‘আব্বু(পু)লিস’ : একটি কাল্পনিক বিকল্প
হ্যাঁ, এই মুহূর্তে ব্যাপারটা কাল্পনিকই। তবে বিকল্পও বটে। এই ব্লগ, পুলিস বাহিনীকে সরাসরি ও সামগ্রিকভাবে বিচার বিভাগের অন্তর্ভুক্ত করার বিকল্পের কথা বলছে। বিষয়টা একবার ভেবে দেখা দরকার।
রাখে পুলিস মারে কে?
গণতন্ত্রের বিভিন্ন স্তম্ভের (প্রশাসন, আইন প্রণয়ন, বিচার বিভাগ ইত্যাদি) প্রকৃতি ও ভূমিকা নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বইতে বা তাত্ত্বিক আসরে আলোচনা চলতেই পারে। কিন্তু, বাংলা বাজারে (ভারতীয় বাজারেও) মাঠে, ঘাটে, কারখানার গেটে, হসপিটালে, অফিসে, কলেজে মায় সর্বত্রই পুলিসই হল ক্ষমতার ATM। জ্যান্ত, মোবাইল সরকার। প্রশাসন তো সে নিজেই, আর তার সাথে আইন ও বিচার বিভাগের নির্যাস দিয়ে তৈরী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের হাই রেজোলিউশন প্রোফাইল পিকচার। পাড়ার মোরের বাওয়াল কিংবা ছাত্র ঠ্যাঙানো অথবা শিক্ষকদের ‘শিক্ষাদান’, আর খুন ধর্ষণ হলে তো কথাই নেই পুলিস ছুটল ফার্স্ট এইড দিতে। খুব স্বাভাবিক, ছুটতে তো হবেই, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করাই তার কাজ। কিন্তু পুলিসের এই এইড বা স্নেহ বা সমীহ পাবে কে? অবশ্যই যে বা যারা শাসকদলের লোক। আর কেস খাবে বিরোধী –এ তো সবারই জানা। এই এইড বা স্নেহ বা সমীহের মহীমায় কেষ্টরা আজ বিষ্টু হয়েছেন আর মাস্টারি খুইয়ে মজিদরা এখন অসহায়। এই সার সত্যটি পাড়ার ক্যাবলা ভোলা থেকে আলিমুদ্দিন-কালিঘাট হয়ে জনপথ-অশোক রোড-নাগপুর সবারই জানা। আর তাই আজকাল ইতিউতি যেসব বীরবদনগুলো (ছোটো ছোটো ছেলেদের) রোজই চ্যানেলের রেড সার্কেলে দেখি তাদের কয়েকদিন, থুড়ি কয়েক বছর আগেও দেখিনি কখনও, লাল বৃত্তে তখন আনাগোনা করত অন্য নামাবলী। সেইসব পুরানো নামগুলো এখন বুঝে গেছে-জামানা বদল গ্যয়া-ঝামেলা পাকালে পুলিস এখন হেব্বি মারবে আর হেব্বিত্তর কেস দেবে, অতএব, জিইয়ে থাকতে মিইয়ে গেছে।
অন্যদিকে, তেনারা মানে অফ্ দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল সরকারের কুশিলবদের কাছেও দপ্তর হিসাবে স্বরাষ্ট্রের হেব্বি ডিমান্ড। তাই কেন্দ্রে এন.ডি.এ সরকার গড়তে গেলে আর.এস.এস তার ঘরের ছেলে রাজনাথ সিংহের (পড়ুন, সংঘী) জন্য স্বরাষ্ট্রটা ‘কনফার্ম’ করে। তার আগে ইউ.পি.এ-তেও কংগ্রেসের হাতেই ছিল হোম। ব্র্যান্ড বুদ্ধের দশ বছরেও তাই। পিসি সরকারের আমলেও গল্পটা একই রয়েছে। এবং সেটাই স্বাভাবিক। কারণ, পুলিস (জোর) যার, মুলুক তার।
পুলিস তুমি মারলে এত...
