Lionel Scaloni, FIFA World Cup 2022: বিশ্বকাপ জিতে মেনোত্তি, বিলার্দোর তালিকায় নাম লেখাতে পারবেন `পার্ট টাইম` থেকে `ফুল টাইম` কোচ লিওনেল স্কালোনি?
স্কালোনির নাম কোনও পত্রিকার শিরোনামে নেই। ধোঁয়া-ওঠা চায়ের কাপ ও নিকোটিনের সাথে চলা ফুটবলের তুমুল আড্ডায় তাঁর নাম আসে না। বিভিন্ন ফুটবলবোদ্ধারাও তাঁর নাম এড়িয়ে গিয়েছেন বারবার। হয়তো মেসির মতো মহাতারকার সামনে `লো প্রোফাইল` থাকা কোচের কাজগুলো অনেকের কাছেই এড়িয়ে গিয়েছিল। তবে এবার যে আর এড়ানো যাবে না। সেই তাঁর হাতে কাপ উঠুক কিংবা না উঠুক।
সব্যসাচী বাগচী
আর মাত্র একটা ম্যাচ। আর মাত্র একটা ধাপ। লিওনেল স্কালোনি (Lionel Scaloni) কি চলতি বিশ্বকাপ (FIFA World Cup 2022) জিতে তাঁর পূর্বসূরি সিজার লুইস মেনোত্তি (Cesar Luis Menotti), কার্লোস বিলার্দোর (Carlos Bilardo) তালিকায় নাম লেখাতে পারবেন? নাকি তাঁর কপাল আলেজান্দ্রো সাবেল্লার (Alejandro Sabella) মতো হবে। যার কোচিংয়ে আর্জেন্টিনা (Argentina) ২০১৪ সালের ফাইনালে গিয়েও জার্মানির (Germany) কাছে হেরে গিয়েছিল। দেশকে দীর্ঘ ১০ বছর পর কোপা আমেরিকা (Copa America) এনে দেওয়া স্কালোনি, তাঁর দ্বিতীয় সবচেয়ে আন্তর্জাতিক সাফল্যের দিকে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে রয়েছেন। সেই মহার্ঘ্য সোনার ট্রফি তাঁর হাতে উঠবে কিনা, সেটা তো সময় বলবে। তবে ৪৪ বছরের প্রাক্তন উইং ব্যাক ইতিমধ্যেই যে সোনার দল গড়ে, লিওনেল মেসিদের (Lionel Messi) মন জিতে নিয়েছেন সেটা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
প্রতিবেদন লিখতে গিয়ে অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের একটি মুহূর্তের কথা মনে পড়ছে। মেসি পাঁচ ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে গোল করতেই উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েছিলেন দলের সহকারী কোচ ও প্রাক্তন ফুটবলার পাবলো আইমার। তবে স্কালোনি ছিলেন একেবারে চুপ। বলটা জালে ঢুকতেই নিজের আবেগকে সংযম করলেন। জলে গলা ভিজিয়ে আবার বসে গেলেন নিজের চেয়ারে। তবে ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে জয়ের পর আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি। মেসির কপালে চুমু খেয়ে তাঁকে বুকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন। কেঁদেছিলেন জনসমক্ষে। ২০০৬ সালের বিশ্বকাপে এই স্কালোনি ছিলেন মেসির সতীর্থ। দু'জনেরই সেটা ছিল প্রথম বিশ্বকাপ। ৩৫ বছরের 'এল এম টেন' তাঁর আন্তর্জাতিক কেরিয়ারের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন। তবে 'ফুটবলার' স্কালোনি অনেক আগেই প্রাক্তনদের তালিকায় নাম লিখিয়েছিলেন। সেই লোকটার হাতেই এবার দলের রিমোট কন্ট্রোল। তাঁর হাত ধরেই আলবেসেলেস্তেদের আট বছর পরে বিশ্বকাপের ফাইনালে।
