সেইখানে হবে দেখা, নিজের সঙ্গে একা

একবার ভাবতে চেষ্টা করছি আমাদের শহরে কোন ছেলে বা মেয়ে যা নিজেই নিজের প্রেমে পরেছে, সে কেমন করে কাটাবে তাঁর প্রেমদিবস? একটা ক্যাডবেরি কিনবে, একটা গ্রিটিংস কার্ড। তাতে লিখবে, `ভেরি ফাইন ইস মাই ভ্যালেনটাইন, ভেরি ফাইন অ্যান্ড ভেরি মাইন।`

Updated By: Feb 13, 2012, 11:34 PM IST

শময়িতা চক্রবর্তী

আজ সেই ভ্যালেন্টাইন্স ডে উপলক্ষে রাস্তায় রাস্তায় বেলুন, ক্যাডবেরি আর গ্রিটিংস কার্ড-এর মেলা, আর পার্কে কালচর কাকুদের 'এই ওসব কী হচ্ছে' এড়িয়ে ইয়া বড় ছাতার আড়ালে মিঠে খুনসুটি। প্রেম নিয়ে নিত্যদিনের গ্যাজর গ্যাজর শুনতে শুনতে এমনকী ক্লিশে হয়ে গিয়েছে এভারগ্রিন 'রম-কম'-ও। কারণ, একসময় তো বিরিয়ানি খেতে খেতেও জিভে 'চালসে' ধরে যায়। এসব ভাবতে ভাবতে যখন মনে হচ্ছিল এই ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে জনগণকে নতুন কিছু ভাবনার খোরাক দেওয়ার আর কিছুই অবশিষ্ট নেই, ঠিক তখনই আমাদের চিরাচরিত ধ্যাড়ধ্যাড়ে ভাবনার রুক্ষ ঊষর জমিতে সিগনাল ভুল করে ধড়াম করে আছড়ে পড়ল একটা খবর। তাইওয়ানের এক মহিলা নিজেই নিজেকে ভালবেসে বিয়ে করে ফেলেছেন।
ঠিক যেন, 'বস, আজ আমার নিজের সঙ্গে নিজের একটা অ্যাপো আছে।'
ব্যাপারটা উপর উপর ভাবতে 'মজামিরি'। কিন্তু ফাজলামির খানাখন্দ পেরিয়ে একটু তলিয়ে দেখা গেলে হাড় হিম হয়ে যায়। প্রেম দিবসে অন্যকে গিফ্‌ট নিবেদন পরে হবে, আগে নিজের বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, আমরা নিজেরা নিজেদের কতটা ভালবাসি?
প্রতিদিনের ঘেন্নাপিত্তি, মল, ওয়াক-থু, রাস্তায় অটোওয়ালার ধ্যাতানি, অফিসে বসের ঝাড়, রাতে বউ/বরের মেজাজ, এমন নিত্যদিনের অসম্মানের পাহাড় পেরোতে পেরোতে কাঁধের দগদগে ঘাগুলোতে মাছি বসলেও যখন অসাড় হয়ে যায় তখন বুঝি না আমাদের সত্যিই কি কোনও মূল্য আছে নিজেদের কাছে? তাই খুব সহজে লাথি ছুঁড়ে দিয়ে থাকি গণপিটুনি খেতে খেতে ধুঁকতে থাকা ছিঁচকে চোরটার দিকে, স্বল্পবেশ স্বাস্থ্যবতীকে যত্‍‍পরোনাস্তি দৃষ্টিলেহন করে পাড়ায় এসে মিটিং করি এহেন বে-আব্রু 'মেয়েছেলে'র এ পাড়ায় থাকাটা সঙ্গত কি না, আর কর্পোরেশন অফিসে গলার কাছে জমে থাকা রাগ, বিরক্তি, থুতু একঢোঁকে কপাত করে গিলে ফেলে ৫০০ টাকার নোটটা বাড়িয়ে দিতে হয় কোনও কেরানির হাজা ধরে যাওয়া হাতে।
আর এত এত অপমান গিলেও বলব আমরা নিজেদের ভালবাসি? সম্মান করি? ভ্যালেন্টাইন্স ডে-র দিন কি আর মধ্যবিত্ত বাঙালির গায়ে সাধে জ্বালা ধরে 'ছেলেমেয়েগুলো বখে গেল' ভেবে?
আর ঠিক সেই জায়গায় এক মহিলা সগর্বে ঘোষণা করলেন যে তিনি নিজেকে ভালবাসেন। আর কতখানি? না, ভালবেসে নিজেকেই জীবনসঙ্গী/সঙ্গিনী করে ফেললেন। চার্চে শপথ করলেন যে তিনি নিজেকে সম্মান করবেন। আমৃত্যু নিজেকে নিজের থেকে হারাবেন না।
এতো মুখের কথা নয়!
সারাজীবন নিজেকে সম্মান দেওয়া আর সারা বিশ্বের মুখে ঝাপটা মেরে বলা, 'কাউকে চাই না। আমি নিজেই নিজের 'বেটারহাফ'।' এ জিনিস আমাদের ডিসপেপসিয়া-আক্রান্ত পাকস্থলী সহজে নিতে পারবে বলে মনে হয় না। এ জিনিসের জন্য কলার-তোলা উদ্ধত-সাহস দরকার। দরকার সীমাহীন কনফিডেন্স।

