বিশ্বসঙ্গীত দিবসে নিজেই বুঝে নিন এ দেশের ৮০ বছরের হিন্দি গানের বিবর্তন
স্বরূপ দত্ত
আমরা ভারতীয়। হিন্দি আমাদের রাষ্ট্র ভাষা। আর এই হিন্দি গানের কদর চিরকাল ছিল, আছে, খুব জোর গলায় বলতে পারছি না, থাকবে না। কেন? উত্তর পাবেন আপনি এই লেখাতেই। নিজে নিজেই। দেশের প্রথম সিনেমা ছিল রাজা হরিশচন্দ্র। মুক্তি পেয়েছিল ১৯১৩ সালে। কিন্তু সেটা ছিল নির্বাক ছবি। প্রথম সবাক ভারতীয় ছবি সেই অর্থে আলম আরা। এই ছবির মুক্তি হয় ১৯৩১ সালে। আজ ২০১৬-র ২১ জুন। ভারতীয় সঙ্গীতের (বলা ভালো হিন্দি গানের) বিবর্তন কীভাবে হল গত ৮০ বছরে, সেটা বোঝানোর জন্য একটা পন্থা নিলাম। শুরু করলাম, ১৯৩৬ থেকে। আপনাদের ১৯৩৬, ১৯৪৬, ১৯৫৬, ১৯৬৬, ১৯৭৬, ১৯৮৬, ১৯৯৬, ২০০৬ এবং ২০১৬-র সবথেকে জনপ্রিয় গানগুলো শোনাবো। আপনি এই গানগুলো শুনতে শুনতেই কল্পনা করতে পারবেন, কীভাবে এক-একটা দশকে আমাদের সমাদটা বদলে গিয়েছিল। আর আজ কতটা করে বদলে যাচ্ছে। আর এই বদল, কোথায় নিয়ে যেতে চলেছে আপনাকে, তার একটা আঁচ আপনি পাবেনই। তাহলে শুরু করি, বিশ্বসঙ্গীত দিবসে হিন্দি সিনেমার গানের বিবর্তন প্রতি দশক ধরে....
১৯৩৬ - এই বছরের সবথেকে হিট হিন্দি ছবি ছিল অচ্ছুত কন্যা। এ ছবির সবকটি গানই তখনকার দিনে জনপ্রিয় হয়েছিল। তারমধ্যে সবথেকে বেশি কদর ছিল যে গানটির, সেটি হল 'ম্যায় বনকে চিড়িয়া বনকে'। এই ছবির গানগুলো লিখেছিলেন যমুনা স্বরূপ। সুর দিয়েছিলেন সরস্বতী দেবী। আর গানটি গেয়েছিলেন, অশোক কুমার এবং দেবিকা রানি। কেমন ছিল আজ থেকে ৮০ বছর আগের হিন্দি গান? নিন শুনে নিন নিজেই। দেখতে আর শুনতে শুনতে বোঝার চেষ্টা করুন, স্বীনতাপূর্ব ভারতবাসী কেমন ছিলেন বিনোদনের বিষয়ে।
১৯৪৬ - আমাদের দেশ স্বাধীন হওয়ার আগের বছর। বুঝতেই পারছেন সেইসময় ভারতের রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপট। সে বছর সবথেকে জনপ্রিয় ছবি ছিল আনমোল ঘড়ি। নৌশাদের সুরে দুলে উঠেছিল গোটা দেশের সঙ্গীতপ্রেমীরা। নুরজাহান এবং সুরেন্দ্র কণ্ঠে 'আওয়াজ দে কাহা হ্যায়' শুনলে আপনার আজও মনে হবে না, এটা ৭০ বছর আগের গান। শুনেই দেখুন একবার।
১৯৫৬ - এরপর এলো ১৯৫৬। হিন্দি সিনেমার গান অন্য মাত্রা পেল। সেবছরই মুক্তি পেয়েছিল সিআইডি। দেবানন্দ-ওয়াহিদা রহেমানের অনস্ক্রিন রোমান্স আর দুর্দান্ত সব গান। যা আজও রিমেক হয়। ডিজে বাজান নাইট ক্লাবে! ৬০ বছর আগের জিনিস চুরি করে! আমাদের পা দোলে। এটা শুনে দেখুন। আপনার মনও দলুবে। মহম্মদ রফি আর গীতা দত্ত যদি বলেন, 'আঁখো হি আঁখো মে ইশারা হোগয়্যা....'।দেখুন আপনার মুডটাই পুরো বদলে যাবে। ওপি নাইয়ার সুরও যে তেমনই করেছিলেন।
১৯৬৬ - এসে পড়লাম ১৯৬৬-তে। সে বছর সবথেকে জনপ্রিয় হিন্দি ছবি ছিল, তিসরি মঞ্জিল। বিজয় আনন্দের পরিচালনায় সেই ছবিতে সুর দিয়েছিলেন রাহুল দেব বর্মন। আর গোটা দেশকে দুলিয়ে ছিলেন জাস্ট। আজও আপনি এসব গানে দুলবেন। আনন্দ পাবেন। মন ভালো হয়ে যাবে। তিসরি মঞ্জিলের কোন গানটার কথা বলব? সবকটিই শ্রুতিমধুর এবং চিরকালীন। কিন্তু মহম্মদ রফি এবং আশা ভোঁসলের কণ্ঠে 'ও মেরি সোনা রে'-রোম্যান্সের উদাহরণ হয়ে উঠেছিল। শাম্মি কাপুর আর আশা পারেখ হয়ে উঠেছিলেন এ দেশের প্রত্যেক যুবক আর যুবতী।
১৯৭৬ - শুরু হল, সাতের দশক। বলা হয়, এ দেশের স্বর্ণযুগ। সবক্ষেত্রেই। ১৯৭৬-এ জনপ্রিয় ছবির নাম করলে তাই তালিকা শেষ হবে না। তবু, বাছলাম সেটাই, যেটা সবথেকে জনপ্রিয়। ১৯৭৬ সালেই মুক্তি পায় যশ চোপড়ার কভি কভি। আর কভি কভির 'কভি কভি মেরে দিলমে খয়াল আতা হ্যায়'-এর থেকে ব্লকবাস্টার হিট আর কী হতে পারে! আজও তো আপনি কখনও কখনও গুনগুনিয়ে ওঠেন। খইয়মের সুরের মাধ্যে হিন্দি ছবির গানে তবলার ব্যবহার আরও বেশি ঝলমলে হয়ে ওঠে। নিজেই শুনুন, বাঁশি আর তবলার এমন সংমিশ্রণ আর পাবেন কোথায়!
