সাফল্য, ব্যর্থতা, গর্ব, লজ্জা সঙ্গী করেই আজ আটষট্টিতে পা স্বাধীনতার

Updated By: Aug 15, 2014, 08:48 AM IST
সাফল্য, ব্যর্থতা, গর্ব, লজ্জা সঙ্গী করেই আজ আটষট্টিতে পা স্বাধীনতার

পায়ে পায়ে পেরিয়ে গেল সাতষট্টি বছর। আজ আটষট্টিতে পা দিল আমাদের স্বাধীনতা। ফেলে আসা প্রায় সাত দশকে কী পেলাম আমরা? কতটুকুই বা রয়ে গেল না পাওয়া?মধ্যরাতের সেই নবজাতক আজ আটষট্টিতে পা দিল। ব্রিটিশের হাত থেকে যে স্বাধীনতা আমরা ছিনিয়ে এনেছিলাম বয়সের বিচারে আজ সে পরিণত। কিন্তু, আসমুদ্র-হিমাচল ভারতবাসীর আশা-আকাঙ্খা মেটাতে গিয়ে সে সাবালকত্বের প্রমাণ দিতে পেরেছে কি?  

সার্থক গণতন্ত্র, কিছু প্রশ্ন

১৯৫০-এর ২৬শে জানুয়ারি শুরু হয়েছিল ভারতীয় গণতন্ত্রের পথ চলা। ১৯৫১-৫২-এ প্রথম সাধারণ নির্বাচন। প্রথম লোকসভা নির্বাচনে ভোটদানের হার ছিল ৪৫.৭ শতাংশ। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন ৬৬.৩৮ শতাংশ ভোটার।

মাঝের এই ছ-দশকে ভোটদান এ দেশে পরিণত হয়েছে গণতন্ত্রের উতসবে। সাংবিধানিক সংস্থা নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায় একাশি কোটি ভোটারের বৃহত্তম গণতন্ত্রের ভোট পর্ব আজ সব দেশের কাছে শিক্ষণীয়। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ আর নির্দিষ্ট সময় অন্তর নিরবিচ্ছিন্ন ভোটদান প্রক্রিয়া যদি গণতন্ত্রের অন্যতম পরীক্ষা হয়, তা হলে আমরা সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। ১৯৭৫-এর ২৫শে জুন থেকে ৭৭-এর ২১শে মার্চ। একুশ মাসের জরুরি অবস্থার এই কালো অধ্যায়টুকু বাদ দিলে স্বাধীনোত্তর পর্বে সার্থক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সফল হয়েছি আমরা। তবে, যাত্রাপথের এই আনন্দগানে আছে অনেক বেসুর-বেতালও। প্রশাসনের সব স্তরে দুর্নীতিতে জেরবার সাধারণ মানুষ। হাজারো দাওয়াইয়ের কথা বলা হলেও রোগ সারানো যায়নি। ছোট ছোট দুর্নীতি চোখের সামনে দেখে ভুক্তভোগী নাগরিকের রোজ মনে হয় এ কোন দেশে বাস করছি আমরা। আর, বড় দুর্নীতি চোখে দেখা যায় না। পরে জানা যায়, অলক্ষ্যে বিক্রি হয়ে গিয়েছে দেশের অমূল্য সম্পদ।

রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত সশস্ত্র সেনাবাহিনী

সীমান্তে ওঁরা অতন্দ্র প্রহরী। ওঁরা জেগে থাকেন বলেই আমাদের শান্তির দিবানিদ্রা। ১৩ লক্ষ সক্রিয় কর্মী নিয়ে স্থল, নৌ, বায়ুসেনার সমন্বয়ে গঠিত স্বাধীন ভারতের সশস্ত্র বাহিনী বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম।

