দুর্গম পাহাড়ি পথে
কুণাল বসু
সেবার পুজো শেষ হতেই ফের অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় পা বাড়ালাম সিকিমের গোয়েচা লা-র উদ্দেশ্যে। গোটা ৯দিনের ট্রেক। সেইমত ৩১ অক্টোবব রাতে ৬ বন্ধু মিলে চড়ে বসলাম দার্জিলিং মেলে। ডেস্টিনেশন নিউ জলপাইগুড়ি। সেখান থেকে গাড়িতে পশ্চিম সিকিমের ইয়কসাম গ্রাম। সিকিমের প্রাচীন রাজধানী। এখান থেকেই শুরু হয় গোয়েচা লা-র অভিযান। এই রুটের কথা আগে বহুবার শুনেছি। পথ অত্যন্ত দুর্গম। চড়াই উতরাই ও বেশ অনেকটাই। এক কথায় বলা যেতে পারে বেশ কষ্টসাধ্য। কিন্তু এই গোটা সফরে সেই রাতটার কথা আমরা আজও মনে আছে।
ইয়কসাম থেকে শুরু করে পাঁচদিন হাঁটার পর এসে পৌঁছলাম ১২,৯০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত থানসিংয়ে। সেখানে রাতটা কাটিয়ে পরদিন বিকেলে শুরু হল লামুরের উদ্দেশ্যে পথ চলা। থানসিং থেকে লামুরের দূরত্ব চার কিলোমিটার। পথও তেমনটা দুর্গম নয়। তবে প্রকৃতি এখানটা বেশ রুক্ষ। পাথুরে রাস্তা। চারিদিকে ছোটো ছোটো ঝোপ। দু পাশে দাঁড়িয়ে বিশাল বিশাল বরফঢাকা পর্বতশিখরগুলোর দিকে তাকালে কেমন যেন গা ছমছম করে। হঠাত্ ভাবলে কেমন যেন মনে হয় সব কিছু কেউ যেন ভেঙেচুরে তাণ্ডবলিলা চালিয়েছে। এমনই অদ্ভূতভাবে দুমড়েমুচড়ে হিমালয়ের সৃষ্টি। একটু এগোলেই পাহাড়ের আড়ালে ধবধবে কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা মিলতে পারে। তবে আবহাওয়া খারাপ থাকায় সেই সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
ডানপাশে দাঁড়িয়ে বিশাল তুষারশৃঙ্গ মাউন্ট পান্ডিম। যুগ যুগ ধরে এভাবেই দাঁড়িয়ে রয়েছে যেন কোনও এক ধ্যানমগ্ন যোগি। জপুনু- তেনজিং খান শৃঙ্গের মাথায় দিনের শেষ আলোটা তখনও দেখা যাচ্ছে। এরই মাঝে হঠাত্ করেই শুরু হয়ে গেল তুষারপাত। হালকা তুষার ছোঁয়ায় চারিপাশটা মুহূর্তে বদলে গেল। বিকেল বিকেল আমরা এসে পৌঁছলাম ১৩,৬৫০ ফুট উচ্চতার লামুনেতে। হাওয়ার তীব্রতা এখানে অনেকটাই। কেমন যেন তিরের ফলার মত শরীরে বেঁধে। তুষারপাত হওয়ার সময়ই গাইড পেমটুক বলেছিল, রাতে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে যাবে। গোটা এলাকা তখন কুয়াশায় ঢেকে গিয়েছে তারই মাঝে পান্ডিমের চূড়ায় দিনের শেষ আলোর লাল আভা। আমরা ঠান্ডার থেকে বাঁচতে তড়িঘড়ি তাঁবুতে ঢুকে পড়লাম। সিদ্ধান্ত হল একই তাঁবুতে ৬জন মিলে থাকার। মধ্য রাতেই আমাদের বেরিয়ে পড়তে হবে শেষ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
সন্ধ্যা নামতেই শুরু হল তুষারঝড়। এক তাঁবুতে আমাদের ৬জনের তখন জবুথবু অবস্থা। সময় কাটানোর জন্য তখন গানের লড়াই, অ্যাডভেঞ্চারের নানা অভিজ্ঞতা শেয়ারের পর্ব চলছে। শীত তবু বাধ মানছে না। মাঝে হঠাত্ দেখার ইচ্ছা হল আরে তাঁবুর বাইরেটা এখন ঠিক কেমন? অবাক হয়ে গেলাম। তাঁবুর চেনটা একটু খুলেই দেখলাম গোড়ালি সমান বরফ জমে গেছে। মুখের হাসিটা বেঁকা হল। সময় যত এগোচ্ছে ঝড়ের তীব্রতা তত বাড়ছে। ভয়ানক প্রকৃতির সেই তাণ্ডবের সামনে ছোট্ট তাঁবুটাকে আগলে রাখাই তখন বড় চ্যালেঞ্জ। গাইড পেমটুক এসে মাঝে মাঝেই তাঁবুর ওপরের বরফ ঝেড়ে দিয়ে যাচ্ছে। রাত সাড়ে আটটা নাগাদ ডাক পড়ল কিচেন টেন্টে। ডিনার রেডি। বাইরে তখনও তাণ্ডব চলছে। তারই মাঝে গরম গরম ফ্রাইড রাইস, চিলি পনির আর ডিম কষা। দুর্গম এই পাহাড়ি রাতে এই অনবদ্য ডিনার আমাদের কল্পনার বাইরে ছিল। খাওয়ার শেষে গাইড জানাল, ভোর আড়াইটে নাগাদ আমরা রওনা দেব গোয়েচা লা-র উদ্দেশ্যে। প্রায় সারারাত ধরে গল্প করে কাটানোর পর রাত দেড়টা নাগাদ হঠাত্ই চোখ লেগে এল। আধ ঘণ্টার মত ঘুম।
দুটো বাজতে না বাজতেই পেমটুকের চিত্কার...'স্যার, নিকাল নে কা টাইম হো গ্যায়া...'শরীর দিচ্ছে না। বাইরের তাপমাত্রা তখন হিমাঙ্কের নিচে। মাথা যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে। টেন্ট থেকে বের হতেই দেখলাম ঝকঝকে আকাশ। নক্ষত্রে আলোয় চারিদিক যেন ঝকঝক করছে। বরফের চাদরে ঢাকা পার্বত্য প্রান্তর চোখে পড়ল। গাইড জানাল, আমরা সে পথেই রওনা হবো। গরম গরম চা খেয়েই শুরু হল পথ চলা। আকাশের একফালি চাঁদ আমাদের সঙ্গী। ধীরে ধীরে পা চালিয়ে এগিয়ে চললাম। বরফের হালকা চাদরের নিচে কোথায় বিপদ লুকিয়ে আছে কারও জানা নেই। ছোট ছোট নদীগুলো বরফ হয়ে জমাট বেধে গিয়েছে। ধীরে সুস্থে এগোনোর সময় মচমচ আওয়াজে হালকা হলেও বুকটা কেঁপে উঠছিল।
সারি বেঁধে মিনিট পনেরো হাঁটার পরেই দম ফুরোতে লাগল। টর্চের আলোতে একদৃষ্টে এগিয়ে চলার ফলে বুঝতে পারিনি যে আমরা চড়াইয়ে উঠছি। মাঝপথে নির্মাল্য দাঁড়িয়ে পড়ায় সামনের ঢিবিটার দিকে চোখ গেল। বেশ খাঁড়া। এই খাঁড়া পথেই এগিয়ে চললাম । কিছুটা এগোনোর পরেই কানে এল জলের কলকল আওয়াজ। পেমটুককে জিজ্ঞাসা করতেই জানা গেল পাহাড়ের আড়ালে আমাদের সঙ্গেই এগিয়ে চলেছে প্রেকচু নদী। সাচেন থেকে ওপরে ওঠার পথে চঞ্চলা এই নদীর সঙ্গে বারবার সাক্ষাত্ হয়েছে। কিন্তু এখানে যেন এক অন্য রূপ। অন্ধকারের মধ্যেই বুঝতে পারলাম সাপের মত সরু জলধারা নেমে আসছে পাহাড়ি ঢাল বেয়ে। জলের সেই কলকল আওয়াজ ধ্বনিত হচ্ছে আকাশ-বাতাসে। অনুভব করলাম আশেপাশে আবছা শ্বেতশুভ্র পাহাড়গুলো এক দৈত্যের ন্যায় যেন নিদ্রামগ্ন। বেশ কিছুটা পথ এভাবেই হেঁটে চলার পর একটা বাঁকের মুখে এসে দাঁড়ালাম। বাঁক ঘুরতেই অন্যপ্রান্ত থেকে আসা কনকনে দমকা হাওয়া আমাদের পথ আগলে দাঁড়াল। এভাবেই এগিয়ে যাওয়া সত্যি কঠিন। কিছুটা এগোনোর পরই হঠাত্ করেই বরফের ওপর চোখে পড়ল এক অদ্ভূত পায়ের ছাপ। নদীর দিকে নেমে গিয়েছে। জোরালো টর্চের আলো ফেলতেই বুঝতে পারলাম আর কিছু না, তুষার চিতার পায়ের ছাপ। গাইড জানাল কিছুক্ষণ আগেই এ পথে হেঁটে গিয়েছে সে। স্বাভাবিকভাবেই রোমাঞ্চটা আরও কয়েক গুণ বেড়ে গেল। বাঁ পাশে প্রেকচু নদী, ডানদিকে উঁচু পাহাড়ি ঢাল। নিচে বরফে মোড়া দুর্গম পথ। সব যেন ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে আসছে। ঠান্ডা হাওয়ার বেগ বেড়েই চলেছে। কিছুটা এগোনোর পরেই পেমটুকের দৃষ্টি আকর্ষণের ফলে নিচের দিকে তাকালাম। অনেক নিচে অন্ধকারে এক কালো চাদর বিছিয়ে রেখেছে কেউ যেন। চারিদিকে সাদা বরফে মোড়া পাহাড় শৃঙ্গের মাঝে একফালি এক হৃদ। সামিতি লেক। এখান থেকেই উত্পত্তি হয়েছে প্রেকচুর। তবে পেমটুক না বললে, হয়তো বুঝতেই পারতাম না আদপে এটি একটি হৃদ। দিনের আলোয় সৌন্দর্য্যে মোড়া সেই হৃদ এখন যেন এক ভয়ঙ্কর দৈত্যকূল। সামনের রাস্তা দেখা যায় না। