Acharya Prafulla Chandra Ray: অনন্য বিজ্ঞানী, হিন্দু রসায়নের স্রষ্টা, বাঙালিকে ডাক দিলেন ব্যবসায়ী হওয়ার...
Acharya Prafulla Chandra Ray Birth anniversary: ১৮৬১ সালের ৭ মে এক অলোকসামান্য পুরুষের জন্ম হল বাংলায়; এর মাত্র তিনমাসের মাথায় জন্ম হল আর-এক অলোকসামান্য পুরুষের-- ২অগস্ট। প্রথমজন রবীন্দ্রনাথ, দ্বিতীয়জন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। বাঙালির দৈনন্দিনের যাপনে-মননে কোথাও কোনও প্রফুল্ল-ছায়া নেই আর আজ! বাঙালি মনে রাখতে জানে না। মনে রাখেনি।
সৌমিত্র সেন: ১৮৬১ সালের ৭ মে এক অলোকসামান্য পুরুষের জন্ম হল বাংলায়; এর মাত্র তিনমাসের মাথায় জন্ম হল আর-এক অলোকসামান্য পুরুষের-- ২অগস্ট। প্রথমজন রবীন্দ্রনাথ, দ্বিতীয়জন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। বাঙালি যে-ভাবেভঙ্গিতেসৌকর্যেবাহুল্যেপ্রণোদনায় রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করে বছর-বছর, অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, এর ছিটেফোঁটাও আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের জন্মোৎসব পালন তো দূরের কথা, সামান্য স্মরণে-মননেও দেখা যায় না। বাঙালি সত্যিই আত্মবিস্মৃত জাত। না হলে প্রফুল্লচন্দ্রকে কোনও জাত ভুলে থাকতে পারে না।
আরও পড়ুন: LGBTQ: 'সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে-- এ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে'?
প্রফুল্লচন্দ্র মূলত বিজ্ঞানজগতের মানুষ। কিন্তু আশ্চর্যের হল, কোনও দিনই নিছক বিজ্ঞানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি তিনি। তিনি বিজ্ঞানী, লেখক, শিক্ষক, গবেষক, দেশপ্রমী, স্বদেশী আন্দোলনর সমর্থক, গান্ধীবাদী, সংগঠক, ব্যবসায়ীও।
বহুমুখী এই মানুষটি স্বভাবতই তাত্ত্বিক বিজ্ঞানের পরিসরে নিজেকে কোনওদিনই আবদ্ধ রাখেননি। বিজ্ঞানকে গবেষণাগারে অনুশীলন করেছেন নিরন্তর। পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ লেখালেখিও করেছেন বিজ্ঞান নিয়ে। 'আ হিস্ট্রি অফ হিন্দু কেমিস্ট্রি' এক ঐতিহাসিক কাজ। যে-বইটির দিকে ফিরে তাকানো তো দূরের কথা, যে-বইয়ের কথা মনেই রাখেনি সিংহভাগ বাঙালি। এই বইয়ের দুটি খণ্ড-- প্রথম খণ্ডটি প্রকাশিত হয় ১৯০২ সালে, দ্বিতীয় খণ্ডটি ১৯০৯ সালে। লন্ডনের এক প্রকাশনা বিভাগ এটি প্রকাশ করে। বইটি লিখতে প্রচুর সংস্কৃত টেক্সট ব্যবহার করেন আচার্য। বেদের মধ্যে রসায়নের যে-আদর্শ লুকিয়ে সেটি নিয়ে আলোচনা করেছেন এখানে, করেছেন আয়ুর্বেদের যুগ নিয়ে। এই ভাবে ক্রমশ আধুনিক যুগের দিকে সরে এসেছেন তিনি। ভারতীয় উপমহাদেশের ঐতিহ্যপূর্ণ বিজ্ঞানসাধনার একটা সুদীর্ঘ ইতিহাস এখানে লিপিবদ্ধ।
বাঙালিকে বারবার ঘা দিয়ে জাগাবার চেষ্টা করেছেন আচার্য। নিজে বিজ্ঞানী, কিন্তু বাঙালিকে ব্যবসা করে নিজের পায়ে দাঁড়াবার ডাক দিয়েছেন তিনি। ভারতের অন্য জাতিগুলি চোখের সামনে ব্য়বসায় প্রতিপত্তি অর্জন করছে, আর বাঙালি জাত এদের সওদাগরি অফিসে কেরানির কাজ করেই সন্তুষ্ট থাকছে, এ দেখে স্থির থাকতে পারেননি তিনি। বাঙালিকে আত্মনির্ভরশীলতার কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। আলস্য, বিলাস, কল্পনাপ্রবণতায় দিন অতিবাহিত না করে গঠনমূলক কাজ করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি। তিনি নিজেই তো তা করে দেখিয়েছেন! বেঙ্গল কেমিক্যাল তাঁর অমর সৃজন। যে-প্রতিষ্ঠান আজও বাঙালির অহংকার হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে।
অবিবাহিত এই দেশপ্রমী-বিজ্ঞানী মানুষটি অতি সাধারণ জীবনযাপন করতেন। রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের একটি ঘরে থাকতেন। সেঘরে জিনিসপত্র বলতে ছিল একটি লোহার খাট, টেবিল-চেয়ার আর এক শেল্ফ বই। আদর্শের দিক থেকে গান্ধীর মতবাদকে শ্রদ্ধা করতেন, নিজের জীবনাচরণে তা গ্রহণও করেছিলেন। স্বদেশের পরিকাঠামোয় দেশজ জিনিসপত্র ব্যবহার করে কীভাবে দেশীয় বিজ্ঞান ও গবেষণাকেই আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, এই ভাবনাই ভাবতেন। তাঁর ছাত্রদেরও সেই পরামর্শই দিতেন। তাঁদের উদ্বুদ্ধ করতেন। তিনি তাঁর ছাত্রদের মধ্যে দিয়েই বাঁচতেন, বেঁচেছেন, অনেকদিন পর্যন্ত হয়তো বেঁচেওছিলেন।
আরও পড়ুন: পোখরানে বিস্ফোরণ! সেদিন কীভাবে আগুন-ডানা মেলে ধরলেন 'মিসাইল ম্যান' আব্দুল কালাম?
কিন্তু আজ আর তিনি নেই! সত্যিই নেই! বাঙালির দৈনন্দিনের যাপনে-মননে কোথাও কোনও প্রফুল্ল-ছায়া নেই আর আজ! বাঙালি মনে রাখতে জানে না। মনে রাখেনি। অন্য জাত হলে যে-মানুষকে মাথায় করে রাখত, বাঙালি বলে তাঁকে নিছক দিন-তারিখের নিগড়ে ফেলে অনবরত বিস্মৃতির সাধনা করে গিয়েছে।