উপদ্রুত এলাকার নিরাপত্তা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে ওঁরা কখনও দ্বিধা করেননি। কিন্তু, স্বাধীনতার পর থেকে এখনও পর্যন্ত রাষ্ট্র না ডাকলে নাক গলাননি নাগরিক জীবনে। ব্রিটিশের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার পর প্রতিবেশি দেশগুলিতে সেনা অভ্যুত্থান, সামরিক সরকারের ইতিহাস মোটেই বিরল নয়। কিন্তু, গত সাত দশকে ভারতীয় সেনা কখনও ছাউনি ছেড়ে বেরিয়ে আসেনি। বরাবর রাষ্ট্রের পতি অনুগত থেকেছে, কোনও দলের প্রতি নয়। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম সশস্ত্র বাহিনীকে সাত দশক ধরে রাজনীতির গণ্ডির বাইরে রাখতে পারা স্বাধীনোত্তর ভারতের অন্যতম বড় সাফল্য।

বিজ্ঞানের শিখর ছুঁয়েও নিরক্ষরতার অন্ধকার

ভারতীয় চিন্তাবিদ, প্রযুক্তি-বিজ্ঞানীদের কদর আজ বিশ্বজুড়ে। ১৯৬৯-এর ১৫ই অগাস্ট শুরু হয়েছিল মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর পথচলা। ৬ বছর পর পৃথিবী প্রদক্ষিণ করতে শুরু করে  দেশের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ আর্যভট্ট। তারপর শুধুই পৌছে যাওয়া এক শিখর থেকে অন্য শিখরে। ইসরোর মহাকাশযানে চড়ে এখন পাড়ি দেয় অন্যান্য দেশের কৃত্রিম উপগ্রহও। চাঁদকে চিনতে আমরা পাঠিয়েছি চন্দ্রযান। মহাকাশের অন্ধকার ভেদ করে ইসরোর মঙ্গলযান ছুটে চলেছে লালগ্রহের দিকে। মহাকাশ গবেষণার মতোই মানবজাতির কল্যাণে আমরা কাজে লাগিয়েছি পরমাণু প্রযুক্তিকে। পোখরানে সফল পরীক্ষামূলক পারমাণবিক বিস্ফোরণ ভারতকে পৌছে দিয়েছে পরমাণু
শক্তিধরদের এলিট ক্লাবে। স্বাধীনতার পর খাদ্যশস্য উতপাদনে অর্জিত হয়েছে স্বনির্ভরতা। সবুজ বিপ্লবের কল্যাণে রুক্ষ-কঠোর মাটিতে ফলেছে সোনার ফসল। দুধ উতপাদনেও এখন আমরা স্বনির্ভর। অপারেশন ফ্লাডের দৌলতে বিশ্বের বৃহত্তম দুধ উতপাদনকারী দেশটির নাম ভারত। কিন্তু, এরপরেও তো পেটে খিদে নিয়ে রোজ ঘুমোতে যান এ দেশের লাখো মানুষ। বিদেশিদের ক্যামেরাবন্দি হয়ে লজ্জায় আমাদের মাথা হেঁট করে দেয় কালাহাণ্ডি-বুন্দেলখণ্ডের বুভুক্ষা। অপুষ্টিতে মৃত্যু হয় অমৃতের পুত্রকন্যার।

২০১১-র গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে ১২০টি উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে ১৬ নম্বরে রয়েছে আমাদের দেশ।  বিজ্ঞান-প্রযুক্তির শিখর ছুঁয়েও কাটেনি নিরক্ষরতার অভিশাপ। বিশ্বের গড় নিরক্ষরতার হার ১৬ শতাংশ হলেও ২০১১-র আদমসুমারি অনুযায়ী ভারতে নিরক্ষরতার হার ২৬ শতাংশ।  পুরুষদের ১৮ শতাংশ নিরক্ষর হলেও মহিলাদের মধ্যে সেই হার ৩৫ শতাংশ। উচ্চশিক্ষার নানা প্রতিষ্ঠান নিয়ে আমরা গর্ব করলেও তার প্রায় কোনওটিই আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে তুলনা করার যোগ্য নয়। স্বাধীনতার পর উন্নতি-প্রগতির পথে অনেকদূর এগিয়েছে দেশ। বেড়েছে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান। কিন্তু, সমৃদ্ধির পথে সবাইকে সামিল করতে পারিনি আমরা।

