‘তরুণ’দের জন্য
তেজ কমতে শুরু করলে অনেক সাংবাদিকের তরুণ হয়ে ওঠার ইচ্ছে হয়। চামড়ায় ভাঁজ, চুলে রুপোলি ঝিলিক ছাপিয়ে বেরনো নিজেদের পদের জোর আর ক্ষমতার আতিশয্যে নিজেদের বড় “তেজস্বী” ভাবতে থাকেন।
তেজ কমতে শুরু করলে অনেক সাংবাদিকের তরুণ হয়ে ওঠার ইচ্ছে হয়। চামড়ায় ভাঁজ, চুলে রুপোলি ঝিলিক ছাপিয়ে বেরনো নিজেদের পদের জোর আর ক্ষমতার আতিশয্যে নিজেদের বড় “তেজস্বী” ভাবতে থাকেন।
ঠিক এমনি করেই প্রথম লাইনটা শুরু করব ভেবেছিলাম। তারপর মনে হল এ পেশার অন্তর্গত বহু মানুষেরই নরম স্থানে অযথা আঘাত লাগতে পারে। বলে নেওয়া ভাল, এ পেশায় এমন ঘটনা বিরল নয়। যে-সাংবাদিককে নিয়ে কথা হচ্ছে, তিনি তরুণ তেজপাল। যাঁর স্টিং অপারেশনের বহর চোখ ছানাবড়া করে গিলতাম। যাঁর ব্যক্তিত্ব আর বুদ্ধিমত্তায় ঘায়েল হতে হতে মনে হত, সাংবাদিক হলে এমনই হব। কলমের এক আঁচড়ে সবার মুখোশ খুলে দেব! তিনি যেমন পারলেন সবার নাঙ্গা চেহারাটা বের করে দিতে!
কত ভুল ভেঙে গেল সাংবাদিক জীবনের রঙ্গব্যঙ্গের নাট্যশালায়.. জেনেছিলাম সাংবাদিকতা হচ্ছে পাঁচিলে বসে পর্যবেক্ষণ করা। বসে বসে নোট নেওয়া। কখনও সাইড নিতে নেই। বাস্তবে, অবিরাম কোনও-না-কোনও সাইড নিতেই হয়। চারিদিকে যা উত্পাত দেখি, তুল্যমূল্য বিচারে তরুণের অপরাধ নেহাতই দুধেভাতে। যতদূর জানা যাচ্ছে, লিফটের ঘুটঘুটিতে চাইছি-তোমার-বন্ধুতা গোছের আদর-অভ্যর্থনা চেয়েছিলেন এই “তরুণ ও তেজিয়ান”-মনস্ক ভদ্রলোক, তাতেই এত! (নারীবাদীরা আমাকে মারতে আসবেন জেনেই লিখলুম কথাটা, এর চেয়েও অভদ্র পরিস্থিতিতে পড়েন মহিলারা, চাকরি বাঁচানোর তাগিদে টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করতে পারেন না!) তিনি যে ঘটনাটি ঘটিয়ে ফেলেছেন, তাকে স্ট্যান্ডার্ড কনসেপশনে ধর্ষণ বলা চলে না, তবে আধুনিককালে ধর্ষণ সম্পর্কিত যে-বয়ান তৈরি হয়েছে, আইনি ভাষায় এটিও ধর্ষণের সমার্থক।
তরুণী সাংবাদিক ছিলেন তাঁর মেয়ের বন্ধু। তবু লিফটের সিসিটিভি না থাকার সুযোগ নিতে ছাড়েননি ভদ্রলোক। বন্ধুত্বপূর্ণ কথোপকথনের মধ্যেই তিনি নাকি এ-ও বলেছিলেন সেই তরুণীকে যে, একসঙ্গে দুজন মানুষকেও ভালবাসা সম্ভব। অনেক কোমল, কিছু বাড়াবাড়ি আদরের মধ্যে এই। ভয়ানক কথাটিও বলেছিলেন তরুণ তেজস্বী এই ভদ্রলোক.. যদি চাকরি টিকিয়ে রাখতে চাও, এর চেয়ে ভাল পদ্ধতি আর কিছু নেই..
