দু’ মিনিট সময় দিন, দাদা...

Updated By: Jun 10, 2015, 03:25 PM IST

তখনও ছিল সময়ের দাম। ১২০ সেকেন্ডে দুইমিনিট, ৬০ মিনিটে এক ঘণ্টা। ছিল বয়াম-ভরা লেবুর আচার, কৌটো ভরা আমসত্ত্ব, আমের সময় পেরোলে যাতে জিভে স্বাদ ঠেকানো যায়। চিড়ের মোয়া, মুড়ির মোয়া দাঁতে কাটলে এককুচিও বালি কচ্ করে লাগত না। পেয়ারা-গুড়মুড়ি-দুধভাত আর বাতাবি লেবুর জন্যে নিরীহ কাঠবিড়ালির সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা হত। বেয়াদব ছেলেরা ফাটা ফুটবলের ভেতরে কুলের আচার ভরে সাপ্লাই করত।

এক কথায়, সে ছিল রবীন্দ্র-নজরুল সোনাঝরা দিন। রায়বাবুর জমানা আসেনি। সময় আর টাকার সমীকরণে অসম্ভব কোনও বিপ্লব ঘটে যায়নি। বাবার লেখা আবোলতাবোল-এর ছড়ার প্যারডি ধার করে এক নতুন খাবার এল। চটজলদি বানিয়ে প্লেটে দেওয়া যায়। খাই খাই কর কেন এস বস আহারে, দুমিনিট লাগে ঠিক ম্যাগি কয় যাহারে! সঙ্গে সত্যজিত্‍ বাবুর অ্যাপ্রুভ্যাল। খিদের রাজ্য হঠাত্ই পদ্যময় হয়ে উঠল চোখের  পলকে। সঙ্গে একটা সর্বময়, সর্বগ্রাহ্য মেসেজ- রনি খায় বনি খায় ম্যাগি খায় সকলেতে.. ম্যাগি খাই রোজ রোজ/ খিদে পেলে ম্যাগি আছে দুমিনিটে মহাভোজ।

দুমিনিটের স্বল্পতাকে এমন উদারবিস্তৃত করে, তিনশ পঁয়ষট্টি দিনের হিসেবে উত্তরণ ঘটানোর মজারু ছিল না আগে। উদর পূরণের সেই যে উদার পুরাণ শুরু হল, কুড়ি বছর কেটে গেলেও থামল না তার বিস্তৃতি। বেড়েই চলল। বেড়েই চলল। ভাল জিনিসের আস্বাদ হয় রসিয়ে রসিয়ে। দমে আঁচে বসিয়ে। গ্রীষ্মদিনের ছাদের রোদের তাতে শুকিয়ে। রান্নাঘরের ভ্যাপসা গরম থেকে খোলা হাওয়ায় দম নেওয়ার হাতছানি মায়েদের জন্য। যে প্রোটিন-ভিটামিন মিনারেলের জন্য এত এত সময় ব্যয়, সে-ও নামিয়ে দেওয়া হল দু মিনিটে। ভিকট্রি সাইন। আবার প্যাকেটবন্দি হয়ে এক্কেবারে হাতের মুঠোয়। পাহাড়চুড়োয় কিম্বা সমুদ্রের গভীরে, মহাকাশে কিংবা কয়লাখনিতে। যেখানেই যাবেন, সেখানেই খেতে পাবেন। এমনই সহজলভ্য। কিছুই না পান, এটা পাবেন।

