শরীরী আত্মা, অশরীরী আতঙ্ক
স্বচ্ছ জলে একটি ফোঁটা নীল তরল। মুহূর্তে এদিক-সেদিক হয়ে জলের মধ্যেই সৃষ্টি হল রহস্যময় ত্রিমাত্রিক বিশ্ব। এই দৃশ্যপটেই একে একে আবির্ভূত কলাকুশলীদের নাম। বহুদিন বাদে এমন একটি টেকনিকের ব্যবহার দেখলাম টাইটেল কার্ডে। সঙ্গে ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরের যোগ্য সঙ্গত দাগ কেটে দেয় মনে।
শর্মিলা মাইতি
ছবির নাম: আত্মা
রেটিং:***1/2
স্বচ্ছ জলে একটি ফোঁটা নীল তরল। মুহূর্তে এদিক-সেদিক হয়ে জলের মধ্যেই সৃষ্টি হল রহস্যময় ত্রিমাত্রিক বিশ্ব। এই দৃশ্যপটেই একে একে আবির্ভূত কলাকুশলীদের নাম। বহুদিন বাদে এমন একটি টেকনিকের ব্যবহার দেখলাম টাইটেল কার্ডে। সঙ্গে ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরের যোগ্য সঙ্গত দাগ কেটে দেয় মনে। প্রস্তুত করে দেয় একটি অন্যরকম আবহ।
পরিচালক সুপর্ণ ভার্মা যে বিশ্বের ছবি আঁকলেন, সেখানে জীবিত ও মৃত মানুষের সহাবস্থান। প্রেম, বিচ্ছেদ, প্রতিহিংসা সব অনুভূতিই তীব্রভাবে বর্তমান। মৃত্যু পরবর্তী জগত্ থেকে আত্মা নেমে আসে সেই অনুভূতিরই টানে। মৃত্যুর গন্ধ সেখানে বর্তমান, তবু কেমন অদৃশ্য। কখনও শরীরী কখনও অশরীরী। আকারহীন হয়েও যে অতৃপ্ত আত্মারা রাজত্ব করে জীবন্ত মানুষের ইন্দ্রিয়ে। এ ছবি হরর মুভির তকমা পেয়েছে। পেয়েছে অ্যাডাল্ট সার্টিফিকেটও। ছবি দেখে মনে হল, এত আড়ালের প্রয়োজন ছিল না। সপরিবারে দেখার মতো ছবিও হতে পারত। ভয়ের ছবি মানেই আঠের বছরের নিচে দেখা বারণ, এমনটা কোথায় লেখা আছে?
বিপাশা বসু এবং নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি এখানে স্বামী স্ত্রী। প্রচন্ড অত্যাচারী, প্রায় মানসিক রোগগ্রস্ত স্বামীর চরিত্রে অনবদ্য নওয়াজ। এই প্রথম অন্যরকম চরিত্রে অভিনয় নওয়াজের। প্রচন্ড অত্যাচারী, প্রায় মানসিক রোগগ্রস্ত নওয়াজ স্ত্রী বিপাশাকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করলেও একমাত্র সন্তানকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসে। ডিভোর্স হওয়ার দিনেই গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যায় সে। তার সন্তানকেও নিয়ে যেতে চায় নিজের আশ্রয়ে, মৃত্যুর পরেও। মা বিপাশাও তার মেয়েকে তার বাবার অতৃপ্ত আত্মার হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে। জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে এক অদ্ভুত টানাপোড়েন, যে প্লটে প্রচুর ভয়-পাওয়ানো-ভূতুড়ে কাণ্ড থাকতে পারত। থাকতে পারত অজস্র বুজরুকির ফুলঝুরি। পরিচালক তাতে বেশ সংযম রেখেছেন। বিপাশাকে অধিকাংশ সময়েই দেখা যায় নুডল-স্ট্র্যাপ, অফ শোল্ডার কিংবা স্লিভলেস ওয়েস্টার্ন পোশাকে। তবে শরীরসর্বস্বতা থেকে উত্তীর্ণ এই বিপস। মায়ের অসহায়তা, উত্কণ্ঠা আর কষ্ট, তিনটে অনুভূতির সঠিক চিত্রায়ণের জন্য আশি শতাংশ নম্বর অনায়াসে পাবেন তিনি। হরর সিনেমায় অভিনয়ের চেয়ে স্পেশাল এফেক্টস-এর উপর জোর থাকে বেশি। তা সত্ত্বেও বিপাশার অভিনয় এক কথায় দারুণ।
বেশিরভাগ ইন্ডোর সিকোয়েন্স। আলো আর ক্যামেরার কাজ অসাধারণ। একটা অবর্ণনীয় নীল আলো ছড়িয়ে আছে গোটা স্ক্রিনে, যেটা অত্যন্ত সচেতনভাবে তৈরি করা। গা-শিরশিরে অনুভূতির জন্য। তবে ভাল লাগে না সেটের বহ্বাড়ম্বর। অত্যন্ত সাজানোগোছানো ফ্ল্যাট বেমানান। বরং বেশি জোর দেওয়া যেত প্রপস-এর সঠিক ব্যবহারে। ডিউস বলের দাপাদাপি আর রান্নাঘরে হঠাত্ প্রলম্বিত একরাশ ছুরি-কাঁচির ধেয়ে আসা, এই দুটো জায়গা বাদে কোথাও তেমন ব্যবহার দেখলাম না। বরং স্পেশাল এফেক্টস-এ ভৌতিক কান্ডকারখানার মুহূর্তগুলো ভালভাবে ধরা হয়েছে। ত্রিকালজ্ঞ পুরোহিতের যজ্ঞের সময়ে আত্মার প্রভাবে তাঁর মৃত্যুর দৃশ্যটাও বেশ রোমহর্ষক। অনেকটাই বিদেশি ছবির আদল থাকলেও, মূল ভাবনাটা বেশ জোরদার। ক্লাইম্যাক্সের পর থেকে খুব সুন্দরভাবে ফুল সার্কল হয়ে যায়। মনে হয় যেন, পুরো ঘটনাটাই হয়ত ঘটেছিল ওই শিশুটির মনে মনে, যে এখন আঠেরো বছরের তরুণী। এখনও জন্মদিনে দেখতে পায় তাঁর হারিয়ে যাওয়া মাকে। অত্যাচারী বাবার কথা মনেই নেই তার!
ভাল লাগবে কোঁকড়াচুলের ছোট্ট ডলি ধাওয়ানকেও। বেশ এক্সপ্রেসিভ। ক্যামেরার সামনে স্বচ্ছন্দ। রাম গোপাল ভার্মার ভূত রিটার্নস-এর ছোট শিশুর থেকেও বেশি ভাল লাগবে দর্শকের। সংলাপ আরও মনোযোগ দাবি করে। কেন জানা নেই, ‘উও বেটিকো লেনে ওয়াপস আ গয়ে’ শব্দবন্ধগুলো বড় বেশি ব্যবহার করা হয়েছে, বিরক্তি উদ্রেক করে। বরং একটু বেশি দেখানো যেত বিপস-নওয়াজের সম্পর্কের তিক্ততার ব্যাপারটা। আরও একটু বিশ্বাসযোগ্য হত তাহলে।