Durga Puja 2022: সোনা রোদের গান, আমার টুকটুকে নিশান...

সুমন, নচিকেতা, মহীন, চন্দ্রবিন্দু ধরে শুরু হওয়া যাত্রাপথ জনপ্রিয় সঙ্গীতের পিচ্ছিল সরণি বেয়ে ধাবিত হতে লাগল আলতাফ রাজা অভিমুখে। এমন সময়ে স্টেজের পাশ থেকে কে যেন আমার পা দুটি জাপটে ধরে বলে উঠলেন, একবার বল! হুমড়ি খাওয়া সামলাতে সামলাতে হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কী বলব?

Updated By: Sep 22, 2022, 06:33 PM IST
Durga Puja 2022: সোনা রোদের গান, আমার টুকটুকে নিশান...
নিজস্ব চিত্র

সৃজন ভট্টাচার্য্য 

"স্বাধীনতা তুমি
খোকার গায়ের রঙিন কোর্তা,
খুকীর অমন তুলতুলে গালে
রৌদ্রের খেলা।"

রঙিন কোর্তা পছন্দ ছিল তো বটেই। যে যাই বলুক, পুজোর জামা কিন্তু সবসময়ই একটা ব্যাপার। রঙচঙে, প্রগলভ, পাটভাঙা। সঙ্গী ছিল ক্যাপ বন্দুক। তখন সদ্য ফেলুদায় হাতেখড়ি হয়েছে, বড়পুকুরপাড়ের দোকানে সটান হাজির হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কোল্ট ৩২ পাওয়া যাবে? পাড়ায় ঢুকলে ঠ্যাং খোঁড়া না হলেও ওই ফটাস ফটাস শব্দে কান ঝালাপালা হয়ে যাবার তুমুল চান্স ছিল আশপাশের যে কারো। ঢাকের বাদ্যি এবং ধুনুচির ধোঁয়া সহ ডাকের সাজ - সে এক অতীন্দ্রিয় কম্বিনেশন। ওই মিলনায়তনের প্যান্ডেলের পাশের অন্ধকারেই সপ্তমীর দিন সন্ধের পর জীবনে প্রথম সংশয়িত অভিসন্ধির ফিসফাস - হ্যাঁ রে, সিগারেট খাবো, মা যদি গন্ধ পেয়ে যায়?

স্বাধীনতা মানে কী, শামসুর রহমান পড়ার বহু আগে চিনেছিলাম এই চারটে দিনে। লেখাপড়া থেকে অলিখিত ছাড় ছিল, ছিল বয়ঃসন্ধিকালে যথেচ্ছাচারের যাবতীয় উপকরণ। দক্ষিণ কলকাতার ছেলে আমরা, দক্ষিণাপন আর ঢাকুরিয়া লেকের ধার ধরে নিষিদ্ধ আলাপচারিতার মায়া জমত বছরভর। পুজোর দিনে যেন বেলাগাম, বোতামখোলা জামার মতো ছিটকে যেত যত ডিসিপ্লিনের গিঁটফোস্কা। সারাদিন টইটই, কব্জি ডুবিয়ে খাওয়া, মৃৎশিল্পী ও জীবনশিল্পীর হাতে তৈরি প্রতিমা(দের) নিয়মিত দর্শন, খুবই কায়দা করে সানগ্লাসটা কপালে ঝুলিয়ে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের বৃথা চেষ্টা - বাদ যেত না কোনওটাই। কে কার চোখ টানবে! পুজোর সন্ধেগুলো ঝলমল করত সেলফির ফ্ল্যাশ ছাড়াই। দু'একটি ছেঁড়া, তাপ্পি মারা জামা, মলিন প্যান্ট যে দেখা যেত না তা নয়। অপরাধবোধ লুকিয়েই দেখতে হতো, সস্তা দুটি ক্যাপ হাওয়াই চটির তলায় ফেলে ফাটাতে পেরে মলিন জামার আনন্দের আস্ফালন। রবিঠাকুর বলেছিলেন, অনাদর একটি মস্ত স্বাধীনতা। সেও হয়তো, ঠিকই।