এহেন স্কালোনির নাম কোনও পত্রিকার শিরোনামে নেই। ধোঁয়া-ওঠা চায়ের কাপ ও নিকোটিনের সাথে চলা ফুটবলের তুমুল আড্ডায় তাঁর নাম আসে না। বিভিন্ন ফুটবলবোদ্ধারাও তাঁর নাম এড়িয়ে গিয়েছেন বারবার। হয়তো মেসির মতো মহাতারকার সামনে 'লো প্রোফাইল' থাকা কোচের কাজগুলো অনেকের কাছেই এড়িয়ে গিয়েছিল। তবে এবার যে আর এড়ানো যাবে না। সেই তাঁর হাতে কাপ উঠুক কিংবা না উঠুক।
স্কালোনির কাছে আর্জেন্টিনার কোচের দায়িত্বের চাকরি এসেছিল খুবই অপ্রত্যাশিতভাবে। কোচিং কেরিয়ার শুরু হয়েছিল জর্জ সাম্পাওলির সহকারী কোচ হিসেবে। স্কালোনি তাঁর সঙ্গে ছিলেন স্পেনের সেভিয়াতে। এডগার্ডো বাউজাকে ছেঁটে ফেলার পর আর্জেন্টিনা যখন সাম্পাওলিকে কোচ হিসেবে নিয়ে এল, তখন তিনি ছিলেন সাম্পাওলির সহকারী কোচ। এরপর ২০১৮ সালের বিশ্বকাপে ব্যর্থতার সঙ্গে যোগ হয়েছিল আর্জেন্টিনা ফুটবল ফেডারেশনের আর্থিক সমস্যা। বেশি বেতন দিয়ে বিদেশ থেকে নামজাদা কোচ নিয়ে আসার ক্ষমতা তখন ছিল না কর্তাদের। তাই দেশজ প্রাক্তন ফুটবলার স্কালোনি পেয়ে গেলেন 'পার্ট টাইম' হিসেবে কোচের চাকরি। ভাগ্যিস চাকরি গ্রহণ করেছিলেন। নাহলে এমন মুহূর্ত তাঁর সামনে এসে হাজির হত না।
প্রথম দিকে তাঁর দলের পারফরম্যান্সে হতাশা ছাড়া আর কিছু ছিল না। দলে সেই পুরনো ফুটবলার দিয়ে কাজ চালাতে হচ্ছিল, এবং তাঁদের ক্রমাগত ব্যর্থতায় আর্জেন্টিনা শিবিরে ছিল অস্বস্তি। গোলকিপার ফ্রাঙ্কো আরমানি এবং ডিফেন্সে নিকোলাস ওটামেন্ডি-জার্মান পেজেলা জুটিকে দেখে অধিকাংশ দর্শক ছিলেন বিরক্ত। এর মাঝে এল ২০১৯ সালের কোপা আমেরিকা। আর্জেন্টিনা যথারীতি টুর্নামেন্ট শুরু করল বাজে পারফরম্যান্স দিয়ে। প্রত্যাশার পারদ তাই তখনও উঁচুতে চড়েনি। সেবার ব্রাজিলের কাছে হেরে আর্জেন্টিনা টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে যায়।
নাগাড়ে চলা খারাপ সময় স্কালোনির চোখ খুলে দিয়েছিল। শুরু করলেন দলে পুনর্নির্মাণ প্রক্রিয়া। পরিবর্তন আনার জন্য আর্জেন্টিনা থেকে ইতালি, স্পেন থেকে ফ্রান্স, এমনকি নেদারল্যান্ডসে—কোনও আর্জেন্টাইন ভালো পারফরম্যান্স করলেই তাঁকে জাতীয় দলে ডেকে নিতেন। শুরুর দিকে তাঁর এমন দৃষ্টিভঙ্গি অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। বিশেষ করে একদল সিনিয়ররা তো বিদ্রোহ ঘোষণা করে দিয়েছিলেন। তবে অভিজ্ঞ ফুটবলারদের তিনি একেবারে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন, সেটাও নয়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দল যাতে মেলে ধরতে পারে সেইজন্য অভিজ্ঞ সিনিয়রদের সঙ্গে তারুণ্যের মিশেল ঘটিয়েছিলেন। আর সেইজন্যই ১০ বছর পর কোপা জিতেছিল নীল-সাদা বাহিনী।
আর একটা কাজ তিনি এসে করেছেন। আর্জেন্টিনা দলে মেসি নির্ভরতা কমিয়ে দিয়েছেন। একটা সময় পর্যন্ত মেসিকে ব্যবহার করা নিয়ে জাতীয় দলের কোচরা চিন্তিত থাকতেন। ব্রাজিল বিশ্বকাপ এবং এর পরবর্তী সময়ে টাটা মার্টিনোর হাত ধরে মেসি খেলেছেন সেকেন্ড স্ট্রাইকার এবং প্লে-মেকারের ভুমিকায়। এরপর আর্জেন্টিনায় যে দু'জন কোচ এসেছিলেন, তাঁরা মেসিকে খেলিয়ে দেখতে চেয়েছেন —পাওলো দিবালা ও মাউরো ইকার্দির সঙ্গে উইঙ্গার হিসেবে। কিংবা দুইজন স্ট্রাইকারের ঠিক নিচে নাম্বার টেন মেসি।
