বিশ্বজোড়া বাঙালি।
কথাটার মধ্যে বাস্তবতা যেমন আছে, বিস্তৃতিও আছে তেমনটাই।
কথাটার মধ্যে বাস্তবতা যেমন আছে, বিস্তৃতিও আছে তেমনটাই।। এই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছেন এমন কিছু মানুষ, যাঁদের
মাতৃভাষা বাংলা, খাদ্যাভ্যাসে বেশ মিল, আচারে, সংস্কারেও। বিষয়টা রোমাঞ্চকর বলে প্রতিভাত হতে পারে। এই যে আমরা ক্রমাগত ছড়িয়ে দিচ্ছি নিজেদের, গণ্ডিটাকে বাড়িয়ে চলেছি, নিজেকে মিশিয়ে নিচ্ছি অন্যের প্রবাহের সঙ্গে, এই ব্যাপারটার মধ্যে দিয়ে একটা বিশ্বনাগরিকতার বোধের স্পর্শ আছে। ঈষত্ আত্মগৌরবের অবকাশের সম্ভাবনাও। এইভাবে ছড়িয়ে যাওয়া, ছাডি়য়ে যাওয়াটাই তো আমাদের বিশ্বনাগরিক করে তোলে। তাই না?
প্রশ্নটা তো এখানেই। ছড়িয়ে তো যাচ্ছি, ছাড়িয়ে কি যেতে পারছি নিজেকে? রামমোহন-বিদ্যাসাগরদের উত্তরসূরি বাঙালি কি আদৌ বিশ্বনাগরিক? বিশ্বনাগরিক কথাটার কোন অর্থে বিষয়টাকে বুঝবার চেষ্টা করব আমরা? এইভাবে যদি ভাবার চেষ্টা করি, বিশেষত এই বিশ্বায়িত দুনিয়ায় কে কোথায় ছডি়য়ে রইলাম, কে কীভাবে স্ব স্ব দুনিয়ার কিছু আদব এবং কিছু আচার গ্রহণ করলাম, তার উপর কিছু নির্ভর করে না। নির্ভর করে মনন-চিন্তা-চেতনা-মানসিকতার উপর। আমরা দুই বাঙালিকেই চিনি। এক বাঙালি গণ্ডি ভেঙে বোরোন, বিলেতযাত্রা করেন, সতীদাহ প্রথা নিবারণে আন্দোলন শুরু করেন। আর এক বাঙালি গণ্ডিটাকে মজবুত করার চেষ্টা করে, কুসংস্কারের ভিতটাকে প্রথার দোহাইয়ে সুপ্রোথিত করার চেষ্টা করেন। এক বাঙালি বিলেত না গিয়েও, পণ্ডিতের আভরণকে নিয়েই বিধবাবিবাহের লক্ষ্যে উদ্যোগী হন, আর এক বাঙালি তাঁর মুণ্ডুপাতের মধ্যে দিয়ে বাঙালিয়ানায় তা দেন।
উনবিংশ শতক জুড়ে এই টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়েই বিশ্বনাগরিকতার বীজ পুঁতছিল বাঙালি। সেই বিশ্বজনীনতা চিন্তার উদার আকাশে। এবং সেই সময়েই
এই আকাশকে বেশ বেঁধেছেদে অচলায়তন টিকিয়ে রাখার সঙ্ঘবদ্ধ প্রয়াসও করেছে এই বাঙালিই। সময় এগোনোর পরেও প্রশ্নটা এখানেই। অনেকটা এগিয়েছি আমরা, কুয়ো থেকে সমুদ্রে পাড়ি দিয়েছি হয়ত অনেক
আগেই। কিন্তু ফাঁক থেকে যাচ্ছে না তো কোথাও? কথাটা ওঠে এই কারণেই। মনীষীদের বন্দনায় যতটা বিমোহিত আমরা, তাঁদের দেখানো রাস্তাটা ধরে এগোতে ততটা কি প্রস্তুত হয়েছি? বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বাঙালি, আমরা কি আত্মপরিচয় সন্ধানে ব্যগ্র হয়েছি, নাকি কেউ কেউ ব্যস্ত হয়েছি সেই পরিচয় খণ্ডনেই? বিশ্বপরিচয়ের এই বই ওল্টানোর আগে আত্মপরিচয়ের পৃষ্ঠাগুলোও তৈরি করে নেওয়া উচিত। নিউ জার্সিতে একজন আমাকে বলেছিলেন, মাঝেমধ্যে তাঁর নিজেকে বা নিজেদের ভাসতে থাকা শৈবালদাম বলে মনে হয়। সে দেশেও মিশে যেতে পারলেন না, অন্য দিকে নিজের শিকড় কখন ছিন্ন হয়ে গিয়েছে, পারলেন না সেটা বুঝতেও। তাঁর ব্যক্তিগত ভাবনা ছিল এটা। তবু বলি, এই ভাবনার মধ্যেই হয়ত কোথাও একটা সূত্র থেকে যাচ্ছে। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা আমরা যদি হাতে হাত বেঁধে থাকি, যদি শিকড়টাকে শক্ত করে ডালপালাগুলো ছড়িয়ে দিতে পারি বিশ্বের আকাশে, যদি একে অন্যের পাশে থাকি সুখে-উদ্বেগে-ভাবনায়-চেতনায়, তাহলে কিন্তু এই নতুন বাঙালি এক অন্য শক্তি হিসেবে দেখা দেবে।
সেই কাজটা কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। সেই লক্ষ্যেই শুরু হোক নতুন প্রয়াস। বিভিন্ন স্তরে, বিভিন্ন ভাবেই হোক। একটা প্রয়াস যেমন শুরু হল আজ। 24ghanta.com। আসুন হাতে হাত বেঁধে এগিয়ে যাই।