্রের স্ত্রীর ভূমিকায় ছিলেন শর্মিলা। ফলত তিনিই ওঁর প্রথম নায়িকা।
তার পর দীর্ঘ ফিল্মজীবনে অসংখ্য নায়িকার সঙ্গে অভিনয় করেছেন সৌমিত্র। ঠিক উত্তম-সুচিত্রা মাত্রার জুটি না হলেও সৌমিত্র-সাবিত্রী, সৌমিত্র-অপর্ণা, সৌমিত্র-মাধবী, সৌমিত্র-সন্ধ্যা-- এরকম বেশ কিছু বক্স-অফিস সফল জুটি সৌমিত্র তৈরি করতে পেরেছেন তাঁর ছবিজীবন জুড়ে। সুচিত্রা সেনের সঙ্গেও বেশ কয়েকটি ছবি করেছেন। স্ক্রিন শেয়ার করেছেন তনুজা, লিলি চক্রবর্তীর সঙ্গে।
বিভিন্ন নায়িকার সঙ্গে পর্দায় বিভিন্ন মাত্রার রসায়নই যে কোনও নায়কের ইউএসপি। এক-একজন অভিনেত্রীর এক-এক রকম ওয়েভলেংথ, এক-এক রকম রেঞ্জ ও স্পেকট্রাম, এক-এক রকম স্ক্রিন প্রেজেন্স। চিত্রনাট্য ও চরিত্রের সঙ্গে খাপ খাইয়ে ঠিক সেই-সেই তরঙ্গভঙ্গে যৌথ অভিনয়কে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়। এটা যত সফল হয়, জুটি তত জমে ওঠে এবং তা দর্শকমনে তত হিল্লোল তোলে।
সৌমিত্রের কিছু জুটি বেশ কিছু ছবিতে তেমনই হিল্লোল তুলেছে। দর্শকমনে চিরস্থায়ী হয়ে রয়ে গেছে সেই সব ফিল্ম-দৃশ্য। সেখানে সৌমিত্রের বিপরীতে কখনও অপর্ণা, কখনও শর্মিলা, কখনও মাধবী, কখনও সাবিত্রী।
সৌমিত্রের মৃত্যুতে তাঁর সেই সব নায়িকারা আজ, দীপাবলির আবহে এই রবিদিবসে খুব সঙ্গত কারণেই শোকার্ত, স্মৃতিকাতর, বেদনাহত, ভারাক্রান্ত।
সৌমিত্র যেসব নায়িকার সঙ্গে সারাজীবন কাজ করেছেন, তাঁদের মধ্যে তিনি নিজে সব চেয়ে বেশি কদর করেছেন সাবিত্রী চট্টাপাধ্যায়ের। সেই সাবিত্রী তাঁর এই বিশেষ নায়কটির মৃত্যুতে কথা বলতে গিয়ে বাস্তবিকই কথা বলতে পারেননি। বলেছেন, তাঁর ভাষা হারিয়ে গিয়েছে। তবু নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে এটুকুই বলতে পেরেছেন--'অভিনেতা হিসেবে ওঁর একটা স্মৃতি আছেই। মানুষ হিসেবেও আছে। উনি, ওঁর স্ত্রী আমার খুব বন্ধুলোক ছিলেন। ইদানীং আমি রোজই টিভি খুলে রাখতাম, কোথাও সৌমিত্রের সম্বন্ধে কোনও খবর পাওয়া যায় কিনা দেখতাম।' এর চেয়ে বেশি কিছু আর বলতে পারেননি কিংবদন্তি অভিনেত্রী।
ছবির কেরিয়ারের নিরিখে সাবিত্রী সৌমিত্রের চেয়ে বেশ খানিকটা সিনিয়র। সেই দিক থেকে শর্মিলা বা অপর্ণা বরং সৌমিত্রের সমসাময়িক। এ হেন অপর্ণার কাছে সৌমিত্রের মৃত্যু একটা দারুণ ক্ষতি। অপর্ণা বলছেন, 'শেষ পর্যন্ত আশা করেছিলাম, একটা মিরাকল ঘটবে। উনি ফিরে আসবেন। সেটা হল না। কাল দীপাবলি ছিল। আজ যেন একসঙ্গে সব আলো নিভে গেল।' পরে কথাপ্রসঙ্গে