যেখানে ভূতের ভয়

যে তিনটে গল্প নিয়ে সন্দীপ রায় এই ছবি বানালেন, সেগুলো অনেকেরই ফেলে আসা সোনালি কৈশোরের বড় আদরের বন্ধু ছিল। গত বছর অনীক দত্ত যেভাবে বাঙালিমানসে ভূতগুলোকে অকৃত্রিম ঠাঁই দিয়েছিলেন, তারপর থেকেই বাংলা সিনেমায় ভূতের উপস্থিতি আছে শুনলেই নিজের অজান্তেই মনটা কীরকম ভাল-ভাল হয়ে ওঠে।

Updated By: Jan 10, 2013, 09:24 PM IST

রায়া দেবনাথ
রেটিং-***

যে তিনটে গল্প নিয়ে সন্দীপ রায় এই ছবি বানালেন, সেগুলো অনেকেরই ফেলে আসা সোনালি কৈশোরের বড় আদরের বন্ধু ছিল। গত বছর অনীক দত্ত যেভাবে বাঙালিমানসে ভূতগুলোকে অকৃত্রিম ঠাঁই দিয়েছিলেন, তারপর থেকেই বাংলা সিনেমায় ভূতের উপস্থিতি আছে শুনলেই নিজের অজান্তেই মনটা কীরকম ভাল-ভাল হয়ে ওঠে। তাই মনের ভেতরে কিছুটা পক্ষপাতিত্ব নিয়েই বন্ধুদের `পর্দায়ন` দেখতে শীতের দুপুরে গিয়ে পৌঁছেছিলাম সিনেমাহলে। প্রত্যাশা ছিল সত্যিই অনেক।

না, প্রত্যাশার সীমারেখাটা হয়তো ছুঁতে পারেনি সন্দীপ রায়ের ভূতদের কারসাজি। তবে হতাশও করেনি। এই সিনেমায় ব্যবহৃত তিনটে গল্পই প্রায় সবার জানা। তাই দর্শককে আকৃষ্ট করতে পরিচালকের ভূমিকা অনেক। আশ্চর্য, `যেখানে ভূতের ভয়`-এর ক্ষেত্রে সিনেমার সঙ্গে দর্শকের যতটুকু আত্মীয়তা তৈরি হয়েছে তার কৃতিত্বের দাবিদার পরিচালকের থেকে ঢের বেশি গল্পের নমস্য লেখকরা এবং সিনেমার অভিনেতারা।
সত্যজিৎ রায়ের `অনাথ বাবুর ভয়` আর `ব্রাউন সাহেবের বাড়ি` এবং শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের `ভূত ভবিষ্যৎ`, এই তিনটে গল্পকে এক ফ্রেমে ধরেছেন পরিচালক সন্দীপ রায়। এর সঙ্গেই সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত তারিণীখুড়ো চরিত্রটিকে এই সিনেমায় নিয়ে এসেছেন সন্দীপ। পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় এই ছবিতে চিরাচরিত কথকের ভূমিকায়। খুদে অনুরাগীদের অভিজ্ঞতার ঝুলি উজাড় করার সময় তিনি একে একে এই তিনটি গল্প শুনিয়েছেন। তারিণীখুড়োর ভূমিকায় পরাণ বন্দোপাধ্যায়। ভূতের গল্প শুরুর আগে তারিণীখুড়ো মোটামুটি ভূতদের প্রকারভেদ সম্পর্কে নাতিদীর্ঘ একটা `লেকচার` দিয়েছেন। তাঁর মত অনুযায়ী ভূত চারপ্রকার- ১) অশরীরী আত্মা। যাঁদের চোখে দেখা যায় না। ২) ছায়ামূর্তি। ৩) কঙ্কাল ৪) আর নিরেট ভূত। এই সিনেমার তিনটে গল্প জুড়েই ভূতের নিরেটত্বের রমরমা। সন্দীপ রায় কিন্তু গল্পগুলো নিয়ে বিশেষ কাটাছেঁড়া করেননি। `অনাথ বাবুর ভয়` গল্পে ট্রেন বদলে বাস আর ব্রাউন সাহেবের বাড়ি`-র ঘটনাস্থল বেঙ্গালুরু থেকে বদলে শুধু কালিম্পং হয়েছে। তা ছাড়া গল্পের বইয়ের পাতাগুলোই মোটামুটি সিনেমায় তুলে এনেছেন পরিচালক।