বলুন তো, এই মন্দার বাজারে, এর চেয়ে বড় সাংঘাতিক কথা কিছু হয়? বিশ্বমন্দা এমন দ্রুততায় গ্রাস করছে আমাদের যে, কখন চাকরি থাকে, কখন যায় তার হিসেব নেই। কত কৌশল করে চেয়ার বাঁচাতে হয়! চেয়ার ছেড়ে উঠলেই বুকদুরদুর করে না যে কাল থেকে ওই চেয়ারে বসতে না-ও দিতে পারে? নারী হোক বা পুরুষ, আমরা সবাই বেতনভুক। মাসান্তে মাইনেই একমাত্র স্বীকৃতি। চাকরি এমনই এক বন্দুক, যার ঘোড়ায় কোনও প্রভাবশালী পুরুষের আঙুল থাকলে যে-কোনও চাকরিজীবী নারীই ভোগ্য ও ধর্ষণযোগ্য। উচ্চশিক্ষার ডিগ্রি নিয়ে যে মেয়েটি চাকরির সন্ধানে আসে, নিজেকে উচ্চপ্রতিষ্ঠিত দেখতে চায়, উচ্চাশা পোষণ করে, এই ক্ষমতার চক্রব্যূহ তাকেও অভিমন্যু করে। উল্টোদিকের চেয়ারে বসা সুটেড-বুটেড লোকটির আকারে ইঙ্গিত কমবেশি বুঝিয়ে দেয় যে, উঁচুতে উঠতে গেলে তাকে ততটাই খাদে নামতে হবে। ব্যাপারটাকে অভ্যেস করে নিলে সিঁড়ির মতোই সোজা মনে হবে। নয়ত দুর্গম পর্বত।
আমার বান্ধবী এক সাংবাদিককে চিনি, জীবনের প্রথম ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিল একটি রেডিয়ো চ্যানেলে। বিপরীতের টেবিলে ছিলেন এরকমই এক বয়স্ক এবং তরুণ-মনস্ক ভদ্রলোক। ইন্টারভিউ চলতে চলতেই জিজ্ঞেস করলেন, বিয়ে করনি কেন? তুমি কি লেসবিয়ান? প্রথমটা ঘাবড়ে গিয়ে চুপ করে বসেছিল সে।
ওদিকে বৃদ্ধ তরুণের মুখের হাসি। আরেকটা প্রশ্ন, শেয়ার আ নন-ভেজ জোক উইথ মি.. জাস্ট এনি কাইন্ড অফ নন-ভেজ..
আমার বান্ধবী লজ্জায় লাল। এক্সপ্রেস ট্রেনের মতো ভেবে চলেছে...সম্মানের চেয়েও চাকরিটা তার কত বেশি প্রয়োজন। আর ঠিক সময়ে কেন একটাও নন-ভেজ জোক মাথায় আসছে না।
ইতিমধ্যেই হাসিহাসি মুখে সেই তরুণ বৃদ্ধ আরও একটি প্রশ্ন ছুড়েছেন, তোমার জীবনের সবচেয়ে অন্ধকার মুহূর্তটা কেমন ছিল? আমি জানতে চাই...
হতাশ হয়ে উঠে পড়েছিল আমার বান্ধবী। সোজা মুখের ওপর বলেছিল, যদি সেটা অন্ধকার মুহূর্তই হয়, তবে আলোতে বলব কেন আপনাকে। অন্ধকারে আসুন, বুঝিয়ে দিচ্ছি.
