FIFA World Cup 2022, NED vs ARG: ভ্যান গালের দর্প চূর্ণ! এমিলিয়ানোর গ্লাভস, মেসির গোলের উপর ভর করে শেষ চারে আর্জেন্টিনা
ঝিমিয়ে যাওয়া ম্যাচে যে মেসি এমন গতি এনে দেবেন, সেটা অনেকেই বুঝতে পারেননি। দলের অধিনায়কের সৌজন্যে ৩৫ মিনিটে এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা। গোলকিপার আন্দ্রিয়েস নোপার্টের ডান দিক থেকে বাঁ পায়ের মাটি ঘেঁষা শটে জালে জড়িয়ে দেন ২৪ বছরের নাহুয়েল মোলিনা।
সব্যসাচী বাগচী
আর্জেন্টিনা: ২ ('৩৫ নাহুয়েল মোলিনা, '৭৩ লিওনেল মেসি)
নেদারল্যান্ডস: ২ ('৮৩, '১০১ ওয়াউট ওয়েঘর্টস)
টাইব্রেকার
আর্জেন্টিনা: ৪
নেদারল্যান্ডস: ৩
এ যে একেবারে ব্রাজিল (Brazil) বনাম ক্রোয়েশিয়া (Croatia) ম্যাচের রিমেক। প্রথম কোয়ার্টার ফাইনালের পর দ্বিতীয় কোয়ার্টার ফাইনালের রেজাল্টও ভাগ্যের উপরেই ঝুলে ছিল। কারণ অতিরিক্ত সময় আর্জন্টিনা একের পর এক অ্যাটাক করে গেলেও বল জালে ঢুকল না। খোদ লিওনেল মেসির (Lionel Messi) দুটি শট বাতিলের খাতায় চলে গেল। তবুও টাইব্রেকারে দলের সম্মান বাঁচালেন গোলকিপার এমিলিয়ানো মার্টিনেজ (Emiliano Martinez)। তাও আবার জোড়া সেভ করে। ফলে কোয়ার্টার ফাইনালের এই থ্রিলার ৪-৩ ব্যবধানে জিতে শেষ চারে চলে গেল আর্জেন্টিনা (Argentina)। এবার সেমি ফাইনালে সামনে ক্রোয়েশিয়া। ১৪ ডিসেম্বর এই লুসেল স্টেডিয়ামে ফের নামবে নীল-সাদা বাহিনী। ফের একবার লড়াই করার রসদ নেবেন লিওনেল স্কালোনির দল।
একেবারে হেরে যাওয়া ম্যাচ। আর্জেন্টিনার জেতা শুধু সময়ের অপেক্ষা। ঠিক এমন ম্যাচের রং একেবারে বদলে দিলেন 'সুপার সাব' ওয়াউট ওয়েঘর্টস। প্রথমে ৮৩ মিনিটে গোল করে কমালেন ব্যবধান। এরপর ম্যাচের শেষ দিকে ১০১ মিনিটে বার্গুইসের ফ্রিকিক ধরে বাঁ পায়ের শটে ফের গোল করলেন ফের ওয়েঘর্টস। তাঁর জোড়া গোলের সৌজন্যে যেমন ডাচরা জীবন ফিরে পেল, ঠিক তেমনই ম্যাচ গড়াল অতিরিক্ত সময়ে। ম্যাচের উত্তাপ বেড়েই যাচ্ছিল। মেসিদের বিরুদ্ধে ডাচ ফুটবলাররা একের পর এক ফাউল করেই যাচ্ছিলেন। তাই সবাইকে চমকে দিয়ে রেফারি (Referee) আন্তোনিও মাতেউ লহোজ (Antonio Mateu Lahoz) মোট এর মধ্যে আর্জেন্টিনা দলকেই দেখান হয়েছিল ১০টি হলুদ কার্ড। আর্জেন্টিনা দলের ১০টি হলুদ কার্ডের মধ্যে দুটি দেখানো হয়েছে কোচ লিওনেল স্কালোনি আর তাঁর সহকারীকে। হলুদ কার্ড দেখা আটজনের মধ্যে ছিলেন মেসিও। আর প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হলুদ কার্ড দেখার জন্য তো সেমিফাইনালেই খেলতে পারবেন না মার্কোস আনুকিয়া ও গঞ্জালো মনট্রিয়েল। অন্যদিকে ডাচদের আটটি কার্ড দেখিয়েছেন এই রেফারি। এরসঙ্গে ডেনজেল ডামফ্রায়েস-কে দুবার হলুদ কার্ড দেখিয়েছিলেন লহোজ। তাই ম্যাচ শেষ হতেই এহেন স্প্যানিশ রেফারির বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়ে, ফিফা-র (FIFA) কাছে অভিযোগ করলেন আর্জেন্টিনার অধিনায়ক। তবে অতিরিক্ত সময়েও ম্যাচের নিষ্পত্তি হল না। তাই ভাগ্য ঝুলে রইল টাইব্রেকারে। সেখানে শেষ হাসি হাসল মেসির দল।
