Boxing Day Test: বক্সিং ডে মানে ঘুষোঘুষির দিন নয়, জেনে নিন আসল ইতিহাস
২৬ ডিসেম্বর থেকে শুরু টেস্টকে বলে `বক্সিং ডে টেস্ট`। কেন? এই শব্দবন্ধের গল্প নিয়ে জি ২৪ ঘণ্টার বিশেষ প্রতিবেদন।
সব্যসাচী বাগচী: খেলায় বেশ কিছু শব্দের চল হয়েছে। যেমন—২৬ ডিসেম্বর থেকে শুরু টেস্টকে বলে 'বক্সিং ডে টেস্ট'। কেন? এই শব্দবন্ধের গল্প নিয়ে জি ২৪ ঘণ্টার বিশেষ প্রতিবেদন। কয়েক বছর আগের কথা। অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ ক্রিকেট ছেড়ে পেশাদার বক্সিংয়ে নাম লেখালেও, বক্সিং খেলাটির সঙ্গে ফ্লিনটফের আগে ও পরে আর কোনও ক্রিকেটারের তেমন সখ্যের কথা জানা যায়নি। বক্সিংয়ের কিংবদন্তি প্রয়াত মহম্মদ আলী নিজের নামটিকে বক্সিং খেলার সমার্থক শব্দ বানিয়ে ফেলেছেন। তাই বক্সিং শব্দটি শুনলে আমাদের প্রথমেই মনে পড়ে একে অপরের দিকে মারমুখী ভঙ্গিতে দাঁড়ানো মহম্মদ আলী ও জো ফ্রেজিয়ারের সেই আইকনিক ছবিটার কথা।
এ তো গেল বক্সিং আর মহম্মদ আলীর কথা। কিন্তু বক্সিং ডে? ১৯৭৫-এর অক্টোবরের আলী-ফ্রেজিয়ারের লড়াইয়ের সেই বিখ্যাত দিনটিই কি? আসলে নামের সঙ্গে মিল থাকলেও বক্সিং খেলাটির মতো কোনও মারমুখী 'অতীত' জড়িয়ে নেই 'বক্সিং ডে'-এর সঙ্গে। বরং আছে এক মহতী উদ্যোগ। প্রথাগতভাবে 'বক্সিং ডে' বলতে বোঝানো হয় ক্রিসমাস বা বড়দিনের পরের দিনটিকে। অর্থাৎ ২৬ ডিসেম্বর। খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীরা বক্স কিংবা বাক্সে করে এ দিন গরিব-দুঃখীদের মধ্যে বিভিন্ন উপহার ও টাকা-পয়সা বিতরণ করে থাকেন। কখনও আবার প্রার্থনার শেষে চার্চের বাইরে রাখা বাক্সে দান বা অনুদান সংগ্রহ করা হয় গরিবদের মধ্যে বিতরণের উদ্দেশ্যে। এ কারণেই ২৬ ডিসেম্বর দিনটা ‘বক্সিং ডে’।
'বক্সিং ডে'-এর সঙ্গে বক্সিং খেলাটির কোনও সম্পর্ক না থাকলেও উষ্ণ সম্পর্ক আছে ক্রিকেট, ফুটবল, রাগবি, হকি, ঘোড়দৌড়, হান্টিংসহ অন্যান্য বেশ কিছু খেলার। ছুটির দিনের দর্শকদের আনন্দ দিতে এ দিন পুরোদমে চলে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ। ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ডে, অস্ট্রেলিয়া বা নিউজিল্যান্ডে জনপ্রিয় ঘোড়দৌড়ের পাশাপাশি চলে রাগবি বা আইস হকি লিগের খেলাগুলোও। তবে ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে 'বক্সিং ডে'-এর মাহাত্ম্য 'বক্সিং ডে' টেস্টের মধ্যে নিহিত।
আরও পড়ুন: SAvsIND: কেন নিজেদের বোলিংকে জোরে এগিয়ে রাখলেন Rahul Dravid? জানতে পড়ুন
এই শব্দবন্ধের ইতিহাস খুঁজতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে ১৫০ বছর। 'বক্সিং ডে' কথাটির জন্ম হয়েছিল উনিশ শতকের দিকে। রানী ভিক্টোরিয়ার শাসনকালে। বড়োদিনের প্রেক্ষিতে সেই সময় থেকেই ব্রিটেনে চল ছিল উপহার প্রদানের। উৎসবের আমেজ থাকতেই প্রতি বছর ২৫ ডিসেম্বরের পরেরদিন সেই বাক্স খোলা হত। শুধু উপহারই নয়, ধনীরা ২৬ ডিসেম্বর সাধ্যমতো সামান্য অনুদানও বাক্সবন্দি করে তুলে দিতেন দরিদ্রদের হাতে। সেখান থেকেই দিনটির নামকরণ করা হয় 'বক্সিং ডে'। আবার এই একই দিনের পৃথক ধর্মীয় গুরুত্ব আছে স্পেন এবং আয়ারল্যান্ডে। সেখানে 'সেন্ট স্টিফেন্স ডে' হিসাবে পালিত হয় ২৬ ডিসেম্বর।
রানী ভিক্টোরিয়ার শাসনকালেই বহুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল 'বক্সিং ডে'। শুধু ইংল্যান্ডেই নয়, বরং হাঙ্গেরি, জার্মানি, পোল্যান্ড, নেদারল্যান্ডসেও দ্বিতীয় বড়োদিন হিসাবে পালিত হয় 'বক্সিং ডে'। সেই নিয়ম মেনেই এখনও বন্ধ থাকে সমস্ত সরকারি অফিস। ছুটি দেওয়া হয় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদেরও। ব্রিটিশদের হাত ধরেই এই 'বক্সিং-ডে' ঢুকে পড়েছিল ওশিয়ানিয়া মহাদেশে। উৎসবের একটি বাড়তি দিন হিসাবেই দিনটিকে গ্রহণ করেছিলেন অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের মানুষেরা। এই উদ্দেশ্য নিয়েই অস্ট্রেলিয়ায় শুরু হয়েছিল 'বক্সিং ডে' টেস্ট।
