খেলায় যখন জেদের জয়

হারের কান্না, চোটের যন্ত্রনা এসব তো চ্যাম্পিয়নের কাছে হারিয়ে যায়। এই ক`মাসে খেলার জগতটাকে ভাল করে খেয়াল করেছেন কী। টেনিস থেকে ক্রিকেট, কিংবা প্যারালিম্পিক্স সব জায়গাতেই রয়েছে একটা মিল।-- তাই নিয়েই লিখেছেন আমাদের প্রতিনিধি পার্থ প্রতিম চন্দ্র।

Updated By: Sep 27, 2012, 07:26 PM IST

খেলার মাঠ মানে কী শুধু হারা- জেতা! শুধুই ট্রফি হাতে উচ্ছ্বাস, শুধুই পরাজয়ের গ্লানি? না খেলাধুলোর জগত জুড়ে থাকে আরও অনেক কিছু। হারের কান্না, চোটের যন্ত্রনা এসব তো চ্যাম্পিয়নের কাছে হারিয়ে যায়। এই ক`মাসে খেলার জগতটাকে ভাল করে খেয়াল করেছেন কী। টেনিস থেকে ক্রিকেট, কিংবা প্যারালিম্পিক্স সব জায়গাতেই রয়েছে একটা মিল। আসলে খেলার জগত দাঁড়িয়ে আছে পরিশ্রম, অধ্যাবসায় আর মানসিক দৃঢ়তার মঞ্চের উপর। সেই সবগুলোই এই ক`মাসে বড় বেশী করে ধরা পড়ল। মারে থেকে যুবরাজ এই ক`মাসে খেলার জগতে যারা শিরোনাম কুড়িয়েছে তাদেরকে নিয়েই এই প্রতিবেদন। তাই নিয়েই লিখেছেন আমাদের প্রতিনিধি পার্থ প্রতিম চন্দ্র
অ্যান্ডি মারে: খালি চোখে ঘটনাটা আর পাঁচটার মতই স্বাভাবিক মনে হবে। ইউএস ওপেন টেনিসের খেতাব হাতে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন অ্যান্ডি মারে। আসলে ওই কান্নার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল অনেক কিছু। দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান, নিজের প্রতি বিশ্বাস আর জেদের জয়ের মিশেল। আসলে কোনও ব্রিটিশ পুরুষ যে কোনওদিন গ্র্যান্ড স্লাম জিতবেন, এই বিশ্বাসটাই হারিয়ে গিয়েছিল। এর আগে চারবার ফাইনালে উঠেও চ্যাম্পিয়ন হতে পারেননি মারে। তখন থেকেই ব্রিটিশদের দীর্ঘ নিশ্বাসটা শুনতে পাচ্ছিলেন। এটাও শুনতে হয়েছিল রুসেদস্কি, হেনম্যানের মতো `গ্রেট লুজার` হয়েই থেকে যেতে হবে তাঁকে। কিন্তু এই কথাগুলোতেই জেদটা বাড়িয়ে নিয়েছিলেন মারে। পরিশ্রমকে দ্বিগুন বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। নাইট পার্টি, বৈভবের জীবন এমনকী গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গেও দূরত্ব বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। লক্ষ্য ছিল একটাই ৭৬ বছরে যা পারেননি কোনও ব্রিটিশ খেলোয়াড় সেটাই করে দেখাবেন। জিতে দেখাবেন গ্র্যান্ড স্লাম। সবাই আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু শেষ অবধি নিজের জেদকে জিতিয়ে দিলেন মারে।