কথায় আছে 'বিষধর সাপের লেজে পা দিতে নেই'। কিন্তু সেটা ভুলে কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচের আবহ গরমাগরম করার জন্য লুইস ভ্যান গাল সেটাই করেছিলেন। লিওনেল মেসির জাত্যাভিমান নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি তাঁর বিপক্ষকে দিয়েছিলেন তাতিয়ে। তবে সেই গনগনে আঁচেই পুড়ে গেলেন তিনি। উড়ে গেল নেদারল্যান্ডসের 'টোটাল ফুটবল'। ভাবা গিয়েছিল 'এল এম টেন'-এর দাপটে ২-১ ব্যবধানে হেরে চলতি বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেবে ডাচরা। তবে সেটা হয়নি। কারণ ওয়াউট ওয়েঘর্টস শেষ দিকে জোড়া গোল করে ম্যাচ ঘুরিয়ে দেন।
এই মাঠেই এগিয়ে থেকেও সৌদি আরবের বিরুদ্ধে হেরে কাপ যুদ্ধের অভিযান শুরু করেছিল আর্জেন্টিনা। সেই মাঠেই সেমি ফাইনালের খুব কাছে একটা সময় চাপে পড়লেও কোয়ালিফাই করে গেল মেসির আলবিসেলেস্তেরা। আর এমন আগুনে পারফরম্যান্স করলে যে গ্যালারি-সহ গোটা ফুটবল দুনিয়ার অগণিত ভক্তরা উল্লাস করবেন, গান গাইবেন, এতে আর অবাক হওয়ার কি আছে। প্রিয় মেসির জন্য তো শুধু নাচ, গান নয়। অনেক রাত জেগে থাকা যায়। অনেক অনেক পথ হেঁটে যাওয়া যায়।
ম্যাচটা খাতায়-কলমে ম্যাচটা আর্জেন্টিনা বনাম নেদারল্যান্ডসের হলেও, মঞ্চের পিছনে একটা অন্য লড়াই অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। লিওনেল মেসি বনাম বিপক্ষের হাই প্রোফাইল কোচ লুইস ভ্যান গালের মধ্যে 'ইগো'-র লড়াই। অবশ্য যুদ্ধের শুরু মোটেও মেসির তরফ থেকে হয়নি। বরং হাই ভোল্টেজ কোয়ার্টার ফাইনালের আগে আগুনে ঘি ঢালার কাজটা করেছিলেন ক্যানসার সারিয়ে মাঠে ফিরে আসা বিপক্ষের ৭১ বছরের কোচ। মেসিকে নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই সাংবাদিক বৈঠকে সটান বলে দিয়েছিলেন, 'মেসি ইজ চিলিং সামহোয়ার'! ও খুবই ভালো ফুটবলার। আক্ষরিক অর্থে বিপজ্জনক স্ট্রাইকার। সঙ্গে অসম্ভব সৃষ্টিশীল। মেসি যেমন গোল করে, তেমনই অনেক গোলের জন্য অ্যাসিস্ট করতে পারে। কিন্তু মেসির একটা দুর্বলতাও আছে। যখন ও পায়ের কাছ থেকে বল হারায়, তখন বল ধরার জন্য চেষ্টা করে না। সেই দুর্বলতা আমাদের কাজে লাগাতে হবে।'
