জীবন মৃত্যুর সলিল সমাধি
পার্থ প্রতিম চন্দ্র
(সলিল চৌধুরির জন্মদিনে তাঁকে শ্রদ্ধার্ঘ)
অন্ধকার ঘর। পুরনো ক্যাসেট প্লেয়ার থেকে শুধু একটা গানের আওয়াজ ভেসে আসছে। দরজাটা খুলতেই দেখলাম বাবা হাত দিয়ে দু চোখের জল মুচছে। দাদুকে শেষ বিদায় জানিয়ে শ্মশান থেকে সবে ফিরে স্নান সেরে বাবা বসেছেন। ঘড়ির কাঁটা রাত দুটো ছাড়িয়েছে। গোটা বাড়ি নিঝুম। শোকে একেবারে পাথর বাড়িতে ওই গানটাই একমাত্র শব্দ। ক্লাস সেভেনের পরীক্ষায় পাশ করে সবে এইটে উঠেছি। মৃত্যু মানে যে কত বড় শোক সেটা তখন সবে বুঝতে শিখেছি। দাদু আমার জীবনের অনেকটা জায়গা জুড়ে। প্রিয় বন্ধুকে হারানোর শোকে ভেঙে পড়ার পর আমি তখন বেশ ক্লান্ত।
আমার দায়িত্ব ছিল বাবাকে শরবত আর মিষ্টির প্লেটটা দিয়ে আসার। রান্নাঘর থেকে বাবার ঘরের দূরত্বটা আমার অনেক মনে হচ্ছে। পা টা পাথরের মত ভারী লাগছে। বাবার কাছে গিয়ে কী বলব! একজন সবে বাবা হারানো মানুষকে কী বলা যায়? আমার কী বাবার চোখের জল মুছে দেওয়া উচিত? না, না, ওসব করতে গেলে ব্যাপরটা বড় বেশি নাটকীয় হয়ে যাবে। বাবা, নাটকীয় ব্যাপার-স্যাপার একদম পছন্দ করেন না। দরজা খুলেই সোজা চলে গেলাম বাবার চেয়ারের কাছে। অন্ধকার করে মাথা নিচু করে চশমাটা খুলে বাবা হাতে তাল দিচ্ছেন। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর সাহস করেই বললাম, বাবা তোমার মন খারাপ। কথাটা শুনে বাবা যেন কেমন চমকে গেলেন। অন্য সময় হলে হয়তো বকতেন। কিন্তু সেদিন শুধু বলেছিলেন, না রে...মনটা খারাপ ছিল এখন ভাল হয়ে গেল।
আমি বলেছিলাম, 'কেন বাবা! দাদু মারা গিয়েছেন, তুমি শ্মশানে নিজের হাতে মুখে আগুন দিয়ে এলে আর তুমি বললে মনটা ভাল হয়ে গেল!' বাবা বললেন, বড় হও বুঝবে একটা ভাল গান মানুষের মনকে কতটা বদলে দিতে পারে। তারপর ক্যাসেট প্লেয়ারের সাউন্ডটা জোরে করে দিলেন। বললেন, গানের কথাগুলো মন দিয়ে শোনো। জানো তো মানুষের মন যখন ভাল থাকে তখন সে শুধু মিউজিকটা শোনে, আর যখন খারাপ থাকে তখন সে শোনে গানের কথা। আমি শুনলাম, 'kahin door jab din dhal jaye saanjh ki dulhan badan churaaye chupake se aaye...। কিছুটা শুনে বললাম বাবা এই গানটা শুনে তোমার মন ভাল হয়ে গেল কী করে! বাবা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বলেছিলেন, যিনি এই গানটা কম্পোজ করেছেন তিনিও হয়তো জানেন না কত গভীরে এই গান আঘাত করে। বললেন, বড় হয়ে যেদিন এই গান শুনে চোখ দিয়ে জল পড়বে জানবে সেদিন তুমি কোনও হারানোর মাঝেও প্রাপ্তি খুঁজে পাবে।
সেই রাতেই বাবা বলেছিলেন, সলিল চৌধুরির কথা। সলিল চৌধুরির গানের কথা বলতে বলতে বাবা একটা সময় কেঁদে ফেলেছিলেন। বুঝেছিলাম গান, আবেগ, মৃত্যু, শূন্যতা মিলে বাবার কান্না সেদিন অনেক কথা বলে দিয়েছিল। তারপর থেকে সলিল চৌধুরি গানের প্রসঙ্গ এলেই কান খাঁড়া করে শুনতাম। বড় বড় শিল্পী, বিখ্যাত শিল্পী, নামজাদা শিল্পী তো কত আছেন কিন্তু সেই রাতের পর সলিল চৌধুরি নামটা আমার বুকে খোদাই হয়ে আছে। এই মানুষটা জীবনে অনেক করেছেন, অনেক দিয়েছেন, হয়তো অনেক সম্মানও পেয়েছেন। কিন্তু আমার কাছে তিনি মানে আমার বাবার চোখের জল আর সেই মৃত্যুর রাতের গান।
এ বছর অফিসে ঠিক হয়েছে আমাদের ওয়েব পেজে সলিল চৌধুরির জন্মদিনে বিশেষ কিছু করা হবে। এখন খুব ব্যস্ততা। বাবার শরীর খুব খারাপ। কাশিটা খুব বেড়েছে, বুকের ব্যথাটা চরমে উঠেছে। বাবার ওই ঘরটা থেকে কাশির খুব আওয়াজ পেলাম। দরজাটা খুলে ভেঙে যাওয়া ক্যাসেট প্লেয়ারে সেই গানটা শুনতে পেলাম...'kahin door jab din dhal jaye saanjh ki dulhan badan churaaye chupake se aaye...আজ চোখ দিয়ে সত্যি সত্যি জল পড়ল। সেই রাতে বাবার কথাটা মনে পড়ল বড় হয়ে যেদিন এই গান শুনে চোখ দিয়ে জল পড়বে জানবে সেদিন তুমি কোনও হারানোর মাঝেও প্রাপ্তি খুঁজে পাবে। চোখটা ভারী হয়ে আসছে। সলিল চৌধুরিকে নিয়ে বিশেষ কিছুই জানি না। অফিসের স্বরূপ দাদা অনেক কিছু জানে দারুণ লিখতে পারে। আমি আর সলিল সাগরে কিই বা যোগ করতে পারি। সত্যি চোখের জল দেখিয়ে বলতে পারি দেখো ওই গানটা শুনে আমি কাঁদতে পারি। গানের গভীরতা আমায় আঘাত করছে...আমি সলিলে ডুবতে শিখেছি...