(বিস্তারিত: ছেলেটার ওপর চাপটা ঠিক কতটা ছিল ভাষায় বোঝানো যাবে না। অনেকেই মারের কাছে ব্রিটিশদের এই প্রত্যাশার সঙ্গে আমাদের ওপর সচিনের সম্পর্কের তুলনাটা টানতেই পারেন। কিন্তু তবু বোধহয় ব্যাপরটা ছোট করে দেখানো হবে। আসলে রানি থেকে শুরু করে মিডিয়া, আমজনতা মারের কাছে সবারই এক আবদার, আমাদের একটা গ্র্যান্ড স্লাম ব্রিটিশরা কী আর কোনও দিন বিশ্ব টেনিসের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ জয় করতে পারবেন না? এমন একটা প্রশ্ন কিন্তু গোটা বিশ্বের পাশাপাশি ইংল্যান্ডেও শঙ্কার মেঘ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আসলে টেনিসের সবচেয়ে ঐতিহ্যের উইম্বলডন হয় যে দেশে তারাই কিনা গ্র্যান্ড স্লাম জিততে পারে না? বিষয়টা বাকি বিশ্বের কাছে ঠাট্টার হয়ে দাঁড়ালেও ব্রিটিশদের কাছে ছিল বেদনার, দগদগে ঘায়ের মতো। আর হবে নাই বা কেন? কবে সেই ১৯৩৬ সালে শেষবার গ্র্যান্ড স্লাম জিতেছিলেন ফ্রেড পেরি। ব্যস সেই শেষ। আর কোনও ব্রিটিশ পুরুষের হাতে দেখা যায়নি টেনিসের `অস্কার` পুরস্কার গ্র্যান্ড স্লাম খেতাব। টেনিস বদলেছে, ওপেন এরায় ঢুকে পড়ল গ্র্যান্ড স্লাম। কিন্তু তবু কোনও ব্রিটিশের গ্র্যান্ড স্লাম জেতার নামগন্ধ নেই। ১৯৭২ সালে ব্রিটিশ কন্যা ভার্জিন ওয়াডে গ্র্যান্ড স্লাম জিতলেন। তাতেও খিদে মিটল না। পুরুষদের টেনিসে কিন্তু ব্রিটিশ গ্র্যান্ড স্লাম চ্যাম্পিয়ন পাওয়া গেল না। দশক গেল, দু দশক গেল, দশকের হিসাব হাতের গুনতি ছাড়াল। তবু শূন্য শূন্য রাশি রাশি...। টিম হেনম্যান, গ্রেগ রুসেদস্কির মত ব্রিটিশ তারকারা কাছাকাছি পৌঁছলেন, কিন্তু স্বপ্নের সেই গ্র্যান্ড স্লাম খেতাব আর জেতা হল না। এরপরই ব্রিটিশদের স্বপ্ন নিয়ে এসে পড়লেন স্কটল্যান্ডের ছেলে অ্যান্ডি মারে। মারে শুরুটা করেছিলেন দারুণ। কিন্তু টেনিস বিশ্বে তখন ডাইনোসরদের রাজ (পড়তে হবে রজার ফেডেরার, নাদাল, জকোভিচ)। মারেকে দেখে মনে হল ভাল খেলোয়াড়, কিন্তু ফেডেরার, নাদালদের কাছে ল়ডলেও জিততে পারবেন না। চারবার ফাইনালে উঠলেন, কিন্তু প্রতিবারই সেই হার। দেশবাসীর দীর্ঘ নিশ্বাসটা টের পেলেন মারে, তাই জেদটা বাড়িয়ে নিলেন আর তা দিয়েই বাজিমাত করলেন। ইউএসওপেন জেতার পর আরও গ্র্যান্ড স্লাম জিততেই পারেন মারে। কিন্তু বাকিগুলো আর এতটা তাত্‍পর্যের থাকবে না।)