অফিস থেকে সেই ইন্টারভিউয়ের কল আর পাওয়া হয়নি। অফিস থেকে বেরনোর সময়ে কমেন্ট বুকে অনেকগুলো ভাষা উগরে দিয়ে এসেছিল, এই পর্যন্তই।
কম বা বেশি, স্বল্প কিংবা বিস্তর, শতকরা নিরানব্বইজন মহিলা সাংবাদিককেই, কেরিয়ারের কোনও-না-কোনও ধাপে এইসব তরুণ-মনস্ক বৃদ্ধের খপ্পরে পড়তে হয়! এখানে যদি ভাবেন মহিলারা নেহাতই শিকার, ভুল। মহিলা সাংবাদিকরা কখনও অবলা হন না। বিস্তর বলেন, গলা ফাটিয়ে বলতে পারেন। কারণ সেটাই রিকোয়ার্ড প্রফেশনাল স্কিল। ফাঁদ কেটে বেরনোর টেকনিক ঠিক বের করে ফেলেন। তরুণ-মনস্ক এইসব গণ্যমান্যরাও ব্যবহারযোগ্য হন, বুদ্ধি খাটিয়ে অনেক মহিলাই এদের সিঁড়ি করেছেন, সে উদাহরণও নেহাত কম হবে না। কেউ কেউ আবার সেটা না করে স্বস্তির সন্ধানে অন্যত্র চাকরি নিয়ে চলে গিয়েছেন, সম্মুখীন হয়েছেন আরও কঠিন কোনও বাস্তবের।
যাঁর কথা বলছি, সেই তরুণ তেজপাল জাতে ও ধর্মে সাংবাদিক। ইংরেজিতে তুখোড়। তাই অনেক ভাষা ও শব্দগুচ্ছের উপাচারে শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে জানেন। ই-মেলের বহরেই তা মালুম। লিফ্টের মধ্যে ইন্টুমিন্টুর জন্য প্রথমে আনকন্ডিশনাল অ্যাপোলজি চেয়েছেন। পরে আরও বেশি লজ্জিত হয়ে নিজেই নিজের শাস্তিবিধান করে ছ মাসের সাবাটিক্যালে গিয়েছেন। ইংরেজিতে যাকে তিনি আখ্যা দিয়েছেন সিক্স মান্থ পেনান্স। বুঝুন! আজ যদি আসারাম বাপু বলেন, রেপ করে আমার বড় মনখারাপ করছে, আমি ছ মাস ব্রেক নিতে চাই, সেটাই কি তাঁর যথাযোগ্য শাস্তি বলা যাবে? ওই মিডিয়া সংস্থার এডিটর সোমা চৌধুরী একজন মহিলা। তিনি এ বিষয়ে চাকরির নিয়ম মেনেই একটি ইন্টারন্যাল কোর কমিটি গঠন করেন। কর্পোরেট অফিসে একটি উইমেন হ্যারাসমেন্ট সেল থাকে, সেটাই নিয়ম। কিন্তু শাস্তি দেবেন কে? ইন্টারন্যাল কোর কমিটি তো অফিসের নিজস্ব লোকজন নিয়ে তৈরি কমিটি, যাঁরাও মাইনে পান মাসের শেষে। কাজেই যেচে কেউ নিজের পায়ে কুড়ুল মারতে যাবেন না। এমতাবস্থায় প্রথমটা সাজানো-গোছানো শাস্তিপ্রক্রিয়া হলেও শেষে পিছু হঠতে হয়েছে ভিকটিমকেই। অতি সন্তর্পণে কখন যে সেই সংস্থা থেকে তাকে বেরিয়ে যেতে হয়েছে, সে খোঁজ আর কেউ রাখেননি। ক্ষমতাই সর্বশেষ কথা, সেটাই মেনে নিতে হয়েছে।
রাজনৈতিক হস্তক্ষেপেই হোক বা অন্য কোনও অধিক ক্ষমতাবান পুরুষের দাক্ষিণ্যে, এই অনাম্নী তরুণী যে “এটুকু”-র জন্যেও বিচার পেলেন, হ্যাটস অফ। তেহেলকা থেকে ইতিমধ্যেই পদত্যাগ করেছেন সোমা চৌধুরী। যথোপযুক্ত শাস্তির অপেক্ষায় তরুণ তেজপাল। তাঁর তেজের শেষ দেখার অপেক্ষায় দেশ।
অন্ধকারে কী ঘটে তা দেখতে পায় একমাত্র ক্যামেরার চোখ আর সাংবাদিকের কলম। কত ক্ষমতাবান প্রথিতযশা এই দুইয়ের জন্য হাতেনাতে ধরা পড়েছেন!...সাংবাদিকতার সহজপাঠ মেনে এখনও পাঁচিলেই উঠে বসে আছি। পাঁচিলে বসেই পা দোলালাম, মাটিতে পা পর্যন্ত পেলাম না। তেজ কমে এলে যে ক্ষমতার ইমারতও ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়, এটা তো অন্তত দেখতে পাব, আর নোট নিতে পারব। কম কিসে?