তবুও প্রজন্মের সঙ্গে প্রজন্মের সেই ট্র্যাডিশনাল যুদ্ধ। দাদু-দিদাদের মোটেই পছন্দ হয়নি এই সময়ের হিসেবটা। কিছুই “করা” হল না অথচ পেটটি ভরে গেল, হয় নাকি? তাও ময়দার কেঁচো খেতে হবে রোজ রোজ! তবু এই ব্রেকফাস্ট টেবিলে এই বিরাট, বিপুল বাঁধভাঙা তোড়ের সামনে একদিন মাথা নোয়ালেন। কেঁচোই খেতে শুরু করলেন। সারা বিশ্ব নাকি একেই পরম আদরণীয় বলে জেনেছ, এবং খেয়েছে। মানিকবাবুর সই দিয়ে বাঙালির ব্রেকফাস্ট আর স্ন্যাক্স মেনুতে এন্ট্রি নিয়েছিল ম্যাগি। শুধুই বিজ্ঞাপনকে দোষ দেওয়া ভুল। প্রত্যন্ত গ্রামের ঘুপচি গুমটিতেও আজ পাঁচটাকা দামের সাদা-কেঁচোর প্যাকেট পাওয়া যায়। তার সঙ্গে ছোট মশলার স্যাশে। সসপ্যানে জল মিশিয়ে জিভে দিলেই সুড়ুত্.. বিশ্বাস করুন, ম্যাগি খেয়ে সবাই বেশ ভালই ছিল। সঙ্গে আবার সবজির টুকরোও পড়ল। মোটা হওয়ার সঙ্গে ময়দার নিবিষ্ট যোগাযোগ আবিষ্কৃত হওয়ার পর বাজারে আটা নুডলও বেরলো। বেরোল জোয়ার-বাজরা-রাগি নুডলও। কেন না কালে কালে এসব ব্রাত্য দানাশস্যও বিশ্ববাজারের নিউট্রিশনিস্টের টপলিস্টে পড়তে শুরু করেছিল যে। পুষ্টিপদার্থের সঙ্গে বেশ ঢাল-তলোয়ার নিয়েই লড়েছিল নেসলের এই ব্র্যান্ড। শেষে তো এমন অবস্থা দাঁড়াল যে, শাকসবজি কিনতে আর থলি  নিয়ে বাজারে যেতে হবে না। সবই গুঁড়োকরে ঠুসে দেওয়া হয়েছে ওই ম্যাগির প্যাকেটে। এক কথায় অল-ইন-ওয়ান স্টেটাস। প্রতিদ্বন্দ্বীদের ছাড়িয়ে অনেক উঁচুতে।

হঠাত্ এমন দুমিনিটের বিশ্ব ভেঙে চুরে মুখ থুবড়ে পড়বে কে জানত! এবং জানার পরে না-হয় সবখান থেকে ভ্যানিশ হয়ে গেল কোটিকোটি ম্যাগির প্যাকেট। খাবো না, বলে জেহাদ ঘোষণা করতেই পারি। কিন্তু তার চেয়েও বেশি দুঃখ উপচে উঠেছিল অন্য কারণে। এতদিন তবে খেলুম কেন? কাঠ-পেনসিলের সিস যে আসলে ম্যাগি নয়,  এ যেন এক নেশাধরানো রূপকথার জীবনাবসান। নেসলে কোম্পানির দণ্ডমুন্ডের কর্তারা নাহয় চোখের সামনে থেকে উঠিয়েই নিলেন। কিন্তু যে-শূন্যতা আমাদের  প্রাণেমনে, তাকে কী করে ভরিয়ে দেওয়া যায়। যাঁরা ভাবছেন এটা নাকিকান্না, তাঁদের ভুলটা একটু ভাঙা যাক। এক সমীক্ষায় জানা গিয়েছিল, এশীয় দেশগুলিতে দরিদ্রের দিনের লাঞ্চ, রাতের ডিনার সবই ম্যাগি দিয়েই সারা হয়। ফলমূল, দানাশস্য এমনকী একজোড়া ডিমের থেকেও কম মূল্যে কিনতে পাওয়া যায় দুমিনিটের নুডল। উদরপূর্তিও হয় দ্রুত। ছোটপর্দায় বড়পর্দায় এই খাবারের গুণগানের শেষ নেই। এমনকি আজকের যারা বিখ্যাত নাম, তাঁদেরও স্ট্রাগলিং ডে-তে সঙ্গী ছিল ম্যাগির প্যাকেট।

তাজ্জব ব্যাপার। একগুচ্ছ তাবড় বলিউড তারকাদেরও কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছিল এই মর্মে যে, তাঁদের মাধ্যমেই মানুষ এই বিষবৃক্ষ ম্যাগির গুণের বাহার জানতে পারেন। আদতে তাঁরাই সবচেয়ে লাভবান। রেমুনারেশন শুনলে চোখ কপালে উঠবে আর ফেরত আসবে না! ভাবুন তো কী মজার প্রফেশন! লক্ষ্মীও আসবে ঘরে, আর বাজে বকবকানির দায়টাও নেব না। কেন নেব? পুরোটাই তো অ্যাড এজেন্সির স্ক্রিপ্টরাইটাররা লিখেছেন। আমাদের কী দোষ! না লিখলে আমরা থোড়াই বলতুম। আর টাকার কথা বলছেন ? ওতে আমাদের হক আছে। আমাদের কাছেই বা আসা কেন ভাই, রামশ্যামযদুমধুরা কী করছিল? গণতান্ত্রিক অধিকার তো কাস্টমারের, গ্রহণ করবেন না বর্জন! সহজ ও অকাট্য হিসেব। সেলেব্রিটি হওয়ার যেসব সুবিধে এই পোড়া দেশে আছে, সেই দীর্ঘ তালিকায় এই যুক্তিটা প্রথমে দাঁড়াবে।

