#উৎসব: পুরোহিত নন, মা এখানে পুজো নেন শবরদের হাতে!

Soumitra Sen Sun, 10 Oct 2021-5:22 pm,

এই মায়ের মন্দিরের পুজো কোনও পুরোহিতের দ্বারা হয় না, পুজো হয় লোধা-শবর সম্প্রদায়ের মানুষের হাতে। এখানে দুর্গা পুজো শুরুর আগে হয় পাঁঠাবলি, পুজোর সময়ে কোনও চণ্ডীপাঠ হয় না, লোধা শবররা নিজেদের মতো করে পুজো করেন। এখানে মা পাথরে বিরাজমান, মা প্রদীপ বা মোমবাতির আলোয় গুপ্ত অবস্থায় থাকেন। ভালো আলোর ব্যবস্থা করা হলে তা বেশিদিন টেকে না। ঝাড়গ্রাম শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে ৬ নং জাতীয় সড়কের পাশে অবস্থিত এই মন্দির। 

৪৫০ বছরের পুরনো এই মন্দির। কেউ বলেন বনদেবী, কেউ বলেন বনদুর্গা, কেউ আবার গুপ্তমণি। নাম যাই হোক, কথিত আছে, এখানের রাস্তা বা মন্দিরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মাকে স্মরণ করলে কার্যসিদ্ধি হবেই। শোনা যায়, আভিজাত্যহীন সাদামাটা এই মন্দির ঝাড়গ্রামের রাজা নরসিংহ মল্লদেব নির্মাণ করিয়েছিলেন। এই মন্দিরে প্রথম থেকেই মা পুজো নিয়ে আসছেন শবরদের হাতে। সেই প্রথা আজও চলছে। 

এর পিছনে একটি ছোট্ট ইতিহাস রয়েছে। প্রায় ৪৫০ বছর আগে নন্দ ভুক্তা বলে এক ব্যক্তি জঙ্গলে গরু চরাতে গিয়ে গাছের নীচে বিশ্রাম করছিলেন। হয়তো একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। কথিত, সেই সময়ে মা তাঁকে স্বপ্ন দেখা দিয়ে বলেন তাঁর পুজো করতে। ঘুম ভেঙে উঠে বসেন নন্দ। বাড়ি ফিরে তিনি  স্ত্রী ও মাকে সব কথা বলেন। তখন নন্দর মা বলেন, ওটা ভূতের আড্ডা, আর ওখানে যাবি না। সেই রাতেই দেবী ফের স্বপ্ন দেন, তিনি বলেন-- তিনি দেবী, কোনও ভূতপ্রেত নন। বলেন, আমি তোদের হাতেই জল-তুলসী নেব। তুই যে গাছের নিচে বসে বিশ্রাম করছিলি, আমি ওখানেই রয়েছি। 

নন্দ আবার তাঁর মা ও স্ত্রীকে সব কথা বলেন এবং পরের দিন সকালে গিয়ে জায়গাটি পরিষ্কার করে স্বপ্নদৃষ্ট দেবীকে প্রতিষ্ঠা করেন। কিছুদিন পরে ঝাড়গ্রামের রাজা নরসিংহ মল্লদেবের আদরের হাতি 'গজ' পাগল হয়ে হারিয়ে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও গজের খোঁজ মেলে না। হঠাৎ রাজামশাইকে মা স্বপ্ন দেন, তাঁর আদরের হাতি 'গজ' রয়েছে তাঁর কাছে। তিনি যেন নন্দলাল ভুক্তার কাছে যান। নন্দই তাঁকে সেখানে নিয়ে যাবেন। এদিকে, দেবী নন্দকেও স্বপ্নে বলেন-- কোথায় তিনি রাজার হাতি তিনি বেঁধে রেখেছেন। সকালে রাজামশাই তাঁর সৈন্য নিয়ে হাজির হন নন্দ ভুক্তার বাড়ি। কী ব্যাপার? রাজামশাই তখন সব কথা বলেন। তখন নন্দ রাজামশাইকে স্বপ্নদৃষ্ট জায়গাটিতে নিয়ে গেলেন। দেখলেন সত্যিই সেখানে একটি হাতি রয়েছে। নন্দ মাকে পুজো করে বীজমন্ত্র বলতেই হাতি রাজার কাছে এসে দাঁড়ায়। রাজামশাই তখন তাঁর প্রিয় হাতির পিঠে চড়েই রাজপ্রাসাদে ফেরেন। 

পরের দিন মন্ত্রীমশাইকে ডেকে মায়ের মন্দির গড়তে বলেন। তিনিই মায়ের মন্দিরের নাম দেন 'গুপ্তমণি'। যেহেতু মা এখানে গুপ্তভাবে ছিলেন তাই মায়ের নাম গুপ্তমণি। মা শবরদের হাতে পুজো নেবেন বলেছিলেন। বলেছিলেন, প্রতি দুর্গা পুজোর সময় রাজবাড়ি থেকে মায়ের জন্য শাড়ি, পলা এবং ফুল না গেলে পুজো হবে না। সেই প্রথা মেনে আজও রাজবাড়ি থেকে মায়ের শাড়ি, পলা এবং ফুল পৌঁছয় মন্দিরে। 

এখানে মা আসলে একটি পাথরে বিরাজমান। মায়ের আলাদা করে মূর্তি গড়ে পুজো হয় না। কোনও পুরোহিত থাকেন না। চণ্ডীপাঠ হয় না। শবরেরা যেভাবে পারেন সে ভাবেই পুজো করেন দেবীর। 

এই মন্দির ঘিরে রয়েছে নানা অলৌকিক কাহিনী। মন্দিরের দেওয়ালে সে সব আঁকা। রামায়ণের কাহিনী, পার্বতীর কাহিনী, মহাদেবের কৈলাস। মন্দিরের বাইরে আঙ্গিনায় আলো থাকলেও মা যেখানে বিরাজমান সেখানে কোনও আলো নেই। মায়ের কাছে জ্বলে শুধু মোমবাতি অথবা প্রদীপের আলো। মা এখানে গুপ্ত ভাবে আছেন, তাই অন্ধকার। শোনা যায়, অনেকবার আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে, কিন্তু টেকেনি বেশিদিন।

ZEENEWS TRENDING STORIES

By continuing to use the site, you agree to the use of cookies. You can find out more by Tapping this link