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে অনেক নিচে নেমে গিয়েছে সে পথ। আদৌ আর এগনো সম্ভব কি না এ নিয়ে নিজেদের মধ্যেই বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে পড়লাম। হাওয়ার তীব্রতা বাড়ছে। সামনে পথ অজানা। পিছনে ফেরাও সম্ভব নয়। অগত্যা গাইডের ওপরেই ভরসা। অনেকটা নিচে নেমে পেমটুক চিত্কার করে জানালো, রাস্তা আছে তবে সে পথ কেমন কারও জানা নেই। নদীর ধার ধরে সরু এক চিলতে রাস্তা ,সে পথ ধরেই এগিয়ে যেতে হবে। এরই মাঝে ঘটল এক বিপত্তি। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামতে গিয়ে ঝুরো বরফ বুঝতে পারেনি সুমিত। হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল ঝুরো বরফ। তারই সঙ্গে সুমিতও অনেকটা নিচে গড়িয়ে পড়ল। নিচে লেকের ঠান্ডা বরফ গলা জল। কিছুটা আগেই আটকে গেল সুমিত। পাঁচ বন্ধুর চিত্কারে অন্ধকার সেই পৃথিবী যেন গর্জে উঠল। পেমটুক দৌড়ে সুমিতকে উদ্ধার করতে গেল। ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা তখন সকলেই থ মেড়ে গিয়েছি। কিছুটা সময় কাটিয়ে আবারও এগিয়ে চললাম। মনের জোরকে সম্বল করে সুমিতও আমাদের সঙ্গে এগিয়ে চলল। মাঝে দমকা হাওয়ায় কাবু আমাদের দুই বন্ধু এক বিশাল পাথরের আড়ালে দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য হল। আমরা এগিয়ে চললাম। গোচালা ভিউ পয়েন্ট ওয়ান পৌঁছনোর আগে এই পাহাড়ি ঢাল খুব কষ্টকর। শরীরটাকে টেনে টেনে ওপরে ওঠা শুরু হল। কখনও কখনও মন আর মানতে চায় না। তবুও যেন সেই চরুইবেতির মন্ত্রকে সম্বল করে এগিয়ে চললাম। টানা দু থেকে আড়াই কিলোমিটার এই পথ পাহাড়ের ঢালে উঠেই চলেছি। সকলেই আগে পরে এগিয়ে গিয়েছে। পিছনে তাকাতেই চোখে পড়ল সেই সামিটি লেক। অনেকটা পিছনে ফেলে এসেছি। দিনের আলোর প্রথম আভা তখন আকাশ জুড়ে। প্রকৃতির সে এক অনবদ্য রূপ। আমার পিছনেই দাঁড়িয়ে বিশাল সেই মাউন্ট পান্ডিব। এ এক অচেনা পৃথিবী চারিদিক বরফে ঢাকা। দু পাথ এগোতেই চড়াই শেষে চোখে পড়ল সোনালি কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ো। সূর্যের প্রথম কিরণ এসে পড়েছে ভারতের সর্বোচ্চ শৃঙ্গের মাথায়। সব ক্লান্তি যেন নিমেষেই উধাও। সত্যি সার্থক পথ চলা। রাত কেটে গিয়ে দিনের আলো ফুটছে । মনকে বোঝালাম আর মাত্র কিছুটা পথ এগিয়ে যেতেই হবে। আরও আধা ঘণ্টা এভাবেই চলার পর এসে পৌঁছলাম গোয়েচা লা ভিউ পয়েন্ট ওয়ানে। স্বার্থক গোচালা ট্যুর। বারবার একটাই কথা মনে হচ্ছিল, এ কী হেরিলাম। অনেক নিচে জমাট বাধা হিমবাহ। উপরে দাঁড়িয়ে বিশাল কাঞ্চনজঙ্ঘা ও তার পরিবার। কাবরু সাউথ, নর্থ, কাবরু ডোম, গোয়েচা পিক। সূর্যের প্রথম কিরণে আগুন খেলে যাচ্ছে তাদের শরীরে।
কাঞ্চনজঙ্ঘার মাথায় তখন অনবদ্য এক দৃশ্য। একফালি মেঘের আড়ালে চলছে তুষার ঝড়। এত দূর থেকে যা অদ্ভূত সুন্দর দেখাচ্ছে। এসবই মনে শপথ জাগায়। আবারও এ পথে ফিরে আসার শপথ। জীবনকে এভাবেই ছুঁয়ে দেখার শপথ।