প্রেয়সী, গড়ের মাঠ আর কলকাতা অথবা অপূর্ণ বিপ্লব...

শহরে ফেরার পর দেখা হয়েছে তার সঙ্গে। কথা হয় রোজই কিন্তু আগের মত করে আর ফেরা হয়নি তার কাছে। কেমন যেন একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে আমাদের মধ্যে। আমি প্রেয়সীকে ছেড়ে প্রেমিকাকে বেশি সময় দিয়েছি। প্রেয়সী তার নতুন বন্ধুদের খুঁজে নিয়েছে। আমি কেরিয়ার বানাতে বানাতে এমন জায়গায় গিয়েছি যেখানে প্রেয়সীর সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক কোনওদিন ছিল সেই পরিচয় দেওয়ার জায়গা নেই। কিন্তু প্রেয়সী এখনও ভোলেনি আমায়। মাঝে মাঝেই কোনও না কোন ভাবে আমায় দাঁড় করিয়ে দেয় নিজের বিবেকের সামনে।

Edited By: অনুষ্টুপ রায় বর্মণ | Updated By: Sep 27, 2022, 04:51 PM IST
প্রেয়সী, গড়ের মাঠ আর কলকাতা অথবা অপূর্ণ বিপ্লব...
নিজস্ব চিত্র

অনুষ্টুপ রায় বর্মণ: পার্ক স্ট্রিটের জনঅরণ্য থেকে নিজের ক্লান্ত দেহটাকে টেনে হিঁচড়ে বের করে আনলাম সবে। গড়ের মাঠের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে  হঠাৎ মনে পড়ল বছর সাতেক আগের কথা। ফ্ল্যাশব্যাকে বিদ্যুৎ বেগে ছুটছিল মন। সেই ময়দান, ঘোড়ার গাড়ি, চিনেবাদাওয়ালা, লাল চা। এই গড়ের মাঠেই সেইদিন দাঁড়িয়েছিলাম আমরা দুজন। বিজ্ঞের মতো দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে বিড়িতে একটা দমকা টান দিয়ে পাশের কমরেডকে বাণী দিয়েছিলাম, ‘আমার প্রেয়সী বিপ্লব’। বলেই সটান পার্ক স্ট্রিটের দিকেই হাঁটা লাগিয়েছিলাম সেখান থেকে।

সেই হেঁটে চলা আজও থামেনি। সেইদিন থেকে চলছে একটানা, বিরামহীন। চলতে চলতে পেরিয়ে এসেছি কত গলি, শহর, দেশ। দেখতে দেখতে অচেনা হয়ে গিয়েছে কত মানুষ। কত ঠিকানাকে অচেনা করে দিয়েছি আমি নিজে। কত নতুন ভাবনারা প্রতিদিন মগজের দরজায় কড়া নেড়ে ফিরে গেছে বিফল মনোরথে। পাত্তা দেওয়ার প্রয়োজন মনে করিনি আমি।

তাহলে আমার প্রেয়সীর কি হল? আমিও কি তাহলে নাম লেখালাম লায়লা-মাজনুর দলে? বিফল প্রেমিকের খাতায়? খানিকটা তাই, খানিকটা নয়। এই জীবনে কত কিছুই তো হয়।

সেই দিন পার্ক স্ট্রিট ধরে হাঁটতে হাঁটতে ফোনটা এসেছিলো। উল্টোদিকে অতি চেনা কণ্ঠস্বর, ‘কাল চলে আয় অফিসে, ইন্টারভিউটা দিয়ে যা’। তারপর কালের নিয়মে, নাকি স্বেচ্ছায় জানিনা, এমফিল-এর ডাক উপেক্ষা করে ঢুকে পরলাম হাজার আটেকের চাকরিটায়। না না কোনও অভাব নয় দাদা। কেরিয়ার বানানোর অদম্য আকর্ষণে।

শুরুতেই হোঁচট, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে একটু ব্যাকসিট নিতে হবে। বেশ, তাই সই। প্রেয়সীকে বললাম একটু কম সময় দিতে পারব, ছেড়ে যেওনা প্লিজ। একটু হয়ত অভিমান হল তার। কিন্তু মেনে নিলো সে। অন্তত আমার তাই মনে হল। আমার সঙ্গেই চলে এলো আমার নতুন ঠিকানার কাছে। যাতে আমি তাকে সময় দিতে পারি। খুবই বুঝদার কি বলেন? খুব ভাল চলছিলো, সকালে চাকরি বিকেলে প্রেয়সী। কিন্তু কেরিয়ার খুব কঠিন জিনিস বুঝলেন। এই জিনিসের মোহ একবার ধরলে সেখান থেকে বেরিয়ে আসা খুব কঠিন।

