ভূতুড়ে ভোটার
ভূত দিবস স্পেশাল
পার্থ প্রতিম চন্দ্র
অন্য দিনে হলে কালুর ভয় করত। কিন্তু এখন করছে না। ভোটের লাইনে কালু দাঁড়িয়ে আছে সবার শেষে। শীতকালে ভোট, বেলাটা খুব তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়। এদিকে ভোটটা শুরু করতে অনেকটা দেরি হয়ে গেছিল বলে ঠিক হয়েছে সন্ধ্যা ৭টা অবধি ভোট নেওয়া হবে। কৈয়ড় গ্রামে সন্ধে ৭টা মানে ঘুটঘুটে রাত। কালু জানে এই সময়টাই ভূতুড়ে ভোটারদের একেবারে হানিমুন টাইম। সারাদিন ধরে গ্রামের পদিপিসি, খেঁদির মা, জুয়া জোলুরা ভোট দিয়ে দিয়েছে। এবার যারা ভোটটা দিতে আসেনি, তাদের জায়গায় ঝুপঝাপ ভোট পড়বে। কালু এমন কাজ অনেকবার করে বলে জানে এই সময়টা ভোট করাতে আসা লোকগুলো ক্লান্ত হয়ে পড়ে বলে সেভাবে কোনও চেকটেক করে না। কালু এটাও জানে এখন ভুতূড়ে ভোটারদের রেটটা আগের চেয়ে কিছুটা ভাল হয়েছে। কালু যখন সেরা সময়ে তখন পাঁচটা ফলস ভোট দিলে মিলত এক বোতল বাঙলা। তার চেয়ে কম দিলে কিচ্ছু ছিল না। এখন সেখানে রেটটা বেড়ে হয়েছে প্রতি ভুয়ো ভোট পিছু তিরিশ টাকা। সে যাই হোক। এখন আর এসব ভেবে লাভ কী! সে ভুতূড়ে ভোটার ঠিকই কিন্তু সে ঠিক ভোট দেওয়ার উদ্দেশ্যে লাইনে দাঁড়ায়নি। এদিকে লাইনের সব লোক শেষ। ভোটবাবুরা এবার বাক্স প্যাটরা গুঁটিয়ে শহরে ফিরবেন। কালু একটু তাল ঠুকছে কাজটা এবার সারতে হবে বলে ।
কালু একেবারে সোজা চলে গেল বুথের ভিতর। কেউ তাকে দেখতে পেল না। দেখতে পাওয়ার কথাও নয়। একে অন্ধকার, তার ওপর ও অদৃশ্য হতে জানে। কারেন্ট অফ। বুথের ভিতর লণ্ঠন জ্বলছে। দুটো পুলিস স্টেশনের ধারে চা খেতে গেছেন। ভোট পর্ব মিটেছে বলে গাঁয়ের নেতারাও সব ফিরেছেন। আসলে যা করার সব করা হয়ে গেছে। এখন আর এই ঠান্ডাবেলায় কোনও লাভ নেই বলে নেতারা সব কেটে পড়েছেন। কালু বলল, ছ্যার ছ্যার একটা কথা আছে। ভয় পেয়ে গেলেন ভোটবাবু। আরে কোথা থেকে একটা আওয়াজ হল না। ভোটবাবুর বাড়ি কলকাতায়। এমন অজপাড়া গাঁয়ে তাঁর গা-টা আসার পর থেকেই ছমছম করছে। ভোটবাবু বলল, কে কে...কালু বলল, ছ্যার আমি, এ গাঁয়ে থাকতাম। থাকতাম মানে! তুমি তাহলে এখন কোথায় থাকো? তোমায় দেখা যাচ্ছে না কেন? সে ছ্যার অনেক কথা। আমি থাকি এ গাঁয়ের শ্মশানের ওপর তালগাছে। ভোটবাবু বললেন, মানে, ইয়ার্কি হচ্ছে! আমি ভয় পাই না। ভেবো না মেশিনপত্র ফেলে আমি পালাবো আর তুমি সব ভোট লুঠে নেবে।
না ছ্যার, আমার তেমন কোনও ইচ্ছা নেই। ভূতুড়ে ভোটার হতে গিয়েই আমার আজ এই অবস্থা।
আচ্ছা, সব শুনব আগে তুমি বেরিয়ে এসো। আমি তোমায় দেখতে চাই।
ছ্যার আমায় দেখা যায় না। আমি ভূত তো। ভয় পাবেন না ছ্যার। আমি আপনাকে একটা কথা বলতে এয়েছি।
বববলললল..