ভ্যান গালের যুক্তি একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আধুনিক ফুটবলে বল হারানো মাত্র প্রেসিং করাটা যে কোনও ফুটবলারের জন্য অবশ্যপালনীয় এক কর্তব্য। তিনি ডিফেন্ডার না স্ট্রাইকার, তাতে কিছু আসে–যায় না। মেসি এই ক্ষেত্রে আশ্চর্য এক ব্যতিক্রম হয়েই আছেন। প্রতিপক্ষ যখন আক্রমণে ওঠে, বলতে গেলে মাঠে নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকেন! কিন্তু কোন সময় কোন মন্তব্য করা উচিত সেটা হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন ভ্যান গাল। তারকা খেলোয়াড়দের এমনিতেই 'ইগো' বড্ড বেশি। এরমধ্যে সেই ব্যক্তি মেসি নামক মহাতারকা হলে তিনি তো পালটা দেবেনই। সেটাই দিলেন। নিজে গোল না করলেও, ভ্যান গালের রক্ষণকে ফালাফালা করে নাহুয়েল মোলিনাকে দিয়ে প্রথম গোলটা করিয়ে দিলেন। এরপর পেনাল্টি থেকে করে দিলেন দলের জন্য দ্বিতীয় গোল। আর এই গোলের সুবাদে কাপ যুদ্ধের মঞ্চে ১০টি গোল করে ফেললেন মেসি। কটাক্ষের জবাব দিলেন ভ্যান গাল-কে।
তবে এই ম্যাচের আগে আর্জেন্টাইনদের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা ছিল। কারণ ভেন্যু লুসেল স্টেডিয়াম। যে মাঠে এগিয়ে থেকেও হারতে হয়েছিল সৌদি আরবের বিরুদ্ধে। তাও আবার কাপ অভিযানে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই হেরে মুখ ঢেকে মাঠ ছেড়েছিলেন মেসি। হ্যাঁ এটা ঠিক যে, এই লুসেলেই আবার মেক্সিকোর বিরুদ্ধে জিতে ভেসে উঠেছিল আলবিসেলেস্তেরা। তবে তাতে কি! চাপের সময় খারাপ মুহূর্তগুলোই মাথার মধ্যে ঘুরপাক করে। তাছাড়া খেলোয়াড়রা এমনিতেই নানান সংস্কার মেনে চলেন। তাই সমর্থকদের মনের মধ্যে একটা আশঙ্কা ছিলই। এরসঙ্গে যোগ হল ব্রাজিলের বিদায়। লাতিন আমেরিকা থেকে আসা অন্যতম ফেভারিট দল ছাঁটাই হলে, আর এক লাতিন আমেরিকার দলের রক্তচাপ তো বাড়বেই। সে সেলেকাওরা যতই আলবিসেলেস্তেদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী হোক। এরমধ্যে আবার এডুকেশন সিটি স্টেডিয়াম থেকে লুসেলের দুরত্ব যখন মাত্র ২০ মিনিট। মেসির সঙ্গে নেইমারের বন্ধুত্ব নিয়ে সর্বত্র চর্চা হয়। তাই চোখের জলে নেইমারের বিদায়ে 'এল এম টেন'-এর মন খারাপ তো হবেই। যদিও মেসি নিজেই সেই আশঙ্কা দূর করে দিলেন। যোগ্য নেতার মতো সামনে থেকে লড়াই করে।
কারণ এই মেসি যে একেবারে অন্য ধাতুতে গড়া। চলতি কাপ যুদ্ধে সেটা যেন বারবার বুঝিয়ে দিচ্ছেন মহাতারকা। শুরু থেকেই দুই দল নিজেদের রক্ষণকে জমাট করে মাঝমাঠে খেলে যাচ্ছিল। তবে সুযোগ পেলে প্রতি আক্রমণে যেতে কেউ থেমে যায়নি। দু’দলই খেলা তৈরি করছিল নিজেদের রক্ষণ থেকে। নিজেদের মধ্যে ছোট ছোট পাসে বলের নিয়ন্ত্রণ রাখার চেষ্টা করছিল। তারপর যাচ্ছিল আক্রমণে। কিন্তু প্রতিপক্ষের রক্ষণ জমাট থাকায় গোলের সুযোগ তৈরি হচ্ছে না। তাই মাঝে মধ্যে খেলার গতি খুব মন্থর হয়ে যাচ্ছিল।
আরও পড়ুন: Neymar, FIFA World Cup 2022: পেলে-কে ছুঁয়ে ফেললেও, কাপ যুদ্ধ থেকে চোখের জলে নেইমারের বিদায়
