আমার পেটেন্ট, কপিরাইট সবই যে তুমি মা
স্বরূপ দত্ত
সকাল থেকে সময় পেলে একবার রেডিওটা শুনে নিই। রেডিও মানে FM আর কী! কলকাতা শহরে থেকে আজকের দিনে আর আকাশবাণী কলকাতা 'ক' শোনার অবকাশ কোথায়! ওই FM নামক জিনিসটাই দিব্যি রেডিওর জায়গাটা নিয়ে নিল! অতবড় বাক্সটা পড়ার টেবলের পাশে রাখা নেই। মোবাইলে মোবাইলেই 'ফ্রিকোয়েন্সি মডিলিউশন'। ঘোষক বা ঘোষিকার কণ্ঠস্বর যত খারাপ, কথা যত দুর্বোধ্য, সেই এফএম তত উষ্ণ অথবা ততটাই রক্তিম লাল! কিংবা শক্তিতে ভরা অথবা জ্বরে কাবু। মানিয়ে নিয়েছি দিব্যি হেঁটে চলা সামাজিক পথটায়।
আজ মনে পড়ছিল তাঁর কথা। আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর। গাছেরও যে প্রাণ আছে, আবিষ্কার করে গিয়েছিলেন। বিবেকানন্দ বলতেন, এই পৃথিবীতে কেউ কিছু আবিষ্কার করেন না। সব আগে থেকেই ছিল। কেউ সেটা সবার আগে খুঁজে পেয়েছে শুধু। এই যুক্তিতে জগদীশ চন্দ্র বসুকে প্রথম এমন একটা মানুষ মনে হয়েছিল, যাঁর 'হুঁশটা' বড্ড বেশি। না হলে এই পৃথিবীতে নিজেকে ছাড়া কাউকে নিয়ে ভাবার সময় কোথায় কার আছে! থাকলেও সেটা প্রাণীদের জন্য। কারণ, প্রাণীর সংখ্যাটাও যে লাখ-লাখ। সব বাধা অতিক্রম করে উদ্ভিদ পর্যন্ত পৌঁছনো, তারপর তাঁর হৃদস্পন্দন অনুভব করা! স্যালুট। আজকের এই যান্ত্রিক পৃথিবীটায় মানুষের কোনও অনুভূতি যখন তাঁর প্রিয়জনকে ছুঁতে পারে না, তখন সামনের ওই লজ্জাবতী পাতার লাজে কী আর মন সায় দেয়! সারা পৃথিবী যখন পাপড়ি থেকে পোশাক খুলতে ব্যাস্ত, তখন আর ওই লাজুক কোমল শরীরের গুটিয়ে থাকা উদ্ভিদ কীভাবে আমার প্রেমিকা হতে পারে! পারে। আমার পারে। কারও কারও কাছে দিব্যি পারে। হয়তো আপনিও এমনই। বাড়ির গোলাপ গাছে নতুন কুঁড়ি দেখে আপনার মনেও কী আসে না, পরিবারে নতুন অতিথি এলো?