একি ছ্যার আপনি ভয় পাচ্ছেন কেন! আমি আপনার কোনও ক্ষতি করব না। একটা কথা বলেই চলে যাবো
বললবলল...
ছ্যার, চার বছর আগে আমি এইরকমই একটা ভোটের সময় ঝামেলায় পুলিসের গুলিতে মারা যাই। ওরা আমায় ছাপ্পা-না ধাপ্পা কী ভোট বলে আমায় সেটা দিতে বলেছিল। আমার কাজ ছিল গাঁয়ের যারা ভোট দিতে আসবে না। আমি ভুতূড়ে ভোটার সেজে সেই ভোটগুলো লাইনে দাঁড়িয়ে দিয়ে যাব। গুণেগুণে সাতটা ধাপ্পা ভোট দেওয়ার পর আমায় এক ভোটবাবু ধরে ফেলে। আমায় পুলিস ধরে নিয়ে জানতে চায়, আমি কাদের লোক। সেই সময় কেউ পুলিসকে ঢিল ছোঁড়ে। পুলিস তাড়া করে। গাঁয়ে হঠাত্ যেন যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। একদিকে পুলিস, আর অন্যদিকে গাঁয়ের লোক। পুলিস বেশি ছিল না বলে, গাঁয়ের লোকেরাই জিতে যাচ্ছিল। কিন্তু কোনও এক ভোটবাবু পুলিসকে গুলি ছুঁড়তে বলে। কেস জন্ডিস হচ্ছে দেখে আমি ছুটে পালাই। ভুল করে পুলিসের গুলি এসে লাগে আমার গায়ে আর আমি মারা যাই।
কী বলছো।
হ্যাঁ ছ্যার। আমি শুধু একটা কথাই বলব আমি আর চাই না। ভোটের সময় কেউ আমার মত প্রাণ হারাক। মানুষ নিজের ভোট নিজে দিক। ভাল লোকেরা জিতুক, খারাপরা হারুক। কিন্তু ছ্যার আপনি জানেন না ওই মেছিনে যত ভোট পড়ছে তার বেশিরভাগটাই জল। পশ্চিমের গাঁয়ের লোকেদের জোর করে ঘরে আটকে রেখে মুকুজ্জে মশাই ভুতুড়ে ভোটার দিয়ে পুরো ভোট করিয়েছে। পশ্চিমের গাঁয়ের লোকেরা ওনাকে ভোট দেবে না বুঝতে পেরেই গুন্ডা, ভুতুড়ে ভোটার নামিয়েছে।
কিন্তু আমি এখন কী করতে পারি! ভোট তো শেষ।
না ছ্যার, আপনি না, আমি করব। আমি সারাদিন লাইনে দাঁড়িয়েছে গুনেছি পুরো ৩২৫টা জাল ভোট পড়েছে। আমি তো ভূত। আমি মেশিনে কারসাজি করে জাল ভোটগুলো বাদ দিয়ে সত্যি ভোটের হিসেব দিয়ে দিতে পারি। কিন্তু আমি পড়াশোনা জানি না। মেশিনের মাথামুন্ডু জানি না। আপনি আমায় সাহায্য করুন।
(গল্পের শেষটাও ভারী সুন্দর হল। দরজা বন্ধ করে ভূতকে নিয়ে ভোটবাবু আসল ভোট বাছতে বসলেন। ছাপ্পা ভোটগুলো সব বাতিল হয়ে গেল। শহরে ফেরার সময় কালু ভুতকে হাত নাড়লেন ভোটবাবু। কালু ভূত চোখ মুছল। ও শপথ নিয়েছে আর কোনও ভূতুড়ে ভোটারকে সে গাঁয়ে থাকতে দেবে না। সব কটার ঘাড় মটকে খাবে।)