আরেকটু বড় হলে শান্ত হতে শেখাটাই নিয়ম। সন্ধের ম্যাডক্সে বাংলা ব্যান্ডের গান তখন হয়ে দাঁড়ালো মুখ্য আকর্ষণ। সিধু-পটার ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ায় দুঃখে প্রলেপ পড়ত নবমীর রাতে অঞ্জন দত্তর গলায় বেলা বোস শুনে। কসবার ওই নীল দেওয়ালের ঘর বানানোর অস্থায়ী স্বপ্নে সওয়ারি হয়েছি কত। সারাবছর দেখা হতো না, এমন বন্ধুরা এসে জুটত পুজোর চারদিন। সপ্তমী সকালে বালিগঞ্জে আমাদের স্কুলের বাইরে দুর্গাবাড়িতে ছিল বার্ষিক গেটুটুগেদারের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। গতবছরও দেখেছি, শেষ কথা হয়েছিল ২০১২'তে, শুনেছিলাম বাইরে আছে, হঠাৎ সামনের চেয়ার থেকে একমুখ হাসি নিয়ে জাপ্টে ধরে বলল, বন্ধু কী খবর বল? কতদিন দেখা হয়নি! এডিনবার্গ আর একডালিয়া মিলেমিশে গেল নিমেষে। হাসতে হাসতে মনে পড়ল - আমার বন্ধু দুনিয়াদারির রাজা, মিথ্যে কথায় জগৎসভায় সেরা/দোষ না করেও পিঠ পেতে নেয় সাজা, আমি দেখি তার সহাস্য মুখে ফেরা...

ব্যান্ড বানিয়েছিলুম আমরাও একখান। অনেক কায়দা করে নামকরণ হয়েছিল 'এবং কয়েকজন'। খান পনেরো স্বরচিত গান, বন্ধুজনে চাপড়েছিল পিঠ। কলেজের বছর পাঁচেক সপ্তমী অষ্টমী শো ছিল বাঁধাধরা। কখনো কলকাতা, কখনো মফস্বল। বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্ভার। এক পুজোয় সুভাষগ্রামে এক ক্লাবের শো'তে গিয়েছি। আমি মঞ্চের এক কোণে দাঁড়িয়ে যতটা সম্ভব উদাসীন হয়ে কীবোর্ড বাজিয়ে চলেছি আপনমনে। রাত হয়ে গিয়েছে, উদ্যোক্তারা বেপাত্তা, শ্রোতারা নামতে দেবেন না। অগত্যা সুমন, নচিকেতা, মহীন, চন্দ্রবিন্দু ধরে শুরু হওয়া যাত্রাপথ জনপ্রিয় সঙ্গীতের পিচ্ছিল সরণি বেয়ে ধাবিত হতে লাগল আলতাফ রাজা অভিমুখে। এমন সময়ে স্টেজের পাশ থেকে কে যেন আমার পা দুটি জাপটে ধরে বলে উঠলেন, একবার বল! হুমড়ি খাওয়া সামলাতে সামলাতে হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কী বলব? ভদ্রলোক বলেই চললেন, না না, একবার বল! বেশ খানিকক্ষণ পর বোঝা গেল, অনুপম রায়ের প্রখ্যাত গানটি পারফর্ম করার অনুরোধ আসছে। কিন্তু, গোটা বাক্যটি বলার অবস্থায় তিনি তখন নেই। স্বাভাবিক। ঘড়িতে রাত সোয়া বারোটা, এ অবস্থায় স্যানিটি আশা করা নেহাতই আমার ভ্যানিটির পরিচায়ক ব্যতীত আর কিছু নয়!

এর পাশাপাশিই গত অনেক বছরের অভ্যেস, সিপিআই(এম)'এর বুকস্টল। সেখানে মার্কসবাদী সাহিত্য, অসমবয়সী আড্ডা আর মুড়ি চানাচুর, কখনো কারো পয়সা বেশি থাকলে কোল্ডড্রিংকের দিলখোলা সহাবস্থান। প্রথম বর্ষের ছাত্র, বলিয়ে কইয়ে, যাকে বলে বেশ প্রমিসিং, খান তিনেক মিছিলে হেঁটে হঠাৎ উধাও। পরীক্ষা শেষ, তবুও বাবু আর ফোন তুলছেন না। হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছি প্রায়, এমন সময়ে অষ্টমী দুপুরে হিমুর মতো হলুদ পাঞ্জাবি পরে গুটি গুটি পায়ে তিনি হাজির আমাদের গোলপার্কের বুকস্টলে। পাশে উঁকি মারছে একফালি অনভ্যস্ত নীল শাড়ির পাড়। হাসি হাসি মুখে সলজ্জে সিদ্ধান্ত জানানো হলো আমায় - দাদা, ও আমার ক্লাসমেট, এখন থেকে দুজনেই এসএফআই করব, পরের মিটিংটা কবে আছে বোলো। আমি আর কী বলব, কিউপিড ও লেনিন একইসাথে ভর করেছেন যাদের মাথায়, কংক্রিট অ্যানালিসিস অফ কংক্রিট সিচ্যুয়েশন করে তাদের, "আচ্ছা জানাবো, আপাতত যা পালা, ভাল করে ঠাকুর দেখ দুজনে" বলে যুগলকে বিদেয় করাটাই শ্রেয় মনে হলো। এসব কেসে ওমরীশ পুরীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে কারই বা ভাল লাগে!

