Tarun Majumdar Death : পলাতক জীবনপুরের পথিক
সুস্থ রুচির স্নিগ্ধ স্বাদের এমন এক ধাঁচের ছবি চিরকাল বানিয়ে গিয়েছেন, যে দিনে দিনে তা টলিউডে একটা আলাদা ঘরানাই তৈরি করে দিয়েছে। যে-ছবি দেখতে বসে অনর্থক বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দিতে হয় না। তিনি পপুলার, কিন্তু আদ্যন্ত রুচিশীল।
সৌমিত্র সেন
প্রথম জীবনে রসায়নের ছাত্র ছিলেন, শেষপর্যন্ত রসসৃষ্টিতেই সিদ্ধিলাভ করলেন। সেলুলয়েডে রচিত তাঁর যে ছবি-কাব্য, তার নন্দিত তারুণ্যে তিনি ছুঁয়ে দিলেন বঙ্গবাসীর হৃদয়মন। বাংলা চলচ্চিত্রের ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর সত্য়জিৎ-ঋত্বিক-মৃণালের পাশে তিনি অনন্য অপূর্ব স্নিগ্ধ আটপৌরে এক উপস্থিতি। পপুলার কিন্তু আদ্যন্ত রুচিশীল-- তরুণ মজুমদার। বাংলা চলচ্চিত্রের জগতে এক অপূরণীয় শূন্যতা সৃষ্টি করে চলে গেলেন। রেখে গেলেন তাঁর অবিস্মরণীয় সৃষ্টিসম্ভার।
১৯৩১ সালের ৮ জানুয়ারি অধুনা বাংলাদেশের বগুড়ায় জন্ম তরুণ মজুমদারের। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। প্রায় ষাট বছরের দীর্ঘ কেরিয়ার তাঁর। ১৯৫৯ সালে ছবির জগতে পা। কাজ করেছেন এই সেদিন পর্যন্ত-- ২০১৮ সাল। ১৯৯০ সালে 'পদ্মশ্রী' সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন। মাত্র গত বছর, ২০২১ সালে দু'খণ্ডে প্রকাশিত হল তাঁর ৯০০ পৃষ্ঠার সুবিশাল স্মৃতিকথা-- 'সিনেমাপাড়া দিয়ে'। বাংলা ছবির কত ঘটনা, কত স্মৃতি, কত অ্যানেকডোট সেখানে ঠাঁই পেয়েছে। বাংলা ছবির ইতিহাস-অনুসন্ধিৎসুদের কাছে যা চিরকালের জন্য এক প্রামাণ্য দলিল হয়ে থেকে গেল।
সিনেমাপাড়া দিয়ে তরুণের হাঁটা শুরু হয়েছিল অনেক আগেই। যোগাযোগ হয়েছিল 'থিরবিজুরি' কাননদেবীর সঙ্গে। এই কাননদেবীর প্রোডাকশনেই আলাপ শচীন মুখোপাধ্যায় এবং দিলীপ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। ১৯৫৯ সালে ততদিনে-বন্ধু শচীন এবং দিলীপকে সঙ্গে নিয়েই তরুণ গড়লেন 'যাত্রিক'। যাত্রিকের ব্যানারে প্রথম ছবিই ব্লক ব্লাস্টার-- উত্তম-সুচিত্রার 'চাওয়া-পাওয়া'। পরে 'কাঁচের স্বর্গ'ও সাড়া ফেলে দিল। ১৯৬২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই ছবির জন্য জুটেছিল জাতীয় পুরস্কার। ঘটনাচক্রে তরুণের জীবনে সেটিই প্রথম জাতীয় পুরস্কার।
১৯৫৯ সাল থেকে ১৯৬৫ সাল-- এই সাত বছর তরুণ মজুমদার 'যাত্রিক'-এর ব্য়ানারেই কাজ করেন। ১৯৬৩ সালের পর থেকেই তরুণ স্বাধীনভাবে কাজ শুরুর কথা ভাবছিলেন। 'পলাতক'-এর পরে ১৯৬৫ সালে তিনি তৈরি করলেন দুটি ছবি-- 'আলোর পিপাসা' ও 'একটুকু বাসা'। তাঁর একক প্রয়াসের প্রথম দুটি ছবি। প্রথম ছবিতেই জাত চিনিয়ে দিলেন তরুণ।
এরপর তাঁর হাত থেকে একে একে বেরিয়ে এল কত-না মণিমুক্তো-- বালিকা বধূ (১৯৬৭), নিমন্ত্রণ (১৯৭১), কুহেলি (১৯৭১), শ্রীমান পৃথ্বীরাজ (১৯৭৩), ফুলেশ্বরী (১৯৭৪), সংসার সীমান্তে (১৯৭৫), গণদেবতা (১৯৭৮)। 'নিমন্ত্রণ' ও 'গণদেবতা' তাঁকে পুরস্কারে স্বীকৃতিতে খ্যাতিতে ভরিয়ে দিয়েছিল। 'গণদেবতা' শ্রেষ্ঠ বিনোদনমূলক জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের জন্য জাতীয় পুরস্কার জিতে নিয়েছিল, আর 'নিমন্ত্রণ' পেয়েছিল শ্রেষ্ঠ বাংলা ছবি হিসেবে জাতীয় পুরস্কার।