অপর্ণা ওঁদের প্রথম ছবির কথা স্মরণ করেছেন। বলেছেন, তখন তাঁর নিজের ১৪ বছর বয়স। তখন থেকেই সৌমিত্রের সঙ্গে পরিচয়। জানিয়েছেন, তিনি পারিবারিক সম্পর্কের সূত্রে সৌমিত্রকে 'সৌমিত্রকাকা' বলে ডাকতেন। অপর্ণা অবশ্য বিশেষ করে খেয়াল করিয়ে দিয়েছেন সৌমিত্রের সাংস্কৃতিক মনোগঠনকেই। বলছেন, 'বাংলা মেইনস্ট্রিম ছবিতে কাজ করেও যে সৌমিত্র সেই পাঁকের মধ্যে ডুবে যাননি, সেটা একটা বড় প্রেরণা ছিল আমার কাছে। ছবিতে কাজ করতে-করতেই উনি তখন পত্রিকা সম্পাদনা করছেন, ছবি আঁকছেন, নাটক নিয়ে ভাবছেন। সব মিলিয়ে সৌমিত্র আমার কাছে একটা ইনস্পিরেশন।'
শর্মিলাও স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সৌমিত্রের চরিত্রের এই বিশেষ দিকটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। স্মৃতি উপচে পড়ছে তাঁর কণ্ঠে। প্রথম অভিনয়ের দিনেই সৌমিত্র নাকি শর্মিলাকে প্রশ্ন করেছিলেন, 'তোমার নার্ভাস লাগছে?' কেন এই প্রশ্ন? কারণ, শর্মিলা জানাচ্ছেন, 'আমার তখন ১৩ বছর বয়স। সৌমিত্র ২৩। আমার চেয়ে ঠিক দশ বছরের বড়।' এর পর সৌমিত্রের সঙ্গে শুটিং-পর্বের স্মৃতি টেনে এনেছেন শর্মিলা। 'অরণ্যের দিনরাত্রি'র সময়ে সাঁওতালদের সঙ্গে নাচের স্মৃতি উঠে এসেছে তাঁর কথায়। গরমে সারাদিন কাজ করা যেত না। সকালে ও বিকেলে ২ ঘণ্টা করে। বাকি সময়টা পুরোটাই আড্ডা। এই ছবির সূত্রেই পরে শর্মিলা ছবিটির সিক্যুয়েল 'আবার অরণ্যে'র প্রসঙ্গেও এসেছেন। শুটিংয়ের সময়কার কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, 'সকালে সৌমিত্র ব্যায়াম করত। আমি বারান্দায় বসে কফি খেতাম। ব্যায়াম করতে-করতে গানও গাইত সৌমিত্র। একটা আক্ষেপ থেকে গেল, আমি ওটা রেকর্ড করে রাখতে পারিনি। করলে ওটা থেকে যেত।' সেই প্রসঙ্গেই শর্মিলা জানান, সৌমিত্রের কাছে অনেক কিছু শেখার ছিল। তিনি এ-ও মনে করেন, সম্ভবত সৌমিত্রকে রিপ্লেস করার মতো কেউ নেই!
এই তিন নায়িকার কথার সূত্রেই নানা সৌমিত্রের একখানি মালা যেন গাঁথা হয়ে গেল। যে-সৌমিত্র শুধু নায়কই নন, নন শুধুই এক সহ-অভিনেতা; বরং একই সঙ্গে যিনি বাচনে-শীলনে-মননে এক বিরল বাঙালি ব্যক্তিত্ব। যাঁর উপস্থিতির বিচ্ছুরণে দ্যোতিত হয় অন্যরকম আলো। যা সেলুলয়েডের কৃত্রিম আলো পেরিয়ে আরও অনেকদূর ছড়িয়ে পড়ে।
আরও পড়ুন: ভারতীয় ছবি ও নাটকে তাঁর অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে: প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়