নারী, আরও সাহসী হও
ফুলকলি
অনেকদিনই মনে হচ্ছিল ফুলকলি কলম হারিয়েছে। দুটো ভল্টই যেন থাপ্পড়ের উড়ে এল যেন! মনে হল, কলমটা গিলে ফেলেছিলাম। নতুন করে খুঁজে পেতেই হবে। বাইশ বছরের এই সাহসিনীর হাসিই যেন দৈববাণী হয়ে এল। মেডেল আসুক বা না আসুক, ইনিই এবার তামাম ভারতবাসীর স্বপ্ন উড়ান। চতুর্দিকে দুর্নীতি, হত্যা, নিধনযজ্ঞের আখড়া এই পোড়া দেশের গলিখুঁজিতে এমন ধিকিধিকি জ্বলছে প্রতিভা, দেখে বিস্ময়ঘোর কাটছে না যেন। আরও আরও দেখি যেন সেই রত্নগর্ভা সাধারণীকে, যিনি দীপা কর্মকারকে উপহার দিলেন। বিশ্ব জানল এই সুপারনোভা, দীপার প্রোদুনোভা-র কথা।
ছ বছর বয়সে আমরা কী করি? নতুন ব্যাগ-বোতল-পেনসিল-শার্পনার নিয়ে প্রথম অজানা গণ্ডিতে যাই, বাবা মায়ের ছায়ার বাইরে গিয়ে রোদ্দুরে পা দিই। সেই বয়স থেকেই সাহসের প্রথম সহজ পাঠ নিয়েছেন দীপা। সরু বিমের ওপর দিয়ে ব্যালেন্স করে হাঁটা। সেই শিশুকে হাঁটতে দেখেই বিশাল বালুকাময় মরুভূমিতে এক বিন্দু সোনার দানার খোঁজ পেয়েছিলেন বিশ্বেশ্বর নন্দী। এক সাধারণ বাঙালি জিমন্যাস্টিক শিক্ষক।
এর মধ্যে সবাই জেনে গেছেন বিষয়টা। তবুও এ কটি তথ্য দেওয়ার মধ্যেও অপার আনন্দ আছে। তা থেকে নিজের কলমকে বঞ্চিত করতে ইচ্ছে করছে না। দীপা কর্মকার জিমন্যাস্টিকস প্রতিযোগিতার সবচেয়ে কঠিন বিভাগ প্রোদুনোভা ভল্ট বিভাগের পাঁচ নারীর মধ্যে চতুর্থ নারী। তাঁর স্কোর ছিল সর্বোচ্চ (১৫.১০০)। এশিয়ান জিমন্যাস্টিকস চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রোঞ্জ পদক জিতেছিলেন তিনি। ২০১৫ ওয়ার্ল্ড আর্টিস্টিক জিমন্যাস্টিকস চ্যাম্পিয়নশিপে পঞ্চম স্থান অর্জন করেন। দেশের জন্য প্রথমবার। এই অলিম্পিকেও দেশের প্রথম নারী হিসেবে দীপা কর্মকার ৫২.৬৯৮ পয়েন্ট নিয়ে প্রথম ভারতীয় নারী জিমন্যাস্ট হিসাবে অলিম্পিক গেমসের জন্য যোগ্যতা অর্জন করেন। ৫২ বছর পরে ভারতের প্রথম জিমন্যাস্টিকস প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জন করল কেউ!