সিনেমার প্রথম গল্প `অনাথ বাবুর ভয়`। অনাথ বাবুর চরিত্রে দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায় এক্কেবারে পারফেক্ট। কিন্তু লেখক চরিত্রটি সিনেমায় কিছুটা অবহেলিত। লেখকের ভূমিকায় শুভ্রজিৎ দত্ত অল্পপরিসরে যথাসাধ্য চেষ্টা করলেও চিত্রনাট্য তাকে বিশেষ সুযোগ দেয়নি। সব মিলিয়ে ছবির এই অংশটি সাধারণের পর্যায়ে ফেলা যায়।
দ্বিতীয় গল্পটি ব্রাউন সাহেবের বাড়ি। এই গল্পটি সত্যজিৎ রায়ের লেখা আমার অন্যতম প্রিয়। কিন্তু এখানে পরিচালক সত্যিই হতাশ করেছেন। ব্রাউন সাহেবের ডায়েরি পড়ে রঞ্জনের কালিম্পং-এ বন্ধুর বাড়িতে সাইমন, অর্থাত্‍ ব্রাউন সাহেবের বিড়ালের ভূতকে দেখতে ছুটে যাওয়া, সেখানে মিস্টার ব্যানার্জির সঙ্গে আলাপ, তারপর তিনজনের সাইমনকে দেখতে ব্রাউন সাহেবের কুঠিতে সন্ধেযাপন এ পর্যন্ত ঠিকঠাকই চলছিল সবকিছু। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গোল বাধল গল্পের মূল আকর্ষণ সাইমনে এসে। আরামকেদারায় দোল খাওয়া সাইমনের ছবি সত্যজিৎ যে নিপুণ দক্ষতায় কলমের খোঁচায় আমাদের মনে এঁকে দিয়েছিলেন, সিনেমার সাইমনে এসে তা বড়সড় ধাক্কা খেল। স্পষ্ট কথায় সাইমনকে ঠিকমত পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে পরিচালক সম্পূর্ণ ব্যর্থ। এছাড়াও রঞ্জন-অনীক-মিস্টার ব্যানার্জী এই ত্রয়ীর কেমিস্ট্রিটা জমতে জমতেও জমল না। কোথা থেকে শুরু হল, কখনই বা শেষ হয়ে গেল, বুঝতেই পারবেন না দর্শক। অ্যানিমেটেড বিড়ালভূতকে দেখে ভয় তো লাগবেই না, হাসিই পাবে। কালো পর্দায় বিড়ালের চোখজোড়া জ্বলজ্বল করছে, সেটা পর্যন্ত অ্যানিমেটেড! পরিচালক এই ব্যাপারে আলোছায়ার সৃজনশীলতাকে কাজে না লাগিয়ে কেন অ্যানিমেশনের সাহায্য নিলেন বোঝা গেল না।

তৃতীয় ও শেষ গল্প `ভূত-ভবিষ্যত`। বাকি দু`টো গল্পের গা-ছমছমে আবহ কাটিয়ে এটা শুধুই মজার। এটিই সেরা। সৌজন্যে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় এবং পরাণ বন্দোপাধ্যায়। হ্যাঁ, তারিণীখুড়োর সঙ্গে এই গল্পে ভূত নন্দদুলালের ভূমিকায় হাজির পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তারিণীখুড়োর বয়ানে পরিচালক কৌশলে তাঁর সঙ্গে নন্দদুলালের চেহারার মিলের কথা বলিয়ে নিয়েছেন। এই গল্পে শাশ্বত আর পরাণের কমিক টাইমিং দুর্ধর্ষ। ভাল ভূত নন্দদুলালের লেখক প্রতাপ সরকারের কাছে নন্দবাবু হয়ে ওঠা থেকে তাদের প্রত্যেকটি কথোপকথন, এক কথায় অনবদ্য। বাংলা ইন্ডাস্ট্রির এই সময়ের সেরা দুই চরিত্রাভিনেতা ....। শাশ্বত, আপনি বোধহয় প্রতিটি ছবিতে প্রতিটি চরিত্রে নিজের ভেতরে লুকিয়ে থাকা অনেকগুলো মানুষকে বের করে আনছেন। আগামী কয়েক দশক আপনার অভিনয় দেখার জন্য নিষ্পলক চেয়ে রইলাম।
সব মিলিয়ে আপনার শীতের একটা দিন ভূতদের নামে নিশ্চিন্তে উৎসর্গ করতেই পারেন। ঠকবেন না। সব শেষে একটা `ফিল গুড ফিলিং` আপনার ছোটবেলার ভয়-পাওয়ার অভিজ্ঞতাকে `রিওয়াইন্ড` করবেই। ভূত বা থ্রিলার গল্পের একটাই সমস্যা, শেষটুকু যদি আগে থেকে জানা থাকে তাহলে উত্তেজনা কিছুটা কমে যায়। পরিচালক সন্দীপ রায় এ ব্যাপারে আরও একটু সতর্ক হলে ভাল হত।

.