১৯৮৬ - তুলনায় একটু খারাপই হবে এই দশক। স্বর্ণযুগের পরই কীভাবে আর একটা হীরকযুগ হয়ে উঠবে। এই ১৯৮৬ সালে মুক্তি পাওয়া ছবিগুলোর মধ্যে সবথেকে বেশি হিট ছবি ছিল, সঞ্জয় দত্ত-কুমার গৌরব অভিনীত নাম। আর নামে পঙ্কজ উধাস গেয়েছিলেন 'চিঠ্ঠি আয়ি হ্যায়'। কে জানে রাতে একা শুনতে শুনতে আজও আপনার চোখ থেকে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়বে কিনা। লক্ষ্মীকান্ত প্যারেলাল জুটির এই সুর কোনওদিন পুরনো হবে? কী মনে হয় আপনার?
১৯৯৬ - এই দশকের হিন্দি গান পুরোটাই ছিল কুমার শানুর দখলে। তবু, বাছলাম অন্য একজনের গান। হরিহরণ। খামোশি দ্য মিউজিক্যাল সিনেমায় যতীন-ললিতের সুরে 'বাঁহো কি দরমিয়া, দো প্যার মিল রহি হ্যায়' সত্যিই তো নির্বাক মানুষদেরও মুখে কথা ফুটিয়ে তুলতে পারে। একে হরিহরণে রক্ষে নেই, সঙ্গে আবার অলকা ইয়াগনিক। খামোশির এই গানগুলো ১৯৯৬-এ চলেছিল গোটা দেশ জুড়ে।
২০০৬ - একটা শতাব্দী শেষ। শুরু নতুন শতকের। অনেকগুলো বছর পেরিয়ে এসেছি ইতিমধ্যে। বুঝতে পারছেন, গান শুনতে শুনতে কীভাবে বদলে যাচ্ছে আমাদের সমাজটা। ২০০৬-এর সবথেকে হিট ছবিগুলোর মধ্যে অন্যতম গ্যাংস্টার। পরিচালক অনুরাগ বসুর সঙ্গে আর এক বাঙালি প্রীতম চক্রবর্তীর হাত ধরে ফের একবার দুলে উঠল আসমুদ্র হিমাচল। এই সিনেমা থেকে নিলাম 'তুহি মেরে সব হ্যায়'। যেমন প্রীতমের সুর, তেমনই কেকে-র গলা। সামনে জবরদস্ত এমরান হাসমি আর ফুটফুটে কঙ্গনা রানাওয়াত। দেশ, সমাজ, গানের বিবর্তন বুঝতে পারবেন নতুন শতাব্দীতে এসে।
২০১৬ - এলাম ফিরে আজকের দিনে। টাইম মেশিনে নয়, গানের ভেলায় চেপে। এ বছরের সবে অর্ধেকটা হয়েছে। আর তারমধ্যেই হয়ে গিয়েছে একের পর এক ছবির মুক্তি। না, এতক্ষণ কোনও অসুবিধা হয়নি। এইবার হল খানিকটা। প্রথমবার সুরকার কেউ একা নন। অথবা কোনও জুটি নয়। একেবারে পাঁচ-পাঁচজন সুরকার মিলে ছবির সবকটি গানে সুর দিয়েছেন। আর সেই সবকটা গানের মধ্যে যেটা সবথেকে বেশি হিট হয়েছে, তা হলো 'প্যার কি মাকি পুজা করতি হ্যায়'! ও হ্যাঁ, সুরকারের মতোই গানটি গেয়েওছেন একঝাঁক গায়ক-গায়িকা। আগের দিনের তুলনা করে বলতে গেলে, খানিকটা কোরাস বলতে পারেন! নিন, এটাও শুনে নিন। আমাদের সমাজে এখন 'মা কি' গানের শব্দ! এই গানও কেউ লেখেন, আর তাঁকে গীতীকারই বলা হয়!
সবকটা গানই তো দেখলেন এবং শুনলেন। এবার নিজেই বিচার করুন বিশ্বসঙ্গীত দিবসে বসে বসে, গত ৮০ বছরে ঠিক কতটা এগিয়ে গিয়েছি আমরা অথবা ঠিক কতটা নিচে নেমে গিয়েছি আমরা। আমি চেষ্টা করে একটা বিবর্তন বোঝানোর জন্য আটটি গানের আশ্রয় নিলাম। একটা লেখায় ৮০ বছরের সমাজটায় গানের ভেলায় আপনাকে চড়ালাম...এবার আপনিই বুঝবেন, এই ট্যুর প্যাকেজ আপনার কেমন লাগলো। একটা আক্ষেপ শুধু থেকে গেল..কয়েক লক্ষ ভালো গানের মধ্যে থেকে আটটি গান এভাবে সালের নিরিখে বাছলাম বলে। আর বাংলা গান নিয়ে আরও একটা লেখা আজ লিখতে পারলাম না বলে।