ওদের সান্তা, আমার সান্তা
পার্থ প্রতিম চন্দ্র
আমার বন্ধু, রাহুল। গবেষণা-চাকরি সূত্রে ও এখন থাকে মার্কিন মুলুকে। ওর সঙ্গে মাঝে মাঝেই কথা হয় গুগল টক-এ। কয়েকদিন আগেই ওর সঙ্গে কথা হল। তারপরেই বুঝলাম ছোটবেলায় বাবা যেটা বলত সেটা ঠিক নয়। সান্তাক্লজ আসলে একজন নন, দু জন মানুষ। একজন থাকেন আমার জগত্ থেকে অনেক দূরে আর একজন থাকেন আমার চারিদিকে, চোখের সামনে। আমেরিকায় রাহুলের বাড়ি ওকলাহামা শহরে। ১৭ ডিসেম্বর, রাহুল লিখল ওদের ওখানে সান্তাক্লজ হওয়ার ট্যালেন্ট হান্ট হচ্ছে। ওই ট্যালেন্ট হান্ট শো-তে যে জিতবে ২৪ তারিখ রাতে সে সান্তা ক্লজ সাজবে। তারপর অনেকের বাড়িতে গিয়ে ছোটদের চমক দিয়ে উপহার দেবে। তার জন্য সান্তাকে অনেক মার্কিন ডলারের পুরস্কারও দেওয়া হবে। সেই পুরস্কার মূল্যে ১ এর পর ঠিক কতগুলো শূন্য আছে গুনতে গুনতে হঠাত্ বস এসে যাওয়ায় সেটা আর জানা সম্ভব হয়নি। রাহুল বলছিল, ওকলাহামায় সেই সান্তা ক্লজ-হওয়ার ট্যালেন্ট হান্টের লাইনে ওর প্রফেসারের ঠিক পিছনে ছিলেন এক নামজাদা ব্যবসায়ী (যার মাসিক আয় নাকি কয়েক লক্ষ মার্কিন ডলার), লাইনের আগে দাঁড়িয়ে ছিলেন হলিউডের এক প্রযোজকও। শেষ অবধি যিনি সেই ট্যালেন্ট হান্টে জিতলেন তিনি হলেন লারি কোচ। এই সান্তা লারি, জর্জ বুশের খুব ভাল বন্ধু। মার্কিন মুলুকে গোটা শয়ের মত ফ্ল্যাট আছে , বিশ্বের পাঁচটা মহাদেশেই নাকি তাঁর বাড়ি আছে, গোটা দশের মত টিভি চ্যানেলের মালিক সে। লরির সঙ্গে আরও পাঁচজন সান্তা সাজার সুযোগ পাচ্ছেন। তাঁরাও নাকি মস্ত বড় লোক।
কী অদ্ভুত, সেদিনই আবার আমার পাড়াতেও একটু অন্য রকমের সান্তা ট্যালেন্ট হান্ট শো ছিল। অনেক ভিড়ও হয়েছিল সেই ট্যালেন্ট হান্ট শোতে যোগ দেওয়ার জন্য। আসলে সেদিন রতন ক্যাটারারে ক্রিসমাস আর ইয়ার এন্ড পার্টির অর্ডারের জন্য সান্তার খোঁজ চলছিল। নিউ আলিপুর, টালিগঞ্জ, বালিগঞ্জ চত্বরে বড় বড় ফ্ল্যাটে ক্রিসমাস পার্টিতে সান্তার চাহিদা খুব। তাই রতন দা ঠিক করেছে আশেপাশের অঞ্চল থেকে সান্তা সাজিয়ে ওইসব পার্টিতে লোক সাপ্লাই দেবে। সান্তা সেজে লোককে আনন্দ দেওয়ার পারিশ্রমিক ৫০ টাকা, সঙ্গে কেক আর রাতের খাবার। তবে পার্টিতে খাওয়ার অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার আগে যদি কোনও সান্তা প্লেটে হাত দেয় তাহলে শাস্তি হিসাবে পারিশ্রমিক থেকে অর্ধেক কেটে নেওয়া হবে। কাজের এখন বড় অভাব, তাই খাওয়ার সহ এক সন্ধ্যায় ৫০ টাকা রোজগারের গন্ধে সেই ট্যালেন্ট হান্ট শোতে হাজির অনেকে। সেই লাইনে দাঁড়িয়ে ম্যাজিশিয়ান বাপি, আমাদের কাজের মাসির বর, রিকশাচালক পিন্টু আর লেকের ওধারের বস্তির অনেক লোক।
