সব্যসাচী বাগচী: প্রবাদপ্রতিম জোহান ক্রুয়েফ ও পেপ গোয়ার্দিওয়ালার মধ্যে সম্পর্ক যেমন, ঠিক সেই ভাবেই প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুভাষ ভৌমিকের সম্পর্ককে বিশ্লেষণ করা যায়। ভারতীয় ফুটবলের নিরিখে দুজনই প্রবাদপ্রতিম। এবং কাকতালীয় ভাবে দুজনেই প্রয়াত। গুরু ২০২০ সালের ২০ মার্চ ঘোর কোভিডের মধ্যে চলে গিয়েছিলেন। প্রিয় শিষ্য তাঁর কোচের পিছু নিলেন ঠিক দুই বছরের মাথায়। ২০২২ সালের ২২ জানুয়ারি না ফেরার দেশে চলে গেলেন সুভাষ।


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

কয়েক বছর আগে এই প্রতিবেদককে সুভাষ বলেছিলেন তাঁর পিকে সাক্ষাতের কথা। সালটা ১৯৭১। হাঁটুতে মারাত্মক চোট পেয়েছিলেন। ভারতীয় দলে খেলার পাশাপাশি সেই সময় সবুজ-মেরুন জার্সি গায়ে চাপিয়ে আগুন ঝরাচ্ছেন সুভাষ। এমন সময় ঘটে গেল বিপত্তি। তিনি বলেছিলেন, “৭১ সালে মারডেকায় বার্মার বিরুদ্ধে খেলতে গিয়ে ডান হাঁটুতে চোট পেলাম। ওই বছরের শেষের দিকে ওই চোট নিয়ে রাশিয়ায় খেলতে গেলাম। সেখানকার ডাক্তার বলল অস্ত্রোপচারের দরকার নেই। তাই আর অস্ত্রোপচার করিনি। রাশিয়ান ডাক্তারদের কথা শুনে। ওই ইনজুরি নিয়ে ৭২ সালে মোহনবাগানে খেললাম। রোজ একটা করে ইনজেকশন নিয়ে খেলতাম। একদিন নঈমদা দেখে তো অবাক। পরের বছরের জন্য মোহনবাগান আর আমাকে রাখল না। 'বেতো ঘোড়া' বলে ছেড়ে দিল! আমি মোহনবাগান থেকে বেরিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ইডেনের পাশ দিয়ে হাঁটছি আর ভাবছি, ফুটবল ছাড়া সুভাষের জীবন মূল্যহীন। গঙ্গায় গিয়ে ডুবে মরব। এই সময় একটা ফিয়েট গাড়ি করে ইস্টবেঙ্গলের জ্যোতিষ গুহ, শান্ত মিত্র ও অজয় শ্রীমানি আমাকে তুলে নিয়ে গেল একেবারে প্রদীপ ব্যানার্জি বাড়ি। সেই শুরু।“



প্রয়াত পিকে তাঁর ছাত্র সুভাষকে ছেলের মতো স্নেহ করতেন। আদর করে নাম দিয়েছিলেন ‘ভোম্বলবাবু’। ঠিক তেমনই সুভাষ ঘরণীকেও খুবই স্নেহ করতেন তিনি। সেই স্মৃতিকে তুলে ধরলেন পিকে-র বড় কন্যা পলা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি জি ২৪ ঘণ্টাকে বলেন, “তখন সুভাষ কাকা সদ্য বিয়ে করেছে। এমন সময় ইস্টবেঙ্গলের ডুরান্ড কাপের খেলা ছিল। কাকা সেই সময় খুকু কাকিমাকে নিয়ে মুম্বই যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাবা সেটাতে একেবারে রাজি ছিলেন না। কারণ বাবা জানতেন যে কাকিমা গেলেই ভৌমিক কাকা খেলায় মন দিতে পারবেন না। শেষ পর্যন্ত বাবার নির্দেশ মেনে কাকিমা মুম্বই যাওয়া বাতিল করেছিলেন। সেটা নিয়ে অবশ্য ভৌমিক কাকা ও বাবার মধ্যে খুব রাগারাগিও হয়েছিল।“


গুরু ও শিষ্য একে অপরকে সম্মান করতেন। তবে দুজনের মধ্যে প্রচন্ড ঝগড়া ঝামেলাও হয়েছে। সেটাও একবার তুলে ধরেছিলেন সদ্য প্রয়াত। বিশেষ করে সুভাষের বিয়ার খাওয়া একেবারেই মেনে নিতে পারতেন না পিকে। সুভাষ বলেছিলেন, “খেলেয়াড় জীবনে আমি খুব বিয়ার খেতাম। প্রদীপ ব্যানার্জি নিজের পৈতে বার করে বলেছিল, ‘এটা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা কর, আর কোনওদিন বিয়ার খাবি না।‘ আর এখন বাবা-মার সঙ্গে সময় কাটাও। ১২ দিনের মাথা থেকে শুরু হবে তোমার ট্রেনিং। সেই ট্রেনিং পাস করলে, তবেই তুমি আমার কোচিংয়ে স্থান পাবে। আর তবেই মিলবে বিয়ার খাওয়ার অনুমতি।“


আরও পড়ুন: Exclusive: বিদায়বেলায় প্রিয় ‘ভোম্বল দা’কে নিয়ে আবেগপ্রবণ Bhaichung Bhutia