ফলে শেষ কয়েক বছর আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে মেসির পারফরম্যান্সটা ঠিক 'মেসিসুলভ' ছিল না। স্কালোনি দায়িত্ব নেওয়ার পরেই মেসির সঙ্গে আলোচনা করেছেন। দলের সবচেয়ে হাই-প্রোফাইল ফুটবলার কীভাবে সাহায্য করতে পারেন, সেটা জেনেছেন মেসির কাছ থেকেই। তাই বলে আর্জেন্টিনায় মেসি-নির্ভরতা কি একেবারে কমে এসেছে? এমনটা নয়। তবে স্কালোনি তাঁর পূর্বসূরিদের মতো স্রেফ মেসিকে ঘিরে আর্জেন্টিনার একাদশ সাজাননি। বরং তাঁর একাদশে মেসি শুধুই দলের অন্যতম সেরা ফুটবলার। ফলে মেসিকেও আলাদা চাপ নিতে হয়নি। স্কালোনি যখন যেভাবে মেসিকে চেয়েছেন, মেসি নিজেও মাঠে সেভাবেই খেলছেন। সেটা চলতি কাপ যুদ্ধেই টের পাওয়া যাচ্ছে।
তাই তো সৌদি আরবের বিরুদ্ধে এগিয়ে থেকে হেরে যাওয়ার পরেই আর্জেন্টিনা কামব্যাক করেছে। প্রতিপক্ষ বুঝে দলের একাদশ এবং ফুটবলার স্কালোনি পরিবর্তন করেছেন বারবার। আসলে সাজানো কোনও পরিকল্পনা নিয়ে তিনি একাদশ সাজান না। তাঁর নিজের পছন্দের ফুটবল-কৌশল রয়েছে ঠিকই, কিন্তু ম্যাচের আগে প্রতিপক্ষ বুঝে তাঁর কৌশল পাল্টে যায়। এমনকি বদলে ফেলেন ফুটবলারও। মেক্সিকো থেকে অস্ট্রেলিয়া, কিংবা পোল্যান্ড থেকে ক্রোয়েশিয়া —প্রত্যেক দলের বিরুদ্ধে তিনি কৌশল ব্যবহার করেছেন। এবং পেয়েছেন সাফল্য।
যখন আক্রমনাত্মক ফুলব্যাক দরকার হয়েছে, তখন মাঠে নামিয়েছেন গ্যাব্রিয়েল মন্টিয়েলকে। ডিফেন্সে বেশি নজর দেওয়ার যখন প্রয়োজন হয়েছে, তখন মাঠের ডান দিকে নেমেছেন নাহুয়েল মোলিনা। মিডফিল্ডেও একই কথা। বক্স-টু-বক্স হিসেবে খেলেছেন রড্রিগো ডি পল এবং লিয়ান্দ্রো পারেদেস। যদি প্লে-মেকিং প্রয়োজন হয়, তখন মাঠে থেকেছেন আলেজান্দ্রো (পাপু গোমেজ)। ম্যাচের অবস্থা বুঝে সুযোগ পেয়েছেন এক্সকুয়েল প্যালাসিওসকে। ৪-৪-২ ডায়মন্ড ছকে অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়ার দুরপাল্লার শট নেওয়ার দক্ষতাকে তিনি ব্যবহার করেছেন বিশেষ প্রয়োজনে। আর আর সবচেয়ে বড় ম্যাচ উইনার মেসিকে দিয়েছেন পর্যাপ্ত স্বাধীনতা। স্কালোনির বিশেষত্ব এখানেই।
পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য আলবিসেলেস্তে সমর্থকেরা এখন কলার তুলে ঘুড়ে বেড়াচ্ছেন। আর্জেন্টিনার দলের এই বিজয় দৌড় নিয়ে সবাই গর্বিত। বিভিন্ন সময় ঘুরেফিরে আসে মেসিদের কোপা জয়ের স্বপ্নপূরণের গল্পগাথা। ফুটবলাররা এখনও সময় পেলেই কোপা জয়ের সেলিব্রেশন করেন। নিজেদের টি-শার্টে সেই ফাইনাল জয়ের ছবি প্রিন্ট করে ঘুরে বেড়ান ফুটবলাররা।
২০১৮ সালের বিশ্বকাপে শেষ হাসি হেসেছিল ফ্রান্স। প্রি কোয়ার্টার ফাইনালে ৪-৩ গোলে দিদিয়ের দেশঁ ছেলেরা উড়িয়ে দিয়েছিল আর্জেন্টিনাকে। চার বছর পর এবার সেই প্রতিশোধ কি নিতে পারবেন স্কালোনি ও মেসিরা। কাজানের বদলা কি লুসেলে নেওয়া যাবে? উত্তর দেবে সময়।
(Zee 24 Ghanta App দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)