ট্যালেন্ট হান্ট শো শেষে রতন দা-র মাথায় হাত। ঠিক যেরকম সান্টা দেখলে ফ্ল্যাটের বাবু আর তাদের ছেলেমেয়েরা একেবারে খুশিতে গদগদ করবে সেইরকমটা মিলল না। প্রায় ১০০ জনের মধ্যে খেকে সিলেক্ট হলেন মাত্র ৭ জন। বাকিরা কেউ আন্ডারওয়েট, কেউ আবার বেশি লোভী বলে বাতিল। যে ৭ জন সিলেক্ট হল তাদের নিয়ে রতন দা-র সমস্যা সমাধান করল বরুন দা। বরুন দা হল টলিউডের বি গ্রেড সিনেমায় এক সময় সহকারী মেকআপ ম্যান হিসাবে কাজ করা একজন। সেই বরুন দাই বলল, ভাবিস না রতন, দিলুর বাবার গায়ের রঙটা আমি পাউডার দিয়ে মেকআপ দিয়ে দেব। আর দিলুর দাদা, রমার বরের পেটটা ঢুকে গেলেও স্পঞ্জ দিয়ে ঠিক মেকআপ করে দেবো দেখিস। আজ অফিসে যাওয়ার পথে দেখলাম আমাদের পাড়ায় সান্তাদের রিহার্সাল চলছে। রিহার্সালের মাঝে দিলুর দাদা লুকিয়ে মুড়ি খাচ্ছে বলে খুব বকা খেলো। সান্তারা নাকি মুড়ি খায় না, তাই ধমক। দিলুর দাদা তখন বলল, তাহলে নিশ্চিই ও চাউমিন খেতো। তাহলে আমায় চাউ দাও। শুনলাম রতন দা বলল, না না সান্তা কিচ্ছু খেতোটেতো না, মোটা বলে ডায়েট করত। তোরাও পার্টিতে কিচ্ছু খাবি না। তোরা খেলে আমার প্রেস্টিজের টায়ার পাংচার হয়ে যাবে একেবারে। শোন পার্টিতে না খেলে ১০ টাকা বোনাস দেবো।
অফিসে পৌঁছে রাহুলের সঙ্গে কথা হল, ওর পাড়ার সান্তারা নাকি কাল রাতে জমিয়ে রিহার্সাল করল। ওই রিহাসার্ল উপলক্ষে দারুণ পার্টি হয়েছে। রাহুল সেখানে এত খেয়েছে যে আজ ওর পেটে প্রবলেম। কালকের সেই পার্টিতে চ্যারিটি ফান্ডে যত টাকা উঠেছে শুনলাম, হিসাব করে দেখলাম ওটা আমার কুড়ি বছরের রোজগারের থেকেও বেশি। রাতে খাওয়ার পর অভ্যাসমত তিনতলার ছাদে এসে দাঁড়ালাম। কালকেই বড়দিন, ক্রিসমাস ডে। হঠাত্ কেমন ঘুম ঘুম পাচ্ছে। উঠতে ইচ্ছে করছে। এই তো এবার পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি দু জন সান্তাকে। রাহুলের পাড়ার সান্তা গাড়ি থেকে নামল, চারিদিকে কী দারুণ আলো। সান্তা রূপী লরি বাচ্চাদের গিফট দিচ্ছে নিজের খুশি মত, গিফটে কি নেই... সান্তার ঝুলি থেকে বেরোচ্ছে পৃথিবীর সেরা সেরা সব উপহার। বাচ্চারা কী খুসি, লরিকেও বেশ খুশি দেখাল.. কি সুন্দর একটা ক্রিসমাস ক্যারোল শুরু হল.. লরির গলাটাও চমত্কার। চারিদিকটা দেখে মনে হচ্ছে স্বর্গে এসে পড়েছি। আর ওই তো ওই যে আমাদের পাড়ার সান্তাক্লজ সাজা দিলুর দাদা।
মুখে ভর্তি পাউডার, কোর্টের মধ্যে কাগজমোড়া ফোলা পেট। দিলুর দাদা খুব হাসছে, তবে জানি খিদে পেলে ঠিক ভুলে করে খেয়ে ফেলবে। ওই তো একটা বাচ্চা এগিয়ে এল। গিফট চাইছে, সান্তা তুমি কি দেবে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দিলুর দাদা...লরি চাপা পরে মারা যাওয়া ওর মেয়ের কথা নির্ঘাত্ মনে পড়ে গেছে ওর.. তাই পকেটে হাত দিয়ে পাগলের মত গিফট খুঁজছে...নেই নেই.. কিচ্ছু নেই.. কিন্তু দিতে তো হবেই, যতই হোক বড়লোকের এই মেয়েটার সঙ্গে ওর মরা মেয়েটার মুখের খুব মিল... পেল না, কিচ্ছু পেল না... লজ্জায় মুখটা ঘুরিয়ে নিল...ঠিক করল পরের বার সে অবশ্যই কিছু আনবে...এই বাড়ি থেকে চুরি করে হলেও সে কিছু আনবে... বুঝতে পারলাম আসলে সান্তা দুজন মানুষ। একটা থাকে ওদের পাড়া আর একটা আমার পাড়ায়... দুটোই আসলে সেই সান্তা.. যার অপেক্ষায় ২৪-এর রাতে এই বয়েসেও রাতে একটু দেরিতে ঘুমোই। তবে এবার বুঝলাম কেন এত বড় হয়ে যাওয়ার পরেও আমি কেন মোজার ভেতর কোনও গিফট পেলাম না। আমার পাড়ার সান্তা আসলে এরমই... পাউডার মেখেও সাদা হয় না... কাগজ ঢুকিয়েও পেট ফোলে না... ইচ্ছা থাকলেও গিফট দিতে পারে না।