প্রোদুনোভা! শব্দের মধ্যেই এক অপূর্ব অনুরণন। হঠাত্ যেন আকাশগঙ্গায় আবিষ্কার নতুন এক জ্যোতিষ্কের। আমি নিশ্চিত বহু বাঙালি নারী (বাঙালি পদবীযুক্তা মহিলা সাংবাদিকও ইনক্লুডেড) প্রথমবার এই শব্দটি স্বকর্ণে শুনলেন। এমন এক দুঃসাহসিক ভল্টের নাম। দৃষ্টিনন্দন, তবু মৃত্যুমুখ থেকে বার বার ফিরে আসার মতো দুঃসাহসিক। এক চুল ভুলেই সারা জীবনের মতো ভাঙতে পারে মেরুদণ্ড। মাথায় তীব্র আঘাত লেগে স্মৃতি হারানোর নিদর্শনও আছে! তবু আমার আপনার মতো সাধারণ এক পরিবারই তাঁদের মেয়েকে এগিয়ে দিয়েছিলেন। প্রতিবন্ধকতা জয় করে দেশের জন্যে যেন কিছু করে দাঁড়াতে পারায় এ মেয়ে। হয়তো তাঁরা জানতেন না, তবু বিশ্বাস করতেন, একদিন আসবেই। হয়তো সেই স্বপ্ন দেখতেন, সারা বিশ্ব জুড়ে দীপার নামেই উঠবে এক বিস্ময়ের সমুদ্রঝড়।
তবু এ পোড়া দেশে আমরা নারীরা সব্বাই খুব বকবকাই। শিক্ষার অভিমানে বাস্তবটাই ভুলে যাই। কলম আর বুকনি, দুটোই নারীর তূণের তির। যখন ইচ্ছে নিক্ষেপ করলেই হল। যেমন করলেন শোভা দে। কথা বলতে জানলেই এরিয়া ভুলে ক্ষমতা জাহির করার বদভ্যাস। অলিম্পিক তো দূর অস্ত, নিজের পরিধিতেই যিনি কিছু করে দেখাতে পারেননি, তিনি বেমক্কা মন্তব্য করে বসলেন। বহুকাল প্রচারে নেই। সাম্মানিক অনুষ্ঠানেও তেমন ডাকটাক আসে না। পাঠযোগ্য লিটারেচার যে লিখবেন, তেমনও ক্ষমতা নেই। তবু কিছু-না-কিছু করে একবার ধুলোর ঝড় তুললে কেমন হয়? সেটাই করলেন তিনি।
পেশার সূত্রে কত অভিনেত্রীর সঙ্গে মুখোমুখি প্রশ্নোত্তর হয়। যখনই কোনও খোলামেলা দৃশ্যে অভিনয়ের কথা চাউর হয়, তখন একটা চালু প্রশ্ন থাকে, কীভাবে এত সাহসী দৃশ্যে অভিনয় করলেন? প্রশ্নটা বড্ড ক্লিশে বললাম, কারণ নিজেও করে থাকি। অনিচ্ছাসত্ত্বেও। যেন যে-কাজটা দরজার আড়ালে করার কথা, সেটিই জনসমক্ষে করাটাই অদম্য সাহসিকতা। ফুল ফ্রন্টাল নুডিটি মানে তিনি এক্কেবারে ব্রেভারি অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার যোগ্য। প্রতিটি প্রশ্ন যেন ব্যঙ্গ করে ফিরে আসে আমারই কাছে। যেটা নির্লজ্জতা, তাকেই কেন সাহসিকতা বলে ভ্রমে রাখা হবে নারীদের? খুব চাঁছাছোলা ভাষায়, কেন এতদিন প্রশ্নটা করতে পারিনি, নারী আরও সাহসিনী হও। আরও এগোও। ভুল ভেঙে দাও।
অনেকদিন বাদে এক সাহসিনীকে দেখলাম। আর জানলাম, কেমন অকুতোভয় এক উদ্দীপ্ত সুন্দরীকে সকলে একবাক্যে বলছে, সাহসী। ভারতবর্যের সজল মেঘ আর উজ্জ্বল রৌদ্র মিলেছে তাঁর মোহিনী হাসিতে। বদলে দিচ্ছে সাহসিকতার সংজ্ঞা। এখন থেকে শুধু পর্দায় অর্ধনগ্ন নারীকে আর শ্রেষ্ঠ সাহসিনী বলা হবে না। তার সাহস প্রকাশের প্রতিশ্রুতিকে বলা অজস্র মিডিয়া-ম্যাগাজিনে বলা হবে না সাহসী। নারীর অভিধানে সাহস শব্দটা যেন নতুন করে মুছে লেখা হল। একটা গোটা দেশ সসম্মানে, নতমস্তকে মেনে নিল।
সে-ই সাহসিনী, যে মৃত্যুকে ভয় পায় না
সে-ই সাহসিনী, যে প্রতিদিন মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসে!
সেই সাহসিনী, দীপা কর্মকার। যিনি বিশ্বের আলোকবৃত্তে দাঁড়িয়ে সোচ্চারে শেখালেন সাহসিকতার সংজ্ঞা। এবার থেকে, সব মহিলা সাংবাদিকরা যেন সেটাই মেনে চলি!