আমার নিজের মুদ্রাদোষে

আজ আমাদের যেকোনও আড্ডায় হামেশাই বলি কাউকে না কাউকে, কী রে, কী হল? এত aloof কেন? কোনও প্রবলেম? কথাটা যেহেতু প্রায়ই বলি, তাই এই aloofness নিয়ে আমরা খুব একটা মাথা ঘামাই না, তার প্রবলেম নিয়েও বিশেষ উদ্বিগ্ন হই না। এই aloofness-ই তো একধরনের alienation! যে alienation ব্রেখটের নাটকে পেয়েছি আমরা অসাধারণভাবে।

Updated By: Sep 2, 2012, 06:24 PM IST

আজ আমাদের যেকোনও আড্ডায় হামেশাই বলি কাউকে না কাউকে, কী রে, কী হল? এত aloof কেন? কোনও প্রবলেম? কথাটা যেহেতু প্রায়ই বলি, তাই এই aloofness নিয়ে আমরা খুব একটা মাথা ঘামাই না, তার প্রবলেম নিয়েও বিশেষ উদ্বিগ্ন হই না। এই aloofness-ই তো একধরনের alienation! যে alienation ব্রেখটের নাটকে পেয়েছি আমরা অসাধারণভাবে। তবে ব্রেখটের সেই চরিত্র একটা সময়ের পর আবার ফিরে আসতে পারে তার স্বাভাবিকতায়, কিন্তু জীবনানন্দে দেখি পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া।  'সকল লোকের মাঝে বসে/ আমার নিজের মুদ্রাদোষে/ আমি একা হতেছি আলাদা?' কেন আলাদা? নিজের 'মুদ্রাদোষে'! অন্য কোনও কারণ নেই! আরও বিস্ময় নিয়ে দেখি ' সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে!/ কে থামিতে পারে আর আলোয় আঁধারে/ সহজ লোকের মতো!...সকল লোকের মতো বীজ বুনে আর স্বাদ কই!' এইখানে এসে বুঝতে পারি, আমারা আসলে 'সহজ' লোক! সহজ মানে? যারা আর পাঁচজনের মতো মনের মধ্যে বীজ বপন করে। স্বপ্নের বীজ, প্রত্যাশার বীজ, সুখে-শান্তিতে কাটানোর বীজ! এই 'সহজ' লোকটাই আর তখন 'সহজ' থাকছে না। তখন তবে কে সে? এই অমোঘ প্রশ্নটা যদি একবার কানে বাজে তাহলেই সেই মুদ্রোদোষ, তাহলেই ' স্বপ্ন নয়-শান্তি নয়-ভালোবাসা নয়,/ হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়/ আমি তারে পারি না এ়ড়াতে।' অথচ এমন নয় যে এই মু্দ্রাদোষ নিয়ে আমরা থাকতে চাই! চাই না। এই মুদ্রাদোষ আমরা দূর করতে চাই। তাই বারবার ' উপেক্ষা করিতে চাই তারে, / মড়ার খুলির মতো আছাড় মারিতে চাই তারে,/ তবু সে মাথার চারিপাশে/ তবু সে বুকের চারিপাশে।' তখন আমরা মুদ্রাদোষটা টের পাই। কেননা মাথার চারপাশে থাকলে তাকে এড়ানো যায়, কিন্তু বুকের চারপাশে থাকলে তাকে কীভাবে এড়াবো! তখনই ওই 'সহজ'লোকটাই মহাকাণ্ড ঘটিয়ে ফেলে। ' কাল রাতে-ফাল্গুনের রাতের আঁধারে যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ/ মরিবার হল তার সাধ।
 
'মরিবার হল তার সাধ' -এইখানে তার একাকীত্বের সম্পূর্ণতা। যেখানে সে আবিষ্কার করে যে, সে সহজ নয়।  সহজের বিপরীত শব্দ কঠিন। কী কঠিন হয়ে যাচ্ছে তার কাছে? নিজের জীবন। আমরা রোজই এইভাবে বিচ্ছিন্ন হই কেউ কেউ। বিচ্ছিন্নতাটা হয়তো সাময়িক, তাই ফিরে আসি আবার সেই কক্ষপথে।
 
বিচ্ছিন্নতা। এই বিচ্ছিন্নতার মধ্যে কোনও বিদ্বেষ নেই, কোনও আঘাত নেই, কোনও অপমান নেই। আছে আড়াল। আছে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা! এই সমাজজীবন থেকে দূরে, প্রিয়জনের থেকে দূরে। কেননা, প্রয়োজনের এই জীবনে তার প্রয়োজনাতিরিক্ত প্রেম! আমরা, মানে তার পারিপার্শ্বিক শুধু দেখল বধূ, শিশু নিয়ে থাকা এক 'অপূর্ব' দম্পতিকে। দেখলাম তার অর্থ, কীর্তি, স্বচ্ছলতা- আমরা খেয়াল করিনি তার 'বিপন্ন বিস্ময়', যা তার অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে! তার মনে হয়, এই 'সমাচার' যদি বুড়ি পেঁচা জানে, তাহলে মানুষ কেন বোঝে না - এ এক অনন্ত বিস্ময়। এই অনন্ত বিস্ময় থেকেই তার এক 'বোধ' জাগে। কেননা এই জীবনে কোনও হতাশার গ্লানি নেই, অপ্রাপ্তির বেদনা নেই। 'কোনও নারীর প্রণয়ে ব্যর্থ হয় নাই,/ বিবাহিত জীবনের স্বাধ/ কোথাও রাখেনি কোনও খাদ/ সময়ের উর্ধতনে উঠে এসে বধূ/ মধু-আর মননের মধু/ দিয়েছে জানিতে,/ হাড় হাভাতের গ্লানি বেদনার শীতে/ এ জীবন কোনোদিন কেঁপে ওঠে নাই।' তা সত্বেও সে ক্লান্ত। তাই বলে, লাসকাটা ঘরে/ সেই ক্লান্তি নাই।

এক প্রবল বিপন্নতা বোধ থেকেই আসে বিচ্ছিন্নতা।  তখনই 'অ-সহজ' লোকটি মিলতে পারে না 'সহজ' লোকেদের সঙ্গে। তাই 'সব দেবতারে ছেড়ে প্রাণের কাছে চলে আসি,/ বলি আমি এই হৃদয়েরে/ সে কেন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!' সবই ওই মুদ্রাদোষে। 

সোমশুভ্র মুখার্জি

Tags:
.