সময়টা আজ থেকে প্রায় ১২৮ বছর আগের। মেলবোর্ন ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ১৮৯২ সালে ভিক্টোরিয়া বনাম নিউ সাউথ ওয়েলসের হাত ধরে শুরু হয়েছিল 'বক্সিং ডে' টেস্ট। তবে বর্তমান যুগের 'বক্সিং ডে' টেস্টের থেকে খানিকটা আলাদা ছিল এর সূচি। ২৬ তারিখ সেই ম্যাচ শুরু না হয়ে, এই দিনটাকে কেন্দ্র করেই ঠিক করা হত ম্যাচের তারিখ।
এখনও সেই নিয়ম বজায় রাখা হয়েছে।তবে ১৯৫০ সাল থেকে শেফিল্ড শিল্ডের পরিবর্তে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে অস্ট্রেলিয়া জাতীয় দলের এই ঐতিহ্যবাহী ম্যাচ। মাঝখানে ছাড়া ছাড়া ভাবে বছর ৩০ চললেও, ১৯৮০ সাল থেকে প্রতিবছর নিয়ম করে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই 'বক্সিং ডে' টেস্ট ম্যাচ। প্রতিবছর ২৬ ডিসেম্বর 'বক্সিং ডে'তে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে অনুষ্ঠিত হয় এই বিখ্যাত টেস্ট। মূলত অস্ট্রেলিয়া জাতীয় দল এবং সেই গ্রীষ্মে অস্ট্রেলিয়া সফরে থাকা দলের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে এই 'বক্সিং ডে' টেস্ট। সবাই ছুটির মেজাজে থাকার জন্য ভরে ওঠে ঐতিহ্যবাহী এমসিজি গ্যালারি।
এ বছরের আগ পর্যন্ত ৪৫ টি 'বক্সিং ডে' টেস্ট খেলে অস্ট্রেলিয়া ২৪টিতে জয়লাভ করে, ৯টিতে পরাজিত হয় এবং ১০টি ম্যাচ হয় ড্র। এরমধ্যে আবার ২০১৭ সালের পর ২০২০ সালেও ভারতের কাছে হেরে যায় অজিরা।তবে ১৯৮৯ সালে 'বক্সিং ডে'-তে টেস্ট ম্যাচের পরিবর্তে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে একটি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছিল অস্ট্রেলিয়া। আর প্রতি চার বছর অন্তর অ্যাশেজের একটি ম্যাচ 'বক্সিং ডে'-তে হয়ে থাকে। যেমনটা এ বারও জো রুটের দল ২-০ ব্যবধানে পিছিয়ে থেকে এই টেস্ট খেলতে নেমে গিয়েছে। অস্ট্রেলিয়া ছাড়াও ওয়েলিংটনের বেসিন রিজার্ভে নিউজিল্যান্ডেও বক্সিং ডে টেস্ট আয়োজন করা হতো। তবে কয়েক বছর ধরে বক্সিং ডেতে টেস্ট ম্যাচের পরিবর্তে নিউজিল্যান্ড টি-টোয়েন্টি এবং একদিনের ম্যাচেই বেশি মনোযোগী।
অস্ট্রেলিয়ার মতো এতটা ঐতিহ্য মেনে না হলেও দক্ষিণ আফ্রিকাও গত কয়েক বছর ধরে 'বক্সিং ডে'টেস্ট শুরু করে দিয়েছে। সাধারণত এটা ডারবানের কিংসমিডের সাহারা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়। তবে এ বার ওমিক্ৰণের জন্য এই টেস্ট সুপারস্পোর্টস পার্ক সেঞ্চুরিয়ানে আয়োজিত হতে চলেছে। তাও আবার ভাইরাস হানার দাপটে দর্শকশূন্য স্টেডিয়ামে খেলবে বিরাট কোহলির টিম ইন্ডিয়া। 'বক্সিং ডে' টেস্টে ভারতীয় দলের অবশ্য ভাল-মন্দ দুটি স্মৃতিই আছে। ১৯৮৫ সালে অজিদের বিরুদ্ধে এই টেস্ট ড্র করেছিল কপিল দেবের ভারত। তবে এরপর বেশ কয়েকটি 'বক্সিং ডে' টেস্টে হেরে গিয়েছিল টিম ইন্ডিয়া। তবে ২০১৪ সাল থেকে চাকা ঘুরতে শুরু করল। সে বার টেস্ট ড্র হয়। এরপর গত দুই বার অস্ট্রেলিয়া সফরে গিয়ে 'বক্সিং ডে' টেস্টে জয়ের মুখ দেখেছে 'মেন ইন ব্লু' ব্রিগেড। তবে এ বার প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া নয়। ১৯৯২-৯৩ মরশুম থেকে দল রামধনুর দেশে গেলেও, টেস্ট সিরিজ জয় এখনও অধরা। গত ২৯ বছরে মাত্র তিনটি টেস্ট জয়ের স্বাদ পেয়েছে ভারত। এ বার কি প্রবল চাপে কোহলি 'বক্সিং ডে' টেস্ট ও সিরিজ জিতে বিসিসিআই-কে নতুন বছরের 'উপহার' দেবেন? সময়ের অপেক্ষায় ক্রিকেট দুনিয়া।