'শোনও ডাকে ওই একাদশ শহীদেরা ভাই....'
অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী
''আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো ২১-এ ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলতে পারি!''
অমর ২১-এর এই গান ৬৫ বছর পর আজও সমানভাবেই প্রাসঙ্গিক। কারণ বিশ্বেজুড়ে এমন নির্দশন তো দেখা যায় না। নিজের মাতৃভাষার স্বীকৃতির জন্য তরুণ বয়সে কেউ 'শহীদের মৃত্যু' বরণ করেছে, সেই ছবিও ইতিহাসের পাতায় মেলা ভার। তাই শুধুমাত্র বাংলাদেশেই নয়, ভারতের মাটিতেও ২১-এ ফেব্রুয়ারি ভাষাদিবসের অনুষ্ঠানে, আজও চোখের জলে স্মরণ করা হয় ভাষা শহীদদের।
বর্তমানে টেকবিশ্বে একটু নাড়াচাড়া করলেই আপনি পেয়ে যাবেন ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সেই ইতিহাস। রয়েছে এই বিষয়ে একাধিক বই। আধুনিক ইতিহাসের পাতাতেও মেলে ৫২-র ভাষা শহীদের ইতিবৃত্ত। ঢাকায় তৈরি হয়েছে শহীদ মিনার যেখানে প্রতি বছর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি সহ হাজার হাজার মানুষ ভাষা শহীদদের সম্মান জানাতে উপস্থিত হন। চোখের জলে 'অমর শহীদের' স্মরণ করেন।
কিন্তু, জানেন কি ইতিহাসের এই পাতার বাইরেও, আমাদের দেশের মাটিতে আরও একটি 'ভাষা দিবস' রয়েছে। সেই দিনটিতেও কিন্তু 'বাংলা'কেই সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিতে শহীদ হয়েছিল ১১টি তরুণ তরতাজা প্রাণ । তাঁদের সেই বলিদান, সেই আন্দোলন অবশেষে সরকারকে বাধ্য করেছিল বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষার স্বীকৃতি দিতে। কিন্তু অদ্ভুত বিষয়, প্রতি বছর কার্যত সবার অলক্ষ্যে, সকলের অজান্তে সেই 'ভাষা দিবস' দিনটি বয়ে যায়...
কোথায় হয়েছিল সেই ভাষা আন্দোলন?
১৯৬০ সালে অসমের প্রতিটি অঞ্চলে অসমিয়া ভাষাকে একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সেই সময় রাজ্যের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বাঙালি বসবাস করতেন। ফলে, অসম সরকারের এই একরোখা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নেমে আসে বজ্রনিনাদ বিরোধ। বাংলাকেও সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে অসমে। প্রতিবাদের সূত্রপাত ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায়। শিলচর, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি সহ বরাক উপত্যকার একাধিক এলাকায় এই দাবিতে একের পর এক আন্দোলন সংগঠিত হতে শুরু করে। সেই আন্দোলনের ঢেউকে প্রতিহত করতে পাল্টা চাপ দিতে শুরু করে তত্কালীন রাজ্য সরকার। তথ্যে মেলে সেই সময় প্রায় ৫০ হাজার বাঙালি অসম ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন। আরও ৯০ হাজার মানুষ, যারা রাজ্য ছাড়তে চাননি তাঁরা বরাক উপত্যকায় গিয়ে পাকাপাকি ভাবে বসবাস শুরু করেন। অসম সরকার কিছুটা হলেও নিশ্চিন্ত হয়, এবার বোধহয় এই আন্দোলনে ভাঁটা পড়ল।
কিন্তু, তাদের ধারণা ছিল ভুল। বছর ঘুরতেই ১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি শিলচরে গঠিল হল 'কাছার গণ সংগ্রাম পরিষদ'। নীলকান্ত দাস, রথীন্দ্রনাথ সেন, বিভুতিভূষণ চৌধুরীর নেতৃত্বে শিলচর, হাইলাকান্দি, করিমগঞ্জের মতো এলাকায় শুরু হল বাংলাভাষার সরকারি স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলন। সেই বছরই ১৪ এপ্রিল পালন করা হল সংকল্প দিবস হিসেবে। ২৪ এপ্রিল থেকে এই দাবিতে বরাক উপত্যকার সর্বত্র শুরু হল ১৫ দিন ব্যপী পদযাত্রা। উদ্দেশ্য ছিল ওই এলাকার মানুষকে সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে একত্রিত করা। আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা রথীন্দ্রনাথ সেন ঘোষণা করে দেন ১৩-ই মে'র মধ্যে বাংলা ভাষাকে অসমের সরকারি ভাষার স্বীকৃতি না দেওয়া হলে ১৯ মে হরতাল পালন করা হবে বরাক উপত্যকায়।