আরও পড়ুন: Subhash Bhowmick Died: পাঁচ গোলের গর্ব ও লজ্জা নিয়েও ‘টাইগার আজীবন জিন্দা হ্যায়’


ফুটবলার হিসেবে সুভাষ ছিলেন ডাকাবুকো। মস্তান গোছের। সেটা তাঁর কোচিং জামানার প্রথম দিকেও দেখা যেত। সেটা না থাকলে বাইচুং ভুটিয়া, মাইক ওকোরো, সুলে মুশা, ডগলাস, এডমিলসনদের মতো একাধিক বিদেশি ও ভারতীয় তারকাকে ম্যানেজ করা সম্ভব নয়। তবে কোচিং করার গুন কিন্তু তাঁর ‘গুরু’র কাছ থেকেই শেখা। আর সেটা হয়েছিল ট্যুরে গিয়ে পিকে-র সঙ্গে এক ঘরে থাকার জন্য! ভাবা যায়। শুধু আজকের যুগ নয়, কোচ ও দলের তারকা ফুটবলার এক ছাদের তলায় থাকছেন! জাস্ট ভাবাই যায় না। কিন্তু পিকে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ছাত্রকে সেই স্পেস দিয়েছিলেন। আর সেটাই ছিল কোচ সুভাষের দীক্ষার প্রথম পাঠ।  



এই প্রসঙ্গে সুভাষ একবার বলেছিলেন, “আমি পিকে ব্যানার্জির রুম পার্টনার ছিলাম। একমাত্র আমাকেই উনি নিজের ঘরে থাকতে দিতেন।“ কী করতেন সেই সময় ফুটবলার সুভাষ? তিনি যোগ করেছিলেন, “ওই অল্প সময় গুরু পিকে-র সব খুঁটিনাটি বিষয়গুলি দেখতাম। কী করে পি কে ব্যানার্জি জার্সি ভাজ করেন, বুট পরিষ্কার করেন, বই পড়েন — ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার জীবনে দু’জন ধর্মগুরু। এক, ঈশ্বর। দুই, পিকে ব্যানার্জি। আর কাউকে আমি বিশ্বাস করিনা। তাই ওঁর সঙ্গে কাটানো সময়গুলো থেকেই কোচিং করানোর ইচ্ছা জেগেছিল।“


পিকে-র সঙ্গে হাজার বিষয়ে ঝামেলা থাকলেও, তিনি ছিলেন সুভাষের কাছে পিতৃসম। তাই সদ্য প্রয়াত সুভাষের প্রথম সন্তান যখন গুরুতর অসুস্থ তখন সবার আগে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন পিকে। সেই দিনের কথাগুলো মনে করে পলার গলা যেন শুকিয়ে আসছিল। তিনি বলছিলেন, ‘অনেকেই জানেন না যে ভৌমিক কাকার প্রথম ছেলে কম বয়সে চলে যায়। সেই সময় কাকা ও খুকু কাকিমা উদ্ভ্রান্তের মতো হয়ে গিয়েছিলেন। তবে সেই কঠিন সময়ও বাবা হাল ছাড়েননি। আমার মামা ছিলেন ডাক্তার। তিনিই সেই ছেলের চিকিৎসা করেছিলেন। তবে বাচ্চাটাকে বাঁচানো গেল না। সেটা নিয়ে বাবা খুব আক্ষেপ করতেন। আসলে আমাদের সম্পর্কটা খুবই পারিবারিক ছিল।“


সত্যি ওঁদের দুজনের সম্পর্কটা কোচ ও ফুটবলার থেকে অনেক অজান্তে বাবা-ছেলের মতো হয়ে গিয়েছিল। তাই তো লাইসেন্স না করলেও, সেটা নিয়ে আশিয়ান কাপ এবং দুবারের জাতীয় লিগ জয়ী কোচের বিন্দুমাত্র আফসোস ছিল না। বরং সেটা নিয়ে কেউ কটাক্ষ করলেই তীব্র শ্লেষ মিশিয়ে সুভাষ দৃপ্ত কণ্ঠে বলে উঠতেন, “আমার লাইসেন্স সল্টলেকের বাড়িতে রাখা আছে। যেখানে আমি নাড়া বেঁধেছিলাম।“


আপনি এটাকে ওঁর ওভার কনফিডেন্স বলতে পারেন। আপনার মনে হতে পারে মানুষটা লাইসেন্স জোগাড় করে নিজের বায়োডাটা আরও একটু আকর্ষণীয় করতে পারতেন। কিন্তু বিশ্বাস করুন, সুভাষ ভৌমিক এমনই স্বভাবের। তিনি মস্তানের মতো বেঁচেছেন। কারণ তাঁর নামের সঙ্গে যে ‘বুলডোজার’ শব্দটা রয়েছে। যেটা ‘ভোম্বলবাবু’কে দিয়েছিলেন ওঁর ‘কর্ম গুরু’।


তাই এ বার গুরু ও শিষ্য স্বর্গে গিয়ে চুটিয়ে আড্ডা দেবেন। চলবে বিশ্ব ফুটবল নিয়ে দেদার আলোচনা। তবে সেই আড্ডায় আর এক প্রবাদপ্রতিম চুনি গোস্বামী যোগ দেবেন কিনা সেটা কিন্তু জানা যাবে না!


Zee 24 Ghanta App দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App