অ্যালেক্স জানারদি: ২০০১ ফর্মুলা ওয়ান রেস চলাকালীন মারাত্মক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিলেন ইটালির এই ড্রাইভার। দুর্ঘটনায় তাঁর গাড়িটা দলা পাকিয়ে, আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছিলো। অনেক কষ্টে যখন অ্যালেক্স জানারদিকে সেই গাড়ি থেকে বের করে আনা হল তখন তাঁর হৃদপিণ্ড থেমে গেছিল। অনেক আশায় যখন তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হল তখন ডাক্তাররাও হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু কী এক অদ্ভুত জাদুতে আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছিলেন জানারদি। ডাক্তাররা বলেছিলেন, তাঁদের ওষুধের চেয়েও জানারদির বেঁচে থাকার মরিয়া ইচ্ছাটাই বড় হয়ে দেখা দিল। তবে তাঁর পা দুটোকে অঙ্গচ্ছেদ করে দিতে হয়েছিল। সবাই দেখে মাথা নেড়ে হতাশা প্রকাশ করেছিলেন। ফর্মুলা ওয়ানে ধারাভাষ্যের জন্য জানারদির কাছে প্রস্তাব গেল, কিন্তু তিনি জানিয়ে দিলেন ওসব নয় তিনি আবার ট্র্যাকে ফিরবেন। সবাই অবাক হলেন। কিন্তু কোনও পা ছাড়াই রেসিংয়ে নামলেন জানারদি। বিশ্ব মঞ্চেও রেসিংয়ে অংশ নিলেন। কিন্তু তাঁর লক্ষ্য ছিল আরও বড়। দেশের হয়ে অলিম্পিকে পদকজয়। আর তাই খেলা হিসাবে বেছে নিলেন `হ্যান্ড বাইকিং`কে। হাত দিয়ে প্রতিবন্ধীদের জন্য তৈরি বিশেষ গাড়ি চালিয়ে জানারদি নামলেন লন্ডন প্যারালিম্পিকসে। আর সেখানে সবাইকে চমকে দিয়ে দেশকে এনে দিলেন সোনার পদক। পদক জয়ের পর জানারদি জানালেন, জেদটা সম্বল করেই তিনি জীবনে নতুন করে বাঁচলেন আর জিতলেন।

যুবরাজ সিং: ক্রিকেট বিশ্বের এখন এক নম্বর রোল মডেল। অনায়াসে তাঁকে জেদের প্রতীক বলা চলে। ক্যান্সারকে হারিয়ে শুধু বেঁচে ফিরে এসেছেন তাই নয় বাইশ গজেও ছাপ ফেলেছেন। বস্টনের যে হাসপাতালে কেমোথেরাপির চিকিত্‍সা হচ্ছিল, সেই হাসপাতালের জানলা দিয়ে যুবি দেখতেন সবুজ মাঠা বাচ্চারা বেসবল খেলে বেড়াচ্ছে। যুবির প্রত্যাবর্তনের পিছনে এই দৃশ্যের একটা বড় ভূমিকা ছিল। বাইশ গজে যুবির ফিরে আসা আবার গোটা দেশের ক্যান্সার পীড়িতদের কাছে অনুপ্রেরণার।
বিশ্বকাপে আফগান ক্রিকেট দল: শ্রীলঙ্কায় টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলতে দেখলেন আফগানিস্তানকে। ধোনিদের বিরুদ্ধে দারুণ লড়াই করে হাততালিও পেল আফগানরা। কিন্তু ক্রিকেটের বিশ্ব মঞ্চে উঠে আসার গল্পটা অনেক অনেক বেশী অনুপ্রেরণার। দলটার কেউই পেশাদার ক্রিকেটার নন। সবাই ক্রিকেটটা খেলেন কাজের ফাঁকে। এই দলটার ট্রেনিং ক্যাম্পের বাইরে একবার বোমা পড়েছিল। দু`একজন সদস্যের বাড়ির লোকেদের বোমার আঘাতে প্রাণ গেছে। দেশে ফিরে গিয়ে অবশ্য গ্যারান্টি নেই যে তারাও দারুণ শান্তিতে থাকবেন। তালিবান জমানায় খেলা তো দূরের কথা টিভিতে ক্রিকেটও দেখতে পারতেন তা ওরা। সেখান থেকে জেদকে সম্বল করে ওরা বিশ্বমঞ্চে।

(উদাহরণ আরও অনেক আছে। ব্লেড রানার অস্কার পিস্তোরিয়াস থেকে অলিম্পিকে রেকর্ড করা অন্ধ তিরন্দাজ ইম ডং হিউন। এঁদের প্রত্যেকেই এই প্রতিবেদনকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারতেন। কিন্তু স্থানাভাবে সংক্ষিপ্ত করতে বাধ্য হতে হল।)

.