একবার ভাবতে চেষ্টা করছি, আমাদের শহরে কোনও ছেলে বা মেয়ে নিজেই নিজের প্রেমে পড়ে কেমন করে কাটাবে প্রেমদিবস? একটা ক্যাডবেরি কিনবে, একটা গ্রিটিংস কার্ড। তাতে লিখবে, 'ভেরি ফাইন ইস মাই ভ্যালেনটাইন, ভেরি ফাইন অ্যান্ড ভেরি মাইন।' তারপর গুটিগুটি পায় এগোবে অলিপাবের দিকে। দু'পাত্তর ভদকা নিয়ে বসবে দুজনায় পাশাপাশি, হাতেহাত রেখে। হাজার লোকের উৎপটাং ভিড়েও বিন্দুমাত্র টস্কাবে না দুজনের নিভৃত কণ্ঠে ফিসফিস প্রেম। ভদকায় একটা করে চুমুক, আর ফিসফিস করে নিজেকে বলা, 'কোনওদিন ছেড়ে যেওনা আমায়... আমি জানি, তুমি পারবে না।' মাথা যখন ঝিমঝিম, রাজার হালে ট্যাক্সি ডেকে উঠে পড়া। সেই সঙ্গে যদি কোনও ছেলে বা মেয়েকে দুজনেরই ভাল লেগে যায়? তাহলে তো তিনজনের সেই উদ্দাম প্রেমের কোনও তুলনাই হয় না সেই দিনটায়। তারপর সেই ভাললাগা কেঁচিয়ে গেলে?
কুছ পরোয়া নেহি!
ফিসফিস করে বলবে, 'আমাকে পাত্তা না দিয়ে অন্যদিকে ছকবাজি করে দেখলি তো কী হয়? বুঝিস না কেন বোকা, একমাত্র 'আমিই' থাকব সারাজীবন। অন্যরা তো হেমন্তের পাখি। যাক, ও মাল গ্যাছে ভালই হয়েছে। তোর-আমার প্রেমে ব্যাগরা দেওয়ার কেউ থাকল না। আজ রাতে ক্যান্ডল-লাইট ডিনারটা হচ্ছে তো বস? তুই বললে নাচতেও পারি আজ। যদিও জানিস তো নাচটা আসেনা আমার ঠিক। তবে আজ ভ্যালেনটাইন্স-ডে বলে কথা। জানিস তো, আসার আগে বিছানার ধারে তোর পছন্দের গিভঁসির পারফিউমটা রেখে এসেছি। আমি কিন্তু উদ্দাম আদর করব আজ তোকে। সারারাত। কোনও কথা শুনব না। নে, অনেক হয়েছে। এবার একটা সিগারেট খাওয়া।'

.