আরও পড়ুন: Amit Shah Inaugurates Durga Puja: কলকাতার ৩টি পুজোর উদ্বোধনে শহরে আসছেন অমিত শাহ

সামাজিক পরিসরে উপস্থিতি তো রাজনৈতিক কর্মীর প্রাত্যহিকতার অঙ্গ এমনিতেই। পুজোর কটা দিন বরঞ্চ নিকটতম স্বজনদের সাথে সময় কাটানোতেই শান্তি বেশি অনেক। ছেলেবেলার যে বন্ধুরা ধেড়ে বয়সেও সুখেদুঃখে টিকে যায়, যাদের সাথে বাঙালি একটু বড় হলে লাদাখ বা গোয়া, নিদেনপক্ষে দার্জিলিং যাওয়ার প্ল্যান করেই ফি বছর,  ক্লাস সেভেন থেকেই সে বন্ধুদের বুকিং ছিল ষষ্ঠীর সারাদিনখানি। প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘুরতে গেলে ষষ্ঠীর থেকে বৈজ্ঞানিক দিন আর হয় না। নাইদার টু আর্লি, নর টু ভীড়াক্কার। ইদানীং অবশ্য পারলে মহালয়ার আগেই পুজোর উদ্বোধন হয়ে যাচ্ছে শাসকবর্গের মাতব্বরির গুঁতোয়, চতুর্থী থেকেই অসুরের চোখ বা সিংহের দাঁত সংক্রান্ত হাজার হাজার অভিমত জমা পড়ছে শারদীয় বাতাসে। যাক সে কথা। সে বন্ধুদের গ্রুপ এখন শতধাখণ্ড, কলকাতায় থাকি আমি আর আর একজনই মাত্র। যখন এক এক করে ফুড়ুৎ হচ্ছে ব্যাটারা সব, প্রস্তাব দিয়েছিলুম, এ আড্ডাটা যেন জীবদ্দশায় বন্ধ না হয়, প্রয়োজনে ভার্চুয়ালই সই। কথা রাখা গেছে, এবছরও গ্রিনউইচের ঘড়ি মিলিয়ে মিলিয়ে মিল বৈঠেঙ্গে সব ইয়ার। পরিবারের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। দিদা চলে গেলেন বিধানসভা নির্বাচনের সময়ে, দাদু অবশ্য এখনো তরুণতম সদস্যের দৌড়ে দাদার চার বছরের সন্তানকে জোর কদমে টেক্কা দিয়ে চলেছেন। স-বান্ধবী থেকে সস্ত্রীক হয়েছি দুটো পুজো হলো, নবমীতে সামনের রাং দেখে ঠিকঠাক পাঁঠার মাংস বাজার করে আনার ব্যাপারে অবশ্য বাবা অদ্যাবধি ভরসা করে উঠতে পারেননি ছেলেকে। ভালতে মন্দতে, এই কটা দিন, সব্বাই মিলে, তেড়েফুঁড়ে জীবনের উদযাপন - অন্তত চেষ্টা করা, ভাল থাকার, ভাল রাখার।

আপনিও ভাল থাকুন। অনেক মানুষ ভাল নেই, সামনের শারদোৎসবের আগে তাদের আরেকটু ভাল রাখার চেষ্টাটুকু করি চলুন। লাটুবাবু, ছাতুবাবু থেকে বেরিয়ে চাচার হোটেল খুঁজতে গিয়ে দেখা হয়ে যেতেই পারে আপনার সঙ্গে। কুশল বিনিময় হবে, আনন্দ ভাগ হবে, দশমী পড়ে গেলে বিষণ্ণতার সেপিয়াটোনে "আসছে বছর আবার হবে" টুকুও হবে নিশ্চয়ই। 

আপাতত এ বছর কত দ্রুত শরতের মেঘে সওয়ার হয়ে সকালবেলা প্যান্ডেল থেকে হেমন্ত মুখুজ্জের গলায় "ও আকাশ সোনা সোনা" ভেসে আসে ঘুমভাঙা জানালায়, তারই অপেক্ষা!

(লেখক সৃজন ভট্টাচার্য্য, ভারতের ছাত্র ফেডারেশনের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সাধারণ সম্পাদক) 

(Zee 24 Ghanta App দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App) 

.