কিন্তু আন্দোলনকারীদের কোনও হুমকি, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ কিছুতেই কাজ হয় না । ১৮-ই মে পর্যন্ত বাংলাকে অসমের সরকারি ভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হল না। অতএব, ১৯ মে সকাল থেকে পূর্ব-পরিকল্পনা অনুসারে শুরু হল হরতাল। শিলচর রেল স্টেশন, হাইলাকান্দি, করিমগঞ্জ সহ একাধিক এলাকায় সকাল থেকেই হরতালের সমর্থনে শুরু হয় পিকেটিং। তাঁদের আন্দোলনের জেরে বন্ধ হয় যায় রেল চলাচল। এদিকে, অশান্তির আঁচ করে আগে থেকেই অসম সরকারের পক্ষ থেকে বরাক উপত্যকাজুড়ে মোতায়েন করা হয় আধাসেনা। হরতালকে বানচাল করতে ও আন্দোলনকে প্রতিহত করতে জায়গায় জায়গায় গ্রেফতার করা হয় আন্দোলনকারীদের। তবুও চলে বিক্ষোভ। এক-একটি গ্রেফতারির খবরে জ্বলে উঠতে থাকে আগুন।
ঘরিতে সময় তখন দুপুর আড়াইটে। একটি বেডফোর্ড গাড়িতে কাটিগোড়া থেকে কিছু সত্যাগ্রহীকে পুলিস গ্রেফতার করে নিয়ে যাচ্ছিল। শিলচরের তারাপুর রেল স্টেশনের কাছে পৌঁছতেই আন্দোলনকারীদের একটি দল গিয়ে তাদের ওপর হামলা করে বসে। গাড়ি থেকে পালিয়ে যান পুলিসকর্মীরা। আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় গাড়িটিতে। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে প্রথমে লাঠিচার্জ করে আধাসেনা। তারপর হঠাত্ই গুলির শব্দ! একটি বা দুটি নয়, পর পর ১৭ রাউন্ড গুলি চালানো হয় বিক্ষোভকারীদের ওপর। মুহূর্তের মধ্যে স্টেশন চত্বরে লুটিয়ে পড়েন ১৫ জন আন্দোলনকারী। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় ৯ জনের। পরের দিন আরও দু'জনের মৃত্যু হয় হাসপাতালে। সেদিনের সেই শহীদদের মধ্যে ছিলেন ১৬ বছরের কিশোরী। ইতিহাস যাকে চেনে কমলা ভট্টাচার্য নামে। বিশ্বের একমাত্র নারী চরিত্র, যিনি মাতৃভাষার স্বীকৃতির দাবিতে শহীদ হয়েছিলেন। শক্তিপদ ব্রহ্মচারীর ভাষায় সেদিনের সেই হত্যাকাণ্ডে যারা শহীদ হয়েছেন তাঁরা আর কেউ নন বরং, '১০ ভাই চম্পা, আর একটি পারুল বোন!'
তাদের সেই আন্দোলন বেকার যায়নি। পরবর্তী সময় বাংলাকে অসমের সরকারি ভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বর্তমানে বরাক উপত্যকার সরকারি ভাষা বাংলাই।
আজ সেই ঐতিহাসিক দিন। ১৯-মে! আজ থেকে ৫৬ বছর আগে এই দিনেই তো ভাষার দাবিতে প্রাণ দিয়েছিলেন সেই ১১ জন শহীদ। আমরা প্রতি বছর বাংলা ভাষা তথা মাতৃভাষা চেতনার জন্য পালন করি ২১ ফেব্রুয়ারিকে। গান, কবিতা থেকে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যে কার্যত উত্সবের চেহারা নেয় সেই দিনটি। কিন্তু, ১৯-মে'র দিনটি আমরা কজন মনে রেখেছি বলুন তো? 'ঘটা করে' কতজন মানুষ এই ১১ জন শহীদকে স্মরণ করে চোখের জল ফেলি? কজনই বা বিশ্ব ইতিহাসের একমাত্র মহিলা ভাষা শহীদকে মনে রেখেছি?
সময় বদলেছে। সরকার পরিবর্তন হয়েছে। শিলচরে সেই ভাষা শহীদদের স্মরণে তৈরি করা হয়েছে একটি শহীদ বেদী। সেই রেলস্টেশনের নামকরণ করা হয়েছে 'ভাষা শহীদ স্টেশন'। প্রতি বছর মাত্র গুটিকতক মানুষ ১৯ মে সেখানে গিয়ে শ্রদ্ধা জানান ৬১-র শহীদের। কিন্তু, তাতেই কি সব পাওয়া হল?
২১ ফেব্রুয়ারি যদি আমরা গাই, ''আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো ২১-এ ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলতে পারি!'' তাহলে ১৯ মে কেনও গাওয়া হবে না, ''শোনও ডাকে ওই একাদশ শহীদেরা ভাই, আর দেরি নয় দেরি নয় দেরি নয়....''