বৃহত অর্থনৈতিক শক্তি, বিপুল বৈষম্য

জিডিপির নিরিখে বিশ্বে দশম স্থান। ১২৩ কোটি জনসংখ্যা। ক্রয়ক্ষমতার বিচারে বিশ্বে তৃতীয়। বৈদেশিক বাণিজ্যের হিসাবে প্রথম কুড়িটি দেশের মধ্যে জায়গা বাঁধা। মিশ্র অর্থনীতির বুনিয়াদে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আমাদের দেশ। আর্থিক মন্দায় আমরা ভেঙে পড়ি না। বিশ্বের কোনও শক্তির ক্ষমতা নেই আমাদের অবহেলা করে। কিন্তু, এই সত্য যে শেষ সত্য নয়। প্রদীপের নিচে লুকিয়ে আছে গাঢ় অন্ধকার। স্বাধীনতার প্রায় সাত দশক পরও যেখানে পড়েনি কোনও আলো। দারিদ্র্যসীমার নীচে দিন কাটাতে বাধ্য হন সহ-নাগরিকেরা। শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক ব্যর্থতায় অদক্ষ শ্রমিকের রূপান্তর ঘটে না দক্ষ মানবসম্পদে।

২০১৩-এ জাতীয় নমুনা সমীক্ষার হিসাব বলছে দেশে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা প্রায় ২ কোটি। এরই সঙ্গে রয়েছে বিপুল বৈষম্য। আয়-লিঙ্গ-শ্রেণী, সবদিক দিয়েই  দ্বিখণ্ডিত জীবনযাপন। রাষ্ট্র চোখ বুজে থাকায় প্রান্তিক মানুষ রোজ হারাচ্ছেন জল-জমি-জঙ্গলের অধিকার। নদীর গতি রোধ করতে গিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের জীবনধারা। উন্নয়নের জোয়ারে ভিটে-মাটি হারিয়ে উদ্বাস্তু হচ্ছেন স্বাধীন দেশের নাগরিকেরা।

কোনওরকম আশ্রয় ছাড়া খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাতে বাধ্য হন এ দেশের কুড়ি লক্ষ মানুষ। দেশ পোলিও মুক্ত হয়েছে। এই স্বাধীনতা দিবসে এটা একটা ভালো খবর। কিন্তু, সামগ্রিকভাবে জনস্বাস্থ্যের অবস্থা যে দিন দিন শোচনীয় হচ্ছে সে দিকে নজর দেবে কে? শিশুমৃত্যুর হার হাজারে চুয়াল্লিশ। দেশে যত মোবাইল আছে তত শৌচালয় নেই। এ লজ্জা আমরা রাখব কোথায়? সরকারি ইঁদারা থেকে খাবার জল আনতে যে মহিলাকে রোজ পেরিয়ে আসতে হয় কয়েক ক্রোশ পথ, তাঁর কাছে কোন অর্থ বহন করে আনে এই স্বাধীনতা?

রাষ্ট্রসঙ্ঘের মানব উন্নয়ন সূচকে ১৮৭টি দেশের মধ্যে ভারত ১৩৭-এ। এই পরিসংখ্যানই প্রমাণ করে রাষ্ট্রনেতাদের মুখে ইনক্লুসিভ গ্রোথ বা সকলকে নিয়ে উন্নয়নের কথা কত বড় প্রহসন। এক দেশের মধ্যে কী ভাবে লুকিয়ে থাকে আর একটা দেশ।

না। গন্তব্যের সন্ধানে আমাদের যাত্রা এখনও শেষ হয়নি। স্বাধীনতার সংগ্রামীদের স্বপ্ন পূরণের জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরও কতদিন?

 

 

.