এমন ঝিমিয়ে যাওয়া ম্যাচে যে মেসি এমন গতি এনে দেবেন, সেটা অনেকেই বুঝতে পারেননি। দলের অধিনায়কের সৌজন্যে ৩৫ মিনিটে এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা। প্রায় ৩০ গজ দূরে বল ধরেন মেসি। ঘাড়ের কাছে চার জন ডিফেন্ডারকে নিয়ে সামনের দিকে এগোন। যেমনটা অহরহ করে থাকেন। এরপর তাঁর সোনার বাঁ পা দিয়ে কোনাকুনি শটে বল বাড়ান বক্সে ঢুকে যাওয়া নাহুয়েল মোলিনার দিকে। বল ধরে আগুয়ান গোলকিপার আন্দ্রিয়েস নোপার্টের ডান দিক থেকে বাঁ পায়ের মাটি ঘেঁষা শটে জালে জড়িয়ে দেন ২৪ বছরের এই রাইট ব্যাক।
গোল করার পরে খেলা আর্জেন্টিনা আরও অনেক বেশি আক্রমণাত্মক মেজাজে খেলতে থাকে। নীল-সাদা বাহিনী আরও দু'বার ডাচদের বক্সের কাছে পৌঁছে যায়। যদিও মেসির ডান পায়ের শট গোলকিপার আটকে দেন। অন্য দিকে প্রথমার্ধের শেষ দিকে তিনটি ফ্রিকিক পায় নেদারল্যান্ডস। কিন্তু সেখান থেকে ফসল তুলতে পারেনি তারা। ফলে প্রথমার্ধে ১-০ গোলে এগিয়ে আর্জেন্টিনা। দ্বিতীয়ার্ধে ডাচরা অনেক বেশি আগ্রাসী মেজাজে শুরু করলেও লাভ হয়নি। কারণ বক্সের মধ্যে আকুনাকে ফাউল করেন ডেঞ্জিল ডামফ্রিস। পেনাল্টি পায় আর্জেন্টিনা। এবার গোল করতে ভুল করেননি মেসি। গোলকিপারের বাঁ দিক দিয়ে বল জালে জড়িয়ে দেন তিনি। ফলে ২-০ এগিয়ে যায় নীল-সাদা বাহিনী। পরিবর্ত হিসেবে নেমেছিলেন বেঞ্চে থাকার সময়ই একটা হলুদ কার্ড দেখেছিলেন। সেই ওয়েহস্টই নেদারল্যান্ডসের ব্য়বধান কমালেন। ম্যাচের ৮৩ মিনিটে। তখনও পর্যন্ত মেসির দল শেষ চারে যাওয়ার ব্যাপারে অনেকটাই নিশ্চিন্ত ছিল। তবে এবারও সেই ব্রাজিল বনাম ক্রোয়েশিয়া ম্যাচের রিমেক। ১০১ মিনিটে বার্গুইসের ছোট ফ্রিকিক ধরে বাঁ পায়ের শটে গোল করলেন ওয়েহস্ট। ফলে অপ্রত্যাশিত ভাবে ম্যাচ গড়াল অতিরিক্ত সময়ে। সেখানেও ফলাফল ২-২! তবে শেষ পর্যন্ত চাপ বজায় রেখে টাইব্রেকারে বাজিমাত করে সেমি ফাইনালে চলে গেল আর্জেন্টিনা।
আর্জেন্টাইন ফুটবল ইতিহাসে নেদারল্যান্ডসের একটা আলাদা জায়গা আছে। ১৯৭৮ বিশ্বকাপের ওয়েহস্ট।ফাইনালে নেদারল্যান্ডসকে হারিয়েই আর্জেন্টিনার প্রথম বিশ্ব জয়। বিস্ময়কর হল, এই ম্যাচের আগে গত নয় ম্যাচে নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে আর্জেন্টিনার এই একটাই জয়। ২০১৪ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে অবশ্য না জিতেও জিতেছিল মেসির দল। টাইব্রেকারে সেই হারের জ্বালা এখনো ভোলেননি ভ্যান গাল। সেই বিশ্বকাপেও তো তিনিই নেদারল্যান্ডসের কোচ। আবার আর্জেন্টিনার সঙ্গে দেখা হওয়া নিশ্চিত হতেই তাই সোজা বলে দিয়েছিলেন, ‘একটা হিসাব মেটানোর আছে!' কিন্তু মেসি যে তাঁর প্রতি কটাক্ষের জ্বালা মিটিয়ে 'টোটাল ফুটবল'-কে একেবারে মাটিতে মিশিয়ে বিশ্বকাপ থেকেই ছিটকে দেবেন সেটা কে জানত!
(Zee 24 Ghanta App দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)