জগদীশচন্দ্র বসুকে নিয়েই আলোচনাটা শুরু করা। তাঁর ভালোর কথা তো বললামই। বাকি যে আরও আছে। বেতার। রেডিও। যে নামই দিন। এও যে তাঁরই দান। কিন্তু উইকিপিডিয়াই হোক অথবা ছেলেবেলার পাঠ্যবই, সব জায়গাতেই তো পড়ে এসেছেন বেতারের আবিষ্কর্তা এক ইতালিয়। মার্কনি। বয়সে প্রবীন। অনেক অভিজ্ঞ। এমন কাউকে কাউকে আক্ষেপ করতে শুনেছি। ইস, আমাদের আরও একটা নোবেল পাওয়ার ছিল। ওই মিলখা সিংয়ের অলিম্পিকে চতুর্থ হওয়ার মতোই হাত ফসকে গিয়েছে পদকটা! আসলে জগদীশ চন্দ্র বসু বেতার আবিষ্কার করার পর এক মার্কিন ব্যবসায়ী বারবার বলেছিলেন, পেটেন্টটা করিয়ে নিতে। মানুষটা তো বাঙালি। উত্তর দিয়েছিলেন এভাবেই, 'আমি সরস্বতীতেই খুশি। লক্ষ্মীর পূজারী নই।' এই কথপোকথনের চিঠি চালাচালির মাঝেই ফ্লাট বুকিং করে গেলেন আর একজন! মার্কনি। নোবেল ফস্কালো আচার্যের। আমাদের।
ভাবছেন, এত কথা আজ কেন? আসলে আজ একটা বিশেষ দিন। না, এই দিনগুলোয় আপনি অত সচেতনতা পাবেন না। আসলে চলে বেশি 'অ্যাভারেজ' বা গড়পড়তা জিনিস। তাই আজকের ওয়ার্ল্ড ইন্টালেকচুয়াল প্রপার্টি ডে-র মতো দিনগুলো নিয়ে আপনাকে কে আর সচেতন করবে!আসলে যাঁরা সচেতন করবেন, তাঁদেরও তো আগে সচেতন হতে হবে! জগদীশ চন্দ্র বসু থেকে আজকের আমরা, একই রয়ে গেলাম। সরস্বতীর পূজারী। লক্ষ্মীকে ঘরে আনতে আগ্রহী বেশি। বুঝতে নয়। কী হয় এই ওয়ার্ল্ড ইন্টালেকচুয়াল প্রপার্টি ডে? মানুষের ক্রিয়েটিভিটি, সৃষ্টিকে যাতে পেটেন্ট, ট্রেডমার্ক, কপিরাইট এই জাতীয় জিনিস করে রাখা হয়, তারই সচেতনতা বাড়াতে বিশ্বজোড়া এই বিশেষ দিন।
আজ তো জেনে গেলেন, আজ থেকে তাই কোনও কিছুর সৃষ্টি করতে পারলে, শুধু আনন্দে গা ভাসাবেন না। ওটার সংরক্ষণটাও করে যাবেন। নিজের অস্তিত্ব আপনার ওই সৃষ্টির সঙ্গে জুড়ে দেবেন। তাহলে হয়তো আগামী প্রজন্মকে আক্ষেপ করতে হবে না যে, আমাদের আরও একটা নোবেল ফস্কে গেল! সবশেষে আসি গোটা ঘটনায় নিজের মনের কথায় - ভাবলাম, আমি কী সৃষ্টি করে যাব? ভাবনা এগোনোর আগে পিছিয়ে গেলাম। নিজের শিকড়ে পৌঁছলাম। ছেলেবেলায় মা খুব বলতো কথাটা -'তুই বোধহয় আমার ছেলে নস। আমার এই কষ্টের ঘরে তোর মতো রাজপুত্তুর কীভাবে আসবে!' তখন এত মায়ায় পড়তাম না এ কথার। আজ অনেকদিন বাদে মনে হল, না গো মা। আমার পেটেন্টই বলো অথবা কপিরাইট। সব তোমার। আমার আসলে অস্তিত্বই নেই। তোমার শরীর, তোমার মন, তোমার আশা, তোমার ভরসা হয়ে এই পৃথিবীতে রয়েছি। বিবেকানন্দ বলতেন কেউ কিছু আবিষ্কার করে না। সবই আগে ছিল। মানুষ খুঁজে পায় শুধু। ঠিক মা। তুমি যে আমায় সৃষ্টি করেছো। আবিষ্কার আর সৃষ্টির এই ফারাকটা আমি বুঝতে শিখেছি।ওয়ার্ল্ড ইন্টালেকচুয়াল প্রপার্টি ডে-তে তোমায় একবার বলা- সরস্বতী, লক্ষ্মী, আমার সবই যে তুমি।মা। পেটেন্ট, কপিরাইট নিয়ে ওসব আমেরিকান আর ইতালির মানুষরাই ভাবুক। আমায় আশীর্বাদ করো, চিরকাল যেন জগদীশ চন্দ্রের মতো নিষ্প্রাণের মাঝেও হৃদস্পন্দন খুঁজে যাওয়ার শক্তি পাই। তোমার মতোই। যেভাবে আমায় তুমি প্রাণ দিয়েছো......