'অন্ধকার দিনে সুড়ঙ্গের শেষে আলো দেখতে পাওয়ার আশা হারিয়ে গেল': শ্রীজাত

আমি একধরনের আশ্রিতই ছিলাম ওঁর কাছে, সেই আশ্রয় হারালাম। এবং আমি নিশ্চিত যতদিন বাঁচব এমন ছায়া, এমন আশ্রয় আমি আর পাব না কোথাও।

Edited By: অনুসূয়া বন্দ্যোপাধ্যায় | Updated By: Apr 21, 2021, 04:30 PM IST
'অন্ধকার দিনে সুড়ঙ্গের শেষে আলো দেখতে পাওয়ার আশা হারিয়ে গেল': শ্রীজাত

শ্রীজাত 

কবি এবং পাঠকের সম্পর্কের বাইরেও ওঁর সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, সেই সূত্রে আমি একধরনের আশ্রিতই ছিলাম ওঁর কাছে, সেই আশ্রয় হারালাম। এবং আমি নিশ্চিত যতদিন বাঁচব এমন ছায়া, এমন আশ্রয় আমি আর পাব না কোথাও। এটা আমার ব্যক্তিগত ক্ষয়। তবে এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আমাদের গোটা দেশ নিঃস্ব হল আরও একবার। ওঁর মত মহাকবি, একজন চিন্তক, একজন দার্শনিক, সমাজচেতনাসমৃদ্ধ একজন স্পষ্ট বক্তা মানুষ আর নেই।

আরও পড়ুন:'অভিভাবকহীন সাংস্কৃতিক জগত, শঙ্খ ঘোষই ছিলেন শেষ যবনিকা', প্রতিক্রিয়া বিশিষ্টজনদের

ওঁকে হারানো মানে অন্ধকার দিনে সুড়ঙ্গের শেষে আলো দেখতে পাওয়ার আশা অনেকটা হারিয়ে ফেলা, আমি জানি না এই সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে পারব কিনা, ব্যক্তিগতভাবে অন্তত পারব না আমি। আমরা সবসময়েই জানি যে যখনই কোথাও কোনও অন্যায় ঘটবে, আর কেউ সোচ্চার না হলেও শঙ্খ ঘোষ গর্জে উঠবেন, সেটাই ছিল আমাদের ভরসা। আমরা অনেকসময় যখন দ্বিধায় থাকতাম, কোনটা ঠিক, কোনটা বেঠিক, দিক নির্ণয় করে দিতেন শঙ্খ ঘোষ। তিনি কোন দিকে দাঁড়িয়ে আছেন দেখে আমরাও তা বিশ্বাস করতাম। আমরা তো সবসময় সব সিদ্ধান্ত নিতে পারি না, অভিভাবকের মত এসে তিনি ঠিক, বেঠিক বুঝিয়ে দিতেন এতটাই ভরসা, আস্থা ওঁর বিবেচনার উপর আমাদের ছিল।

কোভিড ওঁকে গ্রাস করেছিল ঠিকই। কিন্তু ওঁর যে চেতনা, ওঁর যে চিন্তন, ওঁর যে মনন তাকে মারতে পারে এখনও এমন কোনও অতিমারী জন্মায় নি, আর দেখা হবে না ওঁর সঙ্গে কিন্তু ওঁর ভাবনার সঙ্গে প্রতিনিয়ত, প্রতিমুহূর্ত দেখা হবে। সেই দেখাটা যেন আমাদের হতেই থাকে। জাতীয় সম্পদকে হারালাম আমরা।

আরও পড়ুন:শঙ্খ ঘোষের প্রয়াণে শোকবার্তা মোদি-মমতার, টুইট শাহ-নাড্ডা-ধনখড়ের

বাইশে মাঘ ওঁর জন্মদিন ছিল, ওঁকে আমার লেখা উপহার দিয়েছিলাম। কবিতার নাম- 'স্নান'। আজ সেই কবিতাতেই ওঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাই।

তোমার পায়ে বাঁধা আবহমান
দু’হাতে আয়ুরেখা, ছায়াপথের
যখনই বহুদিন করিনি স্নান,
সবাই জড়ো হতে এসেছি ফের।

তোমার হেঁটে যাওয়া আলোবাগান
শাখায় পাতা বোনা, চিরহরিৎ  
তাকানো সোজা রাখে যে-অভিমান,
তোমারই মাটি থেকে সে তোলে ভিত।

তোমার বসে থাকা দিনাবসান।
সূর্য ঘুরে যায় কত-না পথ...
সন্ধে নেমে আসে জোনাকিধান
শরীরে পাখি নেয় পুরনো বট।

তোমার নীরবতা ছায়াসমান।
অথচ ভেঙে গেলে চোখের ছল
লেখার ঘরে ঢোকে দামিনীগান -  
দু’দিকে সরে যায় তমসাদল...

তোমার ব্যথা পাওয়া, ক্ষতনিশান
রাত্রে জ্বলে থাকে কোটি তারায়
দেখেছি দূরে সেই ধূলিকৃপাণ
ফাটল খুঁজে খুঁজে আলো সারায়...

তোমার জেগে থাকা প্রতীয়মান।
মানুষও পথ চায়, উপশমের...
যখনই বহুদিন করিনি স্নান,
সবাই জড়ো হতে এসেছি ফের।

স্নানের পর সেই জলের দাগ
নিখুঁত বয়ে চলা জলের দাগ
আড়ালে লিখে রাখে, বাইশে মাঘ... 

(অনুলিখন)

.