তর্ক যা হোক। চিপসের প্যাকেটে হাওয়া-ভর্তি থাকলেও বড় ভার বোধ হয়। এমন মহার্ঘ বস্তুর উত্পাদক যাঁরা, সেই আলুচাষিরা সপরিবারে কীটনাশক খাচ্ছেন। দশ টাকা দিয়ে গোটা দশেক ফিনফিনে চিপস কেনা সত্ত্বেও বাঁচানো যাচ্ছে না তাঁদের। আলু পচছে। সমাজ পচছে। স্তূপাকার ম্যাগির প্যাকেট ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে। বয়ামভরা মুড়ি-বাতাসা-আমসত্ত্বরা তো উধাও হয়ে গেছে সেই কোন তাচ্ছিল্যের বিস্মৃতিতে। আজকের জেনারেশনের অনেকে চোখেই দেখেনি সেসব বস্তু। রোজ রোজ ম্যাগি খাওয়ার যে পৌরাণিক কাহিনিতে মজেছিল সব্বাই তাতেও পূর্ণচ্ছেদ পড়ল। লাভবান হল কারা?

কদিন আগে এক কফি মেশিন থেকে এক কাপ নেসক্যাফে কিনেছিলাম। তখন ম্যাগির দুনিয়ায় সদ্য ঝড় উঠেছে। কী হবে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। এক চুমুকে কাপ শেষ করে পয়সা দিয়ে বেরোতে যাচ্ছি.. টুপি-অ্যাপ্রন পরা বছর-কুড়ির ছেলেটি এগিয়ে এল।

-দুমিনিট সময় দিতে পারেন ম্যাডাম?

আমার দিকে এগিয়ে দিল একটি ফিডব্যাক ফর্ম। দিব্য সত্-মেজাজে কফির গুণাবলী টিক দিলাম। খুব একটা আশাপ্রদ নয়। চোখ বুলিয়ে বড় নিরাশ মুখে তাকাল ছেলেটি।

-আপনার কী ভাল লাগেনি কফিটা? ম্যাডাম, আপনি আমাদের ক্যাপুচিনো ট্রাই করতে পারেন।

-না না, ভালই, তবে মিষ্টিটা একটু বেশি মনে হল, তাই..

-আপনি অতটা ভাল মার্কস দেননি তাই জিজ্ঞেস করলাম। আপনি আমাদের আইস টি-ও ট্রাই করতে পারেন? আসলে জানেন ম্যাডাম, আমাদের সময়টা বড় খারাপ চলছে। নেসক্যাফে ইজ আ ট্রাস্টেড ব্র্যান্ড

পাশাপাশি আরও কয়েকটি সুট-টাই পরা ছেলে জড়ো হয়ে গেল। সবারই বয়স ওই কুড়ির কাছাকাছি। কয়েকজন চোখ বুলিয়ে নিল ফর্মটার ওপর।

একজন বলল, ম্যা়ডাম আপনি আমাদের দুটো মিনিট টাইম দিন। আমাদের নতুন দুটো কফির টেস্ট ট্রাই করুন। আসলে জানেনই তো ম্যাগি নিয়ে কী চলছে। উই আর আ বিট ওয়ারিড।

আরেকটি শুকিয়ে আসা মুখ আমায় বলতে থাকে..

-সত্যি বলতে কী ম্যাডাম, আমাদের কী হবে কিছুই বুঝতে পারছি না। অ্যাকচুয়ালি, মাস ছয়েক আগে অনেক ট্রাই করে এই জবটা পেয়েছি। মার্কেটের যা অবস্থা, বুঝতেই পারছেন দিদি..

পাশে দাঁড়ানো এক ভদ্রলোক সবে দোমড়ানো পেপারকাপটা ডাস্টবিনে ফেলেছেন। তাঁর দিকে এগিয়ে গেল একটি ছেলে। হাতে পাঁচটাকার বলপেন সহ একটি ফিডব্যাক ফর্ম। দাদা, দুমিনিট সময় দেবেন?...

চোখ ফিরিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে বলি..

-আমাকে যদি কাইন্ডলি আর একটা ফ্রেশ ফিডব্যাক ফর্ম দেন...মানে, আমার ভুলটা একটু শুধরে নিতে চাই। দুমিনিট একটু টাইম দিন, দাদা।

ফুলকলি

(যাঁরা ফুলকলির কলম মিস করছিলেন, আবার সে এসেছে ফিরিয়া)

.