যাই হোক, দুই বছরের মাথায় এলো নতুন সুযোগ। এবার গন্তব্য, দক্ষিণ ভারত। যাওয়ার আগে আবার দেখা করলাম প্রেয়সীর সঙ্গে। গল্প হল অনেকক্ষণ। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘রাগ করবে? এবার সত্যি ছেড়ে চলে যাবে আমায়?’ কোনও উত্তর দেয়নি সে। জানিনা কি ভাবছিল। আরও অনেক প্রশ্ন করেছিলাম হয়তো। মনে নেই আজ আর। অনেক আশ্বাস দিয়েছিলাম তাকে, প্ল্যান বানিয়েছিলাম কিভাবে আমরা যোগাযোগ রাখব। তারপর অস্রুসজল চোখে বিদায় নিয়ে উঠে পরেছিলাম ফ্লাইটে। আমি কেঁদেছিলাম জানি, কিন্তু সেও কি কেঁদেছিল? নাকি সে অনেক আগেই বুঝে গিয়েছিল এই প্রেম দিনেকালে শুধুমাত্র পরিচিতিতে এসে দাঁড়াবে?

পড়ুন, বাঙালির প্রাণের উৎসবে আমার 'e' উৎসব। Zee ২৪ ঘণ্টা ডিজিটাল শারদসংখ্যা

শহরে ফেরার পর দেখা হয়েছে তার সঙ্গে। কথা হয় রোজই কিন্তু আগের মত করে আর ফেরা হয়নি তার কাছে। কেমন যেন একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে আমাদের মধ্যে। আমি প্রেয়সীকে ছেড়ে প্রেমিকাকে বেশি সময় দিয়েছি। প্রেয়সী তার নতুন বন্ধুদের খুঁজে নিয়েছে। আমি কেরিয়ার বানাতে বানাতে এমন জায়গায় গিয়েছি যেখানে প্রেয়সীর সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক কোনওদিন ছিল সেই পরিচয় দেওয়ার জায়গা নেই। কিন্তু প্রেয়সী এখনও ভোলেনি আমায়। মাঝে মাঝেই কোনও না কোন ভাবে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। আমায় দাঁড় করিয়ে দেয় নিজের বিবেকের সামনে। হয়তো নিঃশব্দে প্রশ্ন করে পরিচয় দিতে পারবেনা সেটা বুঝি, কিন্তু ‘আমাদের গেছে যে দিন / একেবারেই কি গেছে- / কিছুই কি নেই বাকি?’ জানিনা এর উত্তর কিভাবে দেব।

প্রেমিকার সঙ্গে প্রেয়সীর একটা একতরফা আড়া আড়ি আছে। প্রেমিকার মতে প্রেয়সীর জন্য আমার জীবনে নাকি অনেক ক্ষতি হয়েছে। আবার প্রেয়সীর মতে প্রেমিকা না থাকলে নাকি আমি দিন বদলের গল্প শোনাবার সাহসই পেতাম না। কঠিন জীবন।

যাই হোক, এই কঠিন জীবনকে কঠিনতর করে তুলেছি আমি বিবাহোত্তর পরিস্থিতিতে। এখন জীবন মানে সততই জি বাংলা। সকালে উঠে আমি রোজ এটাই ভাবি যে সারাদিন অফিসে যেন বেঁচে বেঁচে থাকি। অফিসে পৌঁছে যদি হাওয়া ভালো বুঝি, তখন চিন্তা যেন বউয়ের মাথা ঠাণ্ডা থাকে। ট্যাক্স, লোন, ইএমআই, সংসার, দায়িত্ব, কর্তব্য – প্রেয়সী দূরে দাঁড়িয়ে হাসে। এইজন্য ছেড়ে গিয়েছিলে আমায়!

এই কয়েক দিন আগেই আবার দেখা হয়েছিল প্রেয়সীর সঙ্গে। আমি ফিরছি অফিস থেকে। দেখি একদল ছেলেমেয়ে বসে গড়ের মাঠে। তুমুল তর্ক চলছে, জোট নাকি একা, আব্বাস নাকি আধীর, আমি নাকি আমরা। হঠাত মাঝখানে একটা ছেলে উঠে দাঁড়াল। বিড়িতে শেষ টানটা দিয়ে ঝাণ্ডাটা গুটিয়ে ধরে এগিয়ে গেল পার্ক স্ট্রিটের দিকে। আমি দেখছি আমার প্রেয়সীকে। এগিয়ে যাচ্ছে ব্যস্ত রাস্তায়। মিশে যাচ্ছে জনতার স্রোতে। ভিড়ের মাঝে ভিড় হয়ে উঠছে আমার প্রেয়সী।    

(Zee 24 Ghanta App দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)  

.