পুলিসকে নিয়ে তৈরী স্লোগান বড্ড একঘেঁয়ে। সেই কৈশোর থেকেই শুনছি-“পুলিস তুমি যতই মারো...”-খুব পানসে এই স্লোগানটা। অন্তমিল ছাড়া আর কিছুই পাই না। বরং কিছুদিন আগে যাদবপুরের এক দেওয়ালে পড়লাম, “পুলিস তুমি মারলে এত/মাইনে তোমার বাড়ল কত?”- এটা বেশ লেগেছে। এর মধ্যে একটা জুতসই খোঁচা আছে। আসল কাথা হল, শাসকের হয়ে তার বিরোধীকে ‘শিক্ষা’ দিলে বা নাগালের বাইরে থাকা পুরসভা শাসকের তালুবন্দী করে দিলে শাসক খুশি হন-আর, শাসক খুশি তো বস্ খুশি-ব্যাস সফল তবে এ বশ্যতা স্বীকার।
প্রায় রোজই পুলিস কোথাও না কোথাও চরম ‘পেশাদারিত্বের’ পরিচয় দিয়ে ল্যাজে গোবরে হচ্ছে আর ওমনি প্রাক্তন পুলিসকর্তা থেকে নেতারা চ্যানেলের দেশলাইবাক্স মাপের ফ্রেমে বসে নিন্দার হুদহুদ তুলছেন, নৈতিক স্খলনের কথা বলছেন। আর এইসব দেখে সব গুলিয়ে যাচ্ছে, কারণ, পুলিস কি এই ‘গোলার’ বাইরে থেকে আসা কোন ‘পিকে’? একেবারেই না। গোটা সমাজটাই যদি মূল্যবোধের ক্রমবর্ধমান ক্ষয়িষ্ণুতা নিয়ে ‘এগিয়ে’ চলে তবে পুলিস হঠাৎ ‘পিছু হটতে’ যাবে কেন? মানছি, আদর্শবোধ খুব জরুরী। নৈতিক রচিত্রও সুদৃঢ় হওয়া উচিত। কিন্তু, ‘উচিত’ শব্দটাতো বাস্তবে ‘বাস্তব’ শব্দের বিপরীতার্থক। আর তাছাড়া নিন্দে মন্দ করে, নৈতিকতার পাঠ দিয়ে তো কোনও কাজই হচ্ছে না। তাই বিকল্প ভাবা দরকার।
কেন এই বিকল্প?
এই কেন-র উত্তর দু’ভাবে দেওয়া দরকার। প্রথমত, পুলিস কে? পুলিস হল আইন রক্ষক। অর্থাৎ, কেউ আইন ভেঙেছে বলে মনে করলে, পুলিস ঘটনার তদন্ত করবে ও অভিযুক্তকে গ্রেফতার করবে ও চার্জশিট সহযোগে ধৃতকে আদালতে পেশ করবে। মানে, গোটা বিচার প্রক্রিয়ার শুরুর শুরুটা পুলিসের হাতে। এবং পুলিসের করা তদন্তের (যা বহুক্ষেত্রেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত) উপর আগাগোড়া নির্ভরশীল। তাই খুব সঙ্গত কারণেই পুলিস বাহিনীর বিচার বিভাগের অঙ্গ হওয়া আবশ্যিক।
আরেক দিক থেকে দেখলে, গণতন্ত্রের প্রথম তিনটি পিলারের মাধ্যে কার্যকারিতার নিরিখে বিচার বিভাগই অপেক্ষাকৃত আস্থাযোগ্য। এবং পক্ষপাতমুক্ত। প্রশাসনের অঙ্গ হিসাবে এতকাল তো পুলিস থাকল। আর এই প্রশাসনের স্টিয়ারিং সবসময়ই সরকার তথা নেতা তথা দলের হাতে। ফলে পুলিশের যা হওয়ার তাই হল। দেশ কালের গণ্ডি পেরিয়ে তাঁবেদারি তার জেনেটিক ডিসিসে পরিণত হল। আর এই রোগের একমাত্র ওষুধ পুলিসকে এমন একটা স্তম্ভের সঙ্গে যুক্ত করা যাকে ভোটে জিততে হয় না, দাপট কায়েম রাখতে হয় না দখলদারির মাধ্যমে। আমাদের গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে থেকে সেই বিকল্প একমাত্র বিচার বিভাগই হতে পারে। মানছি, বিচার বিভাগও নিখুঁত নয়, তবুও বলব- কানার মধ্যে ঝাপসা ওই বিচার বিভাগই। তাই তার হাতেই দেওয়া হোক পুলিশের রাশ। আর হ্যাঁ, ক্ষমতাই পচন ধরায়--এই অমোঘ বাণীতে তো আর পচন ধরবে না। তাই, কোর্টের অধীনস্থ পুলিসের ওপর নজরদারি করুক শাসক ও বিরোধীরা (পাছে বিচার বিভাগের গায়েও কালি লাগে)। আমি নিশ্চিত শাসক ও বিরোধীর জোটবদ্ধ জবরদস্ত নজরদারি নজিরবিহীন হবেই। আর যেসব ঘর পোড়ারা এই বিকল্প পড়তে পড়তে ‘ব্যুরোক্রেসির’ সিঁদুরে মেঘ দেখছেন তাদের বলি খুব ভয়ের কিছু নেই কারণ প্রবল প্রতাপশালী ভারতীয় সংসদের হাতে তো ‘ইমপিচমেন্ট’-এর ব্রহ্মাস্ত্র রইলই। তাই খোলা মনে একবার ভেবে দেখা দরকার...
যদি, এই বিকল্পটি নেহাতই কাল্পনিক ঠেকে, তহলে সুমনের শরণ নিয়ে বলব-
"যদি ভাব চাইছি নেহাত, চাইছি নেহাত স্বর্গরাজ্য
আমি চাই একদিন হবে, একদিন হবে এটাই গ্রাহ্য"