এর পরে যে ছবিগুলি তাঁর হাত থেকে এল সেগুলিও জনপ্রিয় তথা 'হিট' বাংলা ছবির ইতিহাসে দীর্ঘ ছায়া ফেলে রেখে গিয়েছে-- দাদার কীর্তি (১৯৮০), ভালোবাসা ভালোবাসা (১৯৮৫), পথভোলা (১৯৮৬), আপন আমার আপন (১৯৯০)। বিভিন্ন বিষয়ের উপর অনেক রকম ছবি বানালেও শোনা যায়, নিজের তৈরি ছবিগুলির মধ্যে তরুণ মজুমদার নাকি সব চেয়ে পছন্দ করতেন 'ফুলেশ্বরী'।
তরুণ মজুমদারের স্ত্রী সন্ধ্যা রায় এক বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন অভিনেত্রী। বাংলা ছবির দর্শক সন্ধ্যা রায়কে নায়িকা-কাম-চরিত্রাভিনেত্রী হিসেবেই জানে। এহেন সন্ধ্যা তরুণ মজুমদারের ২০টি ছবিতে কাজ করেছেন।
কোনও পরিচালকের যে অভিজ্ঞানটি সবকিছুর পাশাপাশি তাঁকে আলাদা করে চিহ্নিত করে দেয়, তা হল তাঁর নতুন প্রতিভা তুলে আনার দক্ষতা। এক্ষেত্রেও তরুণ মজুমদারের চোখে পড়ার মতো সাফল্য। তাঁর হাতেই কেরিয়ার শুরু মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়, তাপস পাল, মহুয়া রায়চৌধুরী, অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তাপস পাল তাঁর আটটি ছবিতে কাজ করেছেন।
তরুণ মজুমদারের ছবিতে সঙ্গীতের জায়গাটা খুব বড়। তাঁর ছবিতে ব্যবহৃত গান বাঙালির বড় আদরের। তা যেমন চলতি অর্থে 'হিট'ও, তার মধ্যে আবার নান্দনিকতার সুচারু প্রকাশও বহুবার পেলব স্পর্শ দিয়েছে বাঙালির শ্রবণে ও মনে। নতুন গানের পাশাপাশি তাঁর ছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহারও চোখে পড়ার মতো। সেখানেও অসংখ্য চেনা গান এমন নতুন ভাবে ব্যবহৃত বা উপস্থাপিত হয়েছে যা দর্শক-শ্রোতার সঙ্গীতবোধকে ভিন্ন ভাবে ছুঁয়ে দিয়েছে। তাঁর ছবিতে রবীন্দ্রগান কোথাও কোথাও যেমন অমোঘ তেমনই অপরিহার্য।
তরুণ মজুমদার সুস্থ রুচির স্নিগ্ধ স্বাদের এমন এক ধাঁচের ছবি চিরকাল বানিয়ে গিয়েছেন, যা দিনে দিনে টলিউডে একটা আলাদা ঘরানাই তৈরি করে দিয়েছে। যে-ছবি দেখতে বসে বুদ্ধির গোড়ায় অনর্থক ধোঁয়া দিতে হয় না; অথচ যে-ছবি রুচি ও মেজাজের সহজ সাধারণ স্বাভাবিকতাকেও কখনও ক্ষুণ্ণ করে না-- তেমন একটা মিষ্টি-মধুর রসের সাহিত্যধর্মী ছবি তিনি বরাবর তৈরি করে গিয়েছেন, যা পরিবারের সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে বসে উপভোগ করা যায়। বিনোদনের সমস্ত রসদ সেখানে পূর্ণমাত্রায় থাকে, কিন্তু কোথাও বাঙালির চেনা নান্দনিকতায় বা বাঙালিয়ানায় যা বিন্দুমাত্র বিঘ্ন ঘটায় না। টানা কয়েক দশক ধরে সিনেমাপাড়া দিয়ে যেতে যেতে তিনি রুচিশীল কিন্তু বিনোদনোজ্জ্বল ছবি-নির্মাণের যে অপূর্ব তারুণ্যময় কলা ও কৌশলের উত্তরাধিকার রেখে গেলেন, কে লইবে সেই কার্য? কেউ আছেন কি তাঁর যোগ্য অনুজ, 'আংটি চাটুজ্যের ভাই'?
আরও পড়ুন: Tarun Majumdar Health Update: অবস্থার অবনতি